Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪
Presidential Election

স্বকীয়তা বজায় রেখেই সকলকে নিয়ে চলে অনন্য প্রণববাবু

জাঁকজমকপূর্ণ সাক্ষীগোপালের ভূমিকায় থেকেও প্রণববাবু প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছেন যে ব্রিটেনের রানির মতো এখানেও রাষ্ট্রপতির পদের ক্ষমতার এক নিজস্ব রাজনৈতিক পরিসর আছে। বিশ্লেষণে জয়ন্ত ঘোষালজাঁকজমকপূর্ণ সাক্ষীগোপালের ভূমিকায় থেকেও প্রণববাবু প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছেন যে ব্রিটেনের রানির মতো এখানেও রাষ্ট্রপতির পদের ক্ষমতার এক নিজস্ব রাজনৈতিক পরিসর আছে। বিশ্লেষণে জয়ন্ত ঘোষাল

১৯৬৯-র রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে ভি ভি গিরির জয়ের পিছনে ইন্দিরা গাঁধীর সমর্থন যে খুব বড় ফ্যাক্টর ছিল, সে বিষয়ে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা একমত। ছবি: আনন্দবাজার আর্কাইভ থেকে।

১৯৬৯-র রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে ভি ভি গিরির জয়ের পিছনে ইন্দিরা গাঁধীর সমর্থন যে খুব বড় ফ্যাক্টর ছিল, সে বিষয়ে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা একমত। ছবি: আনন্দবাজার আর্কাইভ থেকে।

শেষ আপডেট: ১৭ জুলাই ২০১৭ ১৩:৩৩
Share: Save:

তিনি প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গাঁধীর নম্বর-টু ছিলেন।

তিনি প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী নরসিংহ রাওয়ের নম্বর-টু ছিলেন।

আবার সেই মানুষটিই প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহেরও নম্বর-টু হয়েছিলেন।

অনেকে বলতেন ভারতীয় রাজনীতির তিনি হলেন পারপিচুয়াল নম্বর টু। পারপিচুয়াল সেকেন্ড ইন কমান্ড— এই কথাটি শুনলে প্রণববাবুকে কেউ কোনও দিন খুশি হতে দেখেননি। বিশেষত সনিয়া যখন মনমোহনকে প্রধানমন্ত্রী পদে মনোনীত করেন তখন তিনি খুব বেদনাহত হন। ‘আপনি আবার ক্যাবিনেটে দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। নম্বর টু অফ মনমোহন সিংহ।’ এ কথাটা ওঁর বাসভবনে গিয়ে ওঁর অফিসঘরে বসে বলেছিলাম। উনি খুশি হননি। বলেছিলেন, হোয়াট নাম্বার টু। ডোন্ট ফরগেট আই ওয়াজ নাম্বার টু অব মিসেস ইন্দিরা গাঁধী।’ খুব স্বাভাবিক। সে দিন ওঁর মনের বেদনাটা বুঝতে আমার সামান্যতম অসুবিধা হয়নি। প্রণববাবু যখন অর্থমন্ত্রী ছিলেন তখন মনমোহন ছিলেন রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ার গভর্নর। অর্থমন্ত্রীকে স্যর বলতেন তিনি।

প্রধানমন্ত্রী হতে না পারলেও ভারতীয় সংবিধানে প্রধান নাগরিক, দেশের সাংবিধানিক প্রধান হওয়ার সুযোগ পেয়ে তাই তিনি সক্রিয় হয়ে ওঠেন। কী ভাবে তিনি সে কাজে সফল হলেন, বিপুল ভোটে জিতলেন সে ইতিহাস আজ আমাদের জানা, কিন্তু তিনি ‘ইওর এক্সেলেন্সি’ হওয়ার পর কী ভাবে অন্যদের থেকে আলাদা হয়ে উঠলেন সেটাই এখন বিচার্য।প্রণববাবুর জীবন তাই এক কথায় ‘নাম্বার টু’ থেকে ‘নাম্বার ওয়ান’ হয়ে ওঠার কাহিনি। ভারতের সংবিধান অনুসারে প্রধানমন্ত্রীই প্রকৃত নাম্বার ওয়ান। রাষ্ট্রপতি হলেন ‘সেরিমোনিয়াল হেড’। কিন্তু গত পাঁচ বছরে এই জাঁকজমকপূর্ণ সাক্ষীগোপালের ভূমিকায় থেকেও প্রণববাবু প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছেন যে এ দেশেও ব্রিটেনের রানির মতো রাষ্ট্রপতির পদেরও ক্ষমতার এক নিজস্ব রাজনৈতিক পরিসর আছে। নরেন্দ্র মোদী প্রধানমন্ত্রী, তাঁর সঙ্গে প্রকাশ্যে কোনও সঙ্ঘাতে না গিয়েও প্রণববাবু দেখিয়ে দিয়েছেন কী ভাবে এই পরিসরটুকুতে এত সাংবিধানিক সীমাবদ্ধতার মধ্যেও সক্রিয় থাকা যায়। তিনি নিজেও সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রীর সামনেই জানিয়েছেন যে, এমন নয়, গত পাঁচ বছরে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর কোনও মতপার্থক্য হয়নি। কিন্তু সে কথা কখনওই বাইরে প্রকাশিত হয়নি। তার মানে এই নয়, প্রণববাবু প্রতিভা পাতিলের মতো হ্যাঁ-তে হ্যাঁ মেলানো রাষ্ট্রপতি ছিলেন। সংসদ চলার সময়, অধিবেশন বসার ঠিক আগে বা পরে, সংসদ এড়িয়ে সরকার চাইলেও কখনওই রাষ্ট্রপতি অর্ডিন্যান্সে সই করতে রাজি হননি।

আরও পড়ুন: যে কোনও পরিসরে প্রণব খুঁজে নেন কাজ, থাকেন প্রাসঙ্গিক

কলকাতার নিজাম প্যালেসে কংগ্রেসের সংসদীয় দলের বৈঠকে প্রণববাবু

আসলে এই প্রকাশ্য দাপাদাপি না করে নীরবে নিভৃতে কাজ করার মানসিকতাটা চিরকালই ছিল প্রণববাবুর। তার জন্য পাঠককে আগে জানতে হবে, কেমন ব্যক্তি এই প্রণব মুখোপাধ্যায়? তিনি বরাবরই কথা বলেন কম। শোনেন বেশি। এ সব লোকেদের বোঝা অনেক সময় কঠিন হয়। অনেক সময় তিনি মুখের উপর নিজের হাতটি রেখে কথা বলেন। মনস্তত্ত্ব বলে, মুখের উপর হাত রেখে কথা বলার তাত্পর্য হল মানুষটি অনেক কথাই বলছেন না। তিনি গোপন রাখতে চাইছেন। প্রণববাবুর কাছ থেকে খবর বের করাও এই কারণেই এত কঠিন ছিল। কিন্তু এই গুণটাই আবার রাষ্ট্রপতির ভূমিকা পালনে প্রণববাবুকে বিশেষ সুবিধা করে দিয়েছিল।

প্রণববাবু জানতেন রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা আসলে ‘প্রাণহীন’। হিন্দু কোড বিল এবং জমিদারি প্রথা অবলুপ্তি আইন দু’টি নিয়েই রাজেন্দ্রপ্রসাদ প্রত্যক্ষ বিরোধে যান প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে। নেহরু একগুচ্ছ আইন-উপদেষ্টার মতামতকে সাংবিধানিক অস্ত্র করে রাজেন্দ্রপ্রসাদকে পরাস্ত করেন। তার পর ’৫২ এবং ’৫৭ সালের দুটো ভোটে মানুষের সমর্থন নিয়ে তিনি তাঁর কর্তৃত্বকে সংসদীয় গণতন্ত্রকে নব্য ভারতীয় কাঠামোয় সুপ্রতিষ্ঠিত করেন। পরবর্তীকালে বহু বিশেষজ্ঞ নাম দিয়েছেন, এ হল ‘নেহরুভিয়ান প্রেসিডেন্সি’।

আসলে সংবিধানে রাষ্ট্রপতির ক্ষমতায় বেশ কিছু জায়গা আছে যার ভিত্তিতে প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতাকেও চ্যালেঞ্জ করতে পারেন রাষ্ট্রপতি। এটা বুঝেই ৭৪ নম্বর অনুচ্ছেদের উপর ৪২ এবং ৪৪তম সংশোধনী আনেন ইন্দিরা গাঁধী। নেহরু যে ওয়েবস্টার মডেলের উত্তরাধিকারী হতে চান, পরবর্তীকালে সেই পথ ধরেই ক্যাবিনেটের দড়ি দিয়ে আরও ভাল করে বেঁধে দেওয়া হল রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা। লন্ডনে জন্ম, মার্কিন রাজনীতি-বিজ্ঞানী ডগলাস ভার্নে বলেছিলেন, রাষ্ট্রপতি রাষ্ট্রের প্রধান, প্রধানমন্ত্রী সরকারের প্রধান। চাইলে ব্রিটেনের রানিও তাঁর ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারেন। ভারতেও সরকার বেশ কয়েক বার সংখ্যালঘু হওয়ায় রাষ্ট্রপতির ভূমিকা নিয়ে বিতর্ক হয়েছে। ১৮৮৫ সালে ব্রিটিশ পার্লামেন্টেও সরকার গঠনে রানির ভূমিকা নিয়ে প্রবল বিতর্ক হয়। সংখ্যালঘু সরকারের প্রধানমন্ত্রী লর্ড সলসবেরি রানি ভিক্টোরিয়াকে বলেছিলেন, ‘আপনি সার্বভৌম অধীশ্বর। যার যোগ্যতায় আপনি সন্তুষ্ট হবেন তাঁকেই প্রধানমন্ত্রী করবেন।’ রানি সে বার সলসবেরির পক্ষে রায় দেন।

ব্রিটিশ নাট্যকার পিটার মর্গ্যানের জনপ্রিয় নাটক ‘দ্য অডিয়েন্স’ রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের সঙ্গে ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রীদের সাপ্তাহিক বৈঠকের উপরেই নির্মিত হয়। সেখানে রানির সঙ্গে মার্গারেট থ্যাচারের কথোপকথনে দেখানো হয় যে প্রধানমন্ত্রীকে রানি বলছেন, আপনার সমস্ত গোপন কথা আমাকে বলতে পারেন। যা আপনি আপনার ‘নম্বর টু’কেও বলতে পারেন না, তা-ও বলতে পারেন। আমি একটি ‘সাউন্ডিং বক্স’-এর মতো। রানি পরামর্শও দিতেন। কিন্তু রানির সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর সে সব বৈঠকের কোনও মিনিটস থাকত না। কোনও ব্যক্তিগত সচিবও থাকতেন না। বহু ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীকে সাবধান করেছেন রানি। এমনকী, টনি ব্লেয়ারের সময়ও। মার্গারেট থ্যাচার তাঁর আত্মজীবনীতেও লিখে গিয়েছেন রানির কোনও ভূমিকাই নেই, যাঁরা ভাবেন আসলে তাঁরা ভুল।

২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদীর অভূতপূর্ব সংখ্যাগরিষ্ঠতা, প্রণববাবুকে অন্তত এ ধরনের বিতর্ক থেকে রক্ষা করেছে। কিন্তু গত পাঁচ বছরে বেশ কিছু বিষয়ে তাঁর সঙ্গে সরকার বা মোদীর মতপার্থক্য হয়েছে। কিন্তু তা গোপনেই থেকেছে।

ক’জন জানেন, কাশ্মীরে সেনাকে মানবঢাল হিসেবে ব্যবহার করায় প্রণববাবু ক্ষুব্ধ হন? তিনি মনে করেন, সেনাবাহিনীর প্রধান কাজ সীমান্তে থেকে দেশের সুরক্ষা। উপত্যকায় দেশের আইনশৃঙ্খলা সামলানো নয়। সে দিন প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের এক শীর্ষ সেনা অফিসার বলেছিলেন, মশাই, আপনি কি জানেন, প্রণববাবু সেনাকর্তাদের ডেকে কাশ্মীর হ্যান্ডলিং নিয়ে তাঁর অসন্তোষ জানিয়ে কিছু পরামর্শ দিয়েছিলেন সরকারকে। প্রণববাবু কথায় কথায় ফাইল ফেরত পাঠিয়ে সংবাদমাধ্যমে কোনও নাটকীয় প্রচারের পথে যাননি। কিন্তু তিনি বহু ফাইল নিয়ে সরকারের সঙ্গে ভিন্ন মত পোষণ করেছেন। আলোচনা করে সরকারের সিদ্ধান্ত বদলানোর চেষ্টা করেছেন। তিনি কখনও দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অপসারণ নিয়ে সরকারের সঙ্গে সঙ্ঘাতে গিয়েছেন। আবার সংসদ এড়িয়ে অর্ডিন্যান্সে সই করতে রাজি হননি। অনেক মৃত্যুদণ্ডে রাষ্ট্রপতির সম্মতির জন্য প্রণববাবুর সমালোচনা হয়েছে। কিন্তু অনেকেই জানেন না, মৃত্যুদণ্ডের সিদ্ধান্ত আদালতের বিভিন্ন রায়ের ভিত্তিতে মন্ত্রিসভায় গৃহীত হয়। বিচারবিভাগীয় এক দীর্ঘ প্রক্রিয়াও থাকে। রাষ্ট্রপতি তা অবজ্ঞা করতে পারেন না। আবার সরকার যত সংখ্যায় মৃত্যুদণ্ডের নির্দেশ পাঠায় তার মধ্যে বেশ কিছু ক্ষেত্রে আইনি সংশয় থাকলে প্রণববাবু তা ফেরতও পাঠিয়েছেন।

কালামের মতো রাষ্ট্রপতি অনেক সময় ফাইল ফেরত পাঠিয়ে তাঁর মিডিয়া উপদেষ্টার মাধ্যমে সংবাদমাধ্যমে জানিয়ে নিজেকে ‘বিক্ষুব্ধ জনগণের রাষ্ট্রপতি’র ভাবমূর্তি প্রতিষ্ঠায় সক্রিয় হন। কিন্তু কালামের ফেরত পাঠানো সেই সব ফাইল ক্যাবিনেট আবার ফেরত পাঠালে তিনি সই করতে বাধ্য হন। সে কথা কিন্তু খবর হয়নি। কালামের স্টাইলে প্রণববাবু ‘রাগী রাষ্ট্রপতি’র ভাবমূর্তি তৈরি করতে চাননি মিডিয়ার মাধ্যমে। আবার ‘টেক্সটবুকম্যান’ প্রণববাবু প্রশ্নহীন আনুগত্যও দেখাননি প্রতিভা পাতিলের মতো।

আরও পড়ুন: গ্রাম থেকে রাইসিনা হিলে যাত্রা শুরু সাদামাটা, মৃদুভাষী মানুষটির

তিনি সাংবিধানিক সীমার মধ্যে থেকেও মোক্ষম কামড় দিয়েছেন। সংসদের মধ্যরাতের অনুষ্ঠানে বলতে ছাড়েননি, কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী থাকাকালীন আইনের খসড়া তাঁরই করা। গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী সে সময়ে বিলের বিরোধিতা করেছিলেন। গোটা দেশে যে রাজনৈতিক অসহিষ্ণুতার আবহ তৈরি হয়েছে, চাণক্যের বুদ্ধিতে বার বার সেই প্রশ্নে তিনি আঘাত হানছেন। তাই অতীতে রাষ্ট্রপতিদের মধ্যে কে কতখানি পালন করেছেন তার পর্যালোচনা করলে বোঝা যায়, প্রণববাবু নিজে সক্রিয় রাজনীতিক জীবনের পর রাষ্ট্রপতির জীবনে গেলেও কখনও ন্যক্কারজনক ভাবে সঙ্কীর্ণ রাজনীতিতে অংশ নেননি। বরং সযত্নে নিজেকে অসাংবিধানিক রাজনীতি থেকে দূরে রাখতে সক্ষম হন।

ভারতীয় সাংবিধানিক গণতন্ত্রে রাষ্ট্রপতিরও একটি পরিসর আছে। প্রণববাবুর পাঁচ বছরের কার্যকাল দেখে সেটা বুঝলাম। গণতন্ত্রে এই ‘চেক অ্যান্ড ব্যালান্স’ সর্বদাই প্রয়োজনীয়। ইউপিএ জমানায় প্রতিভা পাতিলকে মনোনীত করে কংগ্রেস যে ভুল করেছিল, আজ রামনাথ কোবিন্দকে মনোনীত করে বিজেপি সেই একই ভুল করল। প্রণববাবু তাঁর মেধা, বুদ্ধি এবং দীর্ঘ রাজনৈতিক অভিজ্ঞতার মাধ্যমে রাষ্ট্রপতি পদের গৌরব বৃদ্ধি করেছেন। রাষ্ট্রপতি ভবনের এই সাংবিধানিক মর্যাদাটুকু রক্ষা করা বিশেষ প্রয়োজন। গণতন্ত্রের স্বার্থেই। ভয় হচ্ছে, আবার রাষ্ট্রপতি ভবন প্রধানমন্ত্রী ও বিজেপির একটি শাখা অফিসে পরিণত না হয়।

কাঠমান্ডুতে নেপালের প্রধানমন্ত্রী পুষ্প কমল দাহালের (প্রচন্ড) সঙ্গে প্রণব মুখোপাধ্যায়

রাষ্ট্রপতি হিসেবে তাই তিনি নিজের সাংবিধানিক চৌহদ্দির মধ্যে থেকেও এক নিরপেক্ষ চরিত্র। আমি নাম দেব, তিনি এক সৃজনশীল রাষ্ট্রপতি। মার্কসীয় দ্বন্দ্ববাদী দর্শনে বলে, বস্তু থেকেই ভাবনা উৎসারিত, কিন্তু সেই ভাবনা বা নিজস্বতার কিছু নিজস্ব পরিসর তৈরি হয়। সেই পরিসরটি হল, সৃজনশীল পরিসর। সামগ্রিক ভাবে ‘আইডিয়া’ বস্তু থেকেই সম্পূর্ণ উৎসারিত। অতএব, তার কোনও নিজস্ব পরিসর নেই, এ কথা যাঁরা বলেন তাঁরাই ‘ডিটারমিনিজিম’ বা নির্দেশ্যবাদের দ্বারা আক্রান্ত। প্রণববাবুর রাষ্ট্রপতি পদের সাংবিধানিক পরিসরটুকুও এ রকমই। এই ধূসর এলাকায় সাংবিধানিক সায়ত্ত্বশাসনও আছে। হতে পারে, রানির মতো রাষ্ট্রপতির কোনও প্রিভি কাউন্সিল নেই, কিন্তু রাষ্ট্রপতিও আইনি পরামর্শ গ্রহণের জন্য সরাসরি সুপ্রিম কোর্টের সাহায্য নিতে পারেন। ‘অক্সফোর্ড বুক অফ ইন্ডিয়ান কনস্টিটিউশন’-এ রাষ্ট্রপতির এই ক্ষমতাকে বলা হয়েছে ‘ডিসক্রিসনারি পাওয়ার’।

প্রণববাবুর রাজনৈতিক চরিত্রের প্রধান বৈশিষ্ট্য হল তিনি সারা জীবন ধরে এক জন সফল ‘ব্যাকরুম বয়’। বলা যায়, সারা জীবন তিনি ‘ব্যাক সিট ড্রাইভিং’ করেছেন। বলা যেতে পারে, তিনি যেন নাট্যমঞ্চের ‘গ্রিনরুম ম্যান’, নাটক বা ফিল্মের প্রযোজকের ভূমিকায়। তিনি নায়ক নন। কিন্তু অন্যতম ‘প্রোডিউসার অফ দ্য শো’। আর এই কমিটিতে সফল হওয়ার জন্য তাঁর চরিত্রে প্রধান গুণ ছিল, তিনি চিরকাল সকলকে ‘অন বোর্ড’ নিয়ে চলতে চেয়েছেন। তা সে লালুপ্রসাদ যাদবই হোন বা লালকৃষ্ণ আডবাণী। তিনি ‘প্লুরালিস্ট’, তিনি ‘ম্যান অফ গ্রেট কনসেন্সাস’। ভারতীয় রাজনীতিতে সর্বসম্মতিতে তৈরি রাজনীতির তিনি অন্যতম জনক। এই একটা বৈশিষ্ট্যের জন্য পরমাণু চুক্তির সময় মনমোহন সিংহের আমলেও প্রকাশ কারাট ও সীতারাম ইয়েচুরির সঙ্গে আলোচনায় বিবাদ মেটানোর দায়িত্বও পালন করেছিলেন প্রণববাবু। আক্রমণাত্ম বিজেপিকে ঠান্ডা করার জন্য কংগ্রেস জমানায় প্রণববাবুকেই মধ্যস্থতার দায়িত্ব দিতেন সনিয়া।

আরও পড়ুন: রাজনীতির দাবা বারে বারে ঘুঁটি সাজিয়েছে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে

অনেকে অবশ্য বলেন, সকলকে নিয়ে চলার জন্য প্রণববাবুর মধ্যে ঐকমত্যের মানসিকতা রয়েছে। এর পাশাপাশি অন্য আর একটি কথাও অনেকে বলেন। সেটা হল, রাজনীতিতে প্রধান কাণ্ডারী হতে গেলে সকলের সঙ্গে মধ্যস্থতা করে শুধু ম্যানেজ করাটাই কিন্তু রাজনীতির সব থেকে বড় কৃতিত্ব নয়। বরং নেতা এমন হবেন যে তিনি স্বীয় সিদ্ধান্ত নেবেন নিজের বিচারের ভিত্তিতে। ইহাও ভাল, উহাও ভাল— এ ভাবে ভিতরে ভিতরে সঙ্ঘাত এড়ানো যায়। কিন্তু অফিসের বস, এমনকী, বাড়ির অভিভাবককেও অনেক সময়েই সাহসিকতার সঙ্গে কিছু সিদ্ধান্ত নিতে হয়। তাতে রাজনৈতিক ঝুঁকি থাকে, জনপ্রিয়তা হারানোর প্রবল আশঙ্কাও থাকে। যদি সেই প্রবল উজ্জ্বল ক্যারিশমা থাকে, তবে সেই গ্রহণযোগ্যতার শক্তিতে দলীয় কর্মী বা দেশের মানুষের কাছে তিনি সেই রিস্ক বা ঝুঁকি নিতে পারেন।

প্রণববাবুকে ব্যক্তিগত ভাবে এ ব্যাপারে চিহ্নিত করব না। কিন্তু বলুন তো, ভারতের রাজনীতিতে এমন এক জন নেতা আজ কোথায়? গাঁধীজি ছিলেন। তিনি নিজেই ঘটনার জন্ম দিতে পারতেন। আজ কোন নেতার সেই কর্তৃত্ব আছে?

প্রধানমন্ত্রী হতে গেলে এই ‘ডোন্ট কেয়ার’ মানসিকতা থাকার প্রয়োজনীয়তা আছে। তাতে অনেক সময় গণতন্ত্র আপাত ভাবে বিঘ্নিত হলেও, আছে। কিন্তু রাষ্ট্রপতির ক্ষেত্রে সকলকে নিয়ে চলার এই ঐকমত্য রচনার মানবিক গুণটি সাংবিধানিক প্রধানের ভূমিকার সঙ্গে দারুণ ভাবে যুক্ত হয়। প্রণববাবু তাই তাঁর ব্যাকরুমের গুণের বলে বলীয়ান হয়ে পাঁচ বছরে এক সফল রাষ্ট্রপতির পরিসর ভারতীয় গণতন্ত্রে প্রতিষ্ঠা করেছেন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE