পুলওয়ামায় জঙ্গি হামলার কিছু ক্ষণের মধ্যেই আধ কোটি সার্চ!
তার পরে যত দিন গিয়েছে, গুগ্ল ট্রেন্ডে এক এবং একমাত্র জায়গা করে নিয়েছে পুলওয়ামা। সারা দেশে ‘সার্চ’ করার ক্ষেত্রে প্রথম দশটি স্থানে একাধিকবার উঠে এসেছে ওই হামলার প্রসঙ্গ। কখনও সেই ‘সার্চ’ হয়েছে পুলওয়ামায় হামলার ছবি নিয়ে, কখনও জইশ-ই-মহম্মদের মাসুদ আজহারকে নিয়ে, কখনও আবার পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানকে নিয়ে। গুগ্ল-এ ‘বেস্ট টয়লেট পেপার ইন দ্য ওয়ার্ল্ড’ লিখে সার্চ করলে প্রতিবেশী এক রাষ্ট্রের জাতীয় পতাকার ছবির ছড়াছড়ি সোমবার পর্যন্ত! গত দু’দিন সার্চের প্রথম দিকে ছিল সিআরপিএফ। বাদ পড়েনি মোমবাতি মিছিল সংক্রান্ত তথ্যও।
কিন্তু অনেকেই উদ্বেগ প্রকাশ করছেন এটা ভেবে যে, এই ক্ষোভ তো শুধু আর ফেসবুকের চৌহদ্দির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকছে না। তা আছড়ে পড়ছে বাড়িতে, রাস্তায়। কারও মতের সঙ্গে না মিললে, বা কোনও পোস্ট পছন্দ না হলে দল বেঁধে চড়াও হওয়ার প্রবণতা দেখা দিচ্ছে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির বাড়িতে। পুলিশে অভিযোগ দায়ের করা হচ্ছে, চলছে ভাঙচুর। এমনকি, প্রাণনাশের হুমকিও বাদ যাচ্ছে না। এ যেন অন্য এক জরুরি অবস্থা, বলছেন অনেকে।
আসলে ইন্টারনেট, আরও স্পষ্ট ভাবে বলতে গেলে সোশ্যাল মিডিয়াই পাল্টে দিয়েছে দেশভাগের সময়ের অশান্তি বা ১৯৯২ সালের ডিসেম্বর মাসের অস্থির সময়ের অশান্তির সঙ্গে এখনকার অশান্তির ধরন। তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞদের একটা বড় অংশই বলছেন, ফেসবুকের পোস্ট এখন লিফলেটের মতো কাজ করছে। অতীতে অশান্তি ছড়ানোর জন্য যে ভাবে গোপনে লিফলেট বিলি করা হতো বা মুখে-মুখে ছড়িয়ে দেওয়া হতো কোনও কথা, সেটাই এখন ফেসবুক বা হোয়াটসঅ্যাপ-এর পোস্ট বা ভিডিয়োর মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ছে নিমেষে। ফেসবুক বা সোশ্যাল মিডিয়া ‘কম্প্রোমাইজড’ হচ্ছে, বলছেন তাঁরা। আগেও দাঙ্গার সময়ে গুজব ছড়াত। কোনও ঘটনা হয়তো ঘটেইনি, অথচ তা নিয়ে শুরু হয়ে যেত হাঙ্গামা। কিন্তু আগে গুজব ছড়াতে যেখানে ১০ দিন সময় লাগত, এখন সেখানে লাগছে কয়েকটি মুহূর্ত মাত্র।
আরও পড়ুন: পুলওয়ামায় জঙ্গি হামলার চার দিন পরে হত জইশের শীর্ষ নেতা কামরান
তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞেরা জানাচ্ছেন, সাধারণত ধরে নেওয়া হয় যে ফেসবুকে যাঁরা সার্চ করেছেন, তাঁদের সিংহভাগেরই ফেসবুক বা অন্য কোনও সোশ্যাল মিডিয়ায় নিজস্ব অ্যাকাউন্ট রয়েছে। তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ কল্পদীপ বসু বলেন, ‘‘১৪ তারিখ থেকে সোমবার পর্যন্ত গুগ্ল ট্রেন্ডের তথ্য বলছে, সব সময়েই সার্চ লিস্টের শীর্ষে রয়েছে পুলওয়ামা সংক্রান্ত খবর। বিভিন্ন কি-ওয়ার্ড দিয়ে সার্চ করা হয়েছে এই ঘটনা।’’ আর তার পরেই ‘ডিজিটাল লিফলেট’-এর আকারে তা ছড়িয়ে পড়ছে দ্রুত, নিমেষে। কারও ভিন্ন মতের পোস্ট দেখলেই সামাজিক ভাবে তাঁকে একঘরে করা হচ্ছে। বাড়িতে-বাড়িতে হামলা পর্যন্ত চলছে। অসহিষ্ণুতা এমন পর্যায়ে গিয়েছে যে একে অনেকে ‘ফেসবুক-হাঙ্গামা’ও বলছেন। গুজবের ফলে গণপিটুনি, অশান্তি ও তার চরিত্র কী ভাবে পাল্টেছে সে সম্পর্কে বলতে গিয়ে সমাজতত্ত্বের শিক্ষক শমিত কর বলেন, ‘‘সোশ্যাল মিডিয়া অসহিষ্ণুতার মাত্রা কয়েকগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। কোনও কিছু প্রমাণ করার দায় নেই, যাকে সহ্য হচ্ছে না, তাকেই শত্রু হিসেবে দাগিয়ে দিয়ে চড়াও হওয়ার ছাড়পত্র মিলে যাচ্ছে সোশ্যাল মিডিয়ায়। এই প্রবণতা ভয়ঙ্কর।’’
‘বেস্ট টয়লেট পেপার’ লিখে প্রতিবেশী এক দেশের জাতীয় পতাকার ছবি দিয়েছিলেন এক পরিচিত। তা দেখে তীব্র প্রতিবাদ করেন প্রাক্তন পুলিশ কমিশনার প্রসূন মুখোপাধ্যায়। তিনি জানাচ্ছেন, সব থেকে আশ্চর্যের বিষয় হল, কেউ ফেসবুক বা হোয়াটসঅ্যাপের খবর যাচাই করছেন না। সেটাই একমাত্র সত্যি বলে ঝাঁপিয়ে পড়ছেন। প্রসূনবাবুর আরও সতর্কতা, ‘‘১৯৯২ সালের অস্থিরতা বা ওই ধরনের কোনও হাঙ্গামার অভিজ্ঞতা কিন্তু এখন যাঁরা পুলিশে রয়েছেন, তাঁদের অনেকেরই নেই। এই ধরনের ঘটনা এত আচমকা হয় যে বোঝাই যায় না। এখনই এ ব্যাপারে সতর্ক না হলে পরিস্থিতি ভয়াবহ হতে পারে।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy