বিধানসভা জিইয়ে রেখেই অরুণাচলে রাষ্ট্রপতি শাসন জারির নির্দেশনামায় সই করলেন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়। গত দু’দিন ধরে আইন-বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে পরামর্শের ভিত্তিতেই শেষ পর্যন্ত তিনি কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার এই সিদ্ধান্তে অনুমোদন দিলেন বলে জানা গিয়েছে।
মুখ্যমন্ত্রী নাবাম টুকি ও তাঁর বিরোধী গোষ্ঠীর নেতা কালিখো পুলের ক্ষমতা দখলের লড়াইয়ে গত দেড় মাস ধরে অরুণাচলে কার্যত অরাজক অবস্থা চলছে। দু’তরফের বিধায়করা দিনের পর দিন আইনি লড়াই ও শিবির মজবুত করার কাজে দিল্লিতে পড়ে আছেন। রাজ্যে প্রশাসনিক কাজকর্ম থমকে রয়েছে। গত জুলাই মাসের পর থেকে রাজ্যে বিধানসভার অধিবেশনও বসেনি। সংবিধানের ১৭৪ (১) ধারা অনুযায়ী, দু’টি বিধানসভা অধিবেশনের মধ্যে ছ’মাসের বেশি ব্যবধান থাকলেই তাকে ‘সাংবিধানিক সংকট’ হিসেবে দেখা হয়। সেই যুক্তিতেই কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা গত রবিবার রাজ্যে রাষ্ট্রপতি শাসনের সুপারিশ করে। রাষ্ট্রপতি ভবনের তরফে প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে: সংবিধানের ৩৫৬(১) ধারা প্রয়োগ করে এই নির্দেশ জারি করা হয়েছে। এর ফলে ভবিষ্যতে অরুণাচলে সংখ্যাগরিষ্ঠের সমর্থন নিয়ে নতুন সরকার গড়ার সুযোগ রয়ে গেল।
গণ্ডগোলের শুরু কার্যত কংগ্রেসের তীব্র গোষ্ঠীদ্বন্দ্বকে ঘিরেই। মুখ্যমন্ত্রী নাবাম টুকি ও দলে তাঁর বিরোধী নেতা কালিখো পুলের ক্ষমতা দখলের লড়াই। সেই লড়াইয়ে কংগ্রেসের বিক্ষুব্ধ গোষ্ঠীকে পুরোমাত্রায় মদত দিয়েছে বিজেপি। ৬০ সদস্যের অরুণাচল বিধানসভায় কংগ্রেসের বিধায়ক সংখ্যা ৪৭। বিজেপির দখলে রয়েছে ১১ টি আসন। নির্দল বিধায়কের সংখ্যা দুই। এই পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে টুকি-র বিরোধীরা জোট বাঁধেন। পুলের পিছনে ২১ কংগ্রেস বিধায়কের সমর্থন রয়েছে। এর সঙ্গে বিজেপি ও নির্দলের সমর্থন নিয়ে পুল ৩৪ জন বিধায়ককে এককাট্টা করেছেন। বিরোধীদের এই জোটকে ভাঙতে মুখ্যমন্ত্রী নাবাম টুকির উদ্যোগে স্পিকার, তাঁরই তুতো ভাই নাবাম রিবিয়া ডেপুটি স্পিকার-সহ ১৪ জন কংগ্রেস বিধায়কের বিধায়ক পদই খারিজ করে দেন। তখন তাঁরা আদালতে যান।
ইতিমধ্যে রাজ্যপাল জ্যোতিপ্রসাদ রাজখোয়া স্পিকারকে বিধানসভার অধিবেশন ডাকতে বলেন। কিন্তু সংখ্যালঘু হয়ে যাওয়ার ভয়ে ভীত মুখ্যমন্ত্রীর ইঙ্গিতে স্পিকার রাজ্যপালের নির্দেশ মানতে অস্বীকার করেন। এর পরেই নজিরবিহীন ভাবে রাজ্যপালের পূর্ণ মদতে ডেপুটি স্পিকার বিধানসভার বাইরে একটি কমিউনিটি হলে ও একটি হোটেলে অধিবেশন বসান। সেখানে কালিখো পুলের সঙ্গে থাকা সবাই হাজির হন। ডেপুটি স্পিকারকে বাদ দিলে বাকি ৩৩ জনই কালিখো পুলকে তাঁদের নেতা নির্বাচিত করেন। পাশাপাশি, স্পিকার নাবাম রিবিয়াকে সংখ্যাগরিষ্ঠের ভোটে অপসারণ করা হয়।
গৌহাটি হাইকোর্টে চ্যালেঞ্জ, পাল্টা-চ্যালেঞ্জ চলতে থাকে। চ্যালেঞ্জ জানানো হয় হাইকোর্টের রায়কেই। এরপরেই বিষয়টি সুপ্রিম কোর্টে গড়ায়। যেহেতু এখানে রাজ্যপাল, মুখ্যমন্ত্রী, স্পিকার, ডেপুটি স্পিকারের ক্ষমতা নিয়েই বিতর্ক, সেই কারণে সুপ্রিম কোর্ট পাঁচ সদস্যের একটি সাংবিধানিক বেঞ্চ গঠন করে। বিষয়টি এখন সেই বেঞ্চেরই বিচারাধীন।
বিধানসভার শেষ অধিবেশন বসে গত জুলাই মাসে। সংবিধানের নিয়ম অনুযায়ী বিধানসভা বা সংসদের দু’টি অধিবেশনের মধ্যে ছ’মাসের ব্যবধান থাকতে পারে না। ছ’মাসের বেশি ব্যবধান হলে তাকে ‘সাংবিধানিক সংকট’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। গত ২১ জানুয়ারি, ছ’মাসের সেই মেয়াদ শেষ হয়ে গিয়েছে। পরিস্থিতি যাতে সে দিকে না যায় তার জন্য সুপ্রিম কোর্টের সাংবিধানিক বেঞ্চ মুখ্যমন্ত্রীকে প্রস্তাব দেয়, ১৯ জানুয়ারি বিধানসভার অধিবেশন ডেকে তিনি আস্থাভোট নিন। টুকি সেই প্রস্তাবে রাজি হননি।
এরপরেই সার্বিক প্রেক্ষিতই বদলে যায়। অরুণাচলে চলতি অচলাবস্থা কাটাতে বিধানসভা না ভেঙে রাষ্ট্রপতি শাসনের সুপারিশ করে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা। কংগ্রেস তাকে চ্যালেঞ্জ জানালেও বিশেষজ্ঞদের মতে, এ ছাড়া আর কোনও উপায় ছিল না। কেন্দ্রীয় এক সূত্রের মতে, ইতিমধ্যে সাংবিধানিক বেঞ্চ তাদের নির্দেশ দিক। তারপরে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলেই রাষ্ট্রপতি শাসন প্রত্যাহার করে নতুন সরকার গড়া হবে। সংখ্যাগরিষ্ঠ পক্ষই সরকার গড়বে।
যাঁর সিদ্ধান্তকে ঘিরে অসন্তোষের সূত্রপাত সেই রাজ্যপাল জ্যোতিপ্রসাদ রাজখোয়ার হাতেই আপাতত রাজ্যের শাসনক্ষমতা। মুখ্যমন্ত্রী ও তাঁর বিরোধী গোষ্ঠীর সব নেতা দিল্লিতে থাকলেও রাজখোয়া এ দিন কিন্তু ইটানগরে প্রজাতন্ত্র দিবসের কুচকাওয়াজে হাজির ছিলেন। রাজ্যের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে প্রশ্ন এড়িয়ে গিয়েছেন রাজ্যপাল। জানিয়েছেন শুধু ‘প্রজাতন্ত্র দিবসের শুভেচ্ছা’।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy