রাকেশ মারিয়া। ছবি: পিটিআই।
আইপিএস। আইপিএস। আইপিএস।
ইউনিয়ন পাবলিক সার্ভিস কমিশন (ইউপিএসসি)-এর ফর্মে একই শব্দ তিন বার লিখেছিলেন সেন্ট জেভিয়ার্সের প্রাক্তনী রাকেশ মারিয়া। সেটা ১৯৮১। সদ্য স্নাতক রাকেশ ভারতীয় পুলিশ সার্ভিসে যোগ দেবেন বলে ইপিএসসি পরীক্ষা দিয়েছেন। নিয়ম অনুযায়ী ফল বেরোনোর পর ইপিএসসিকে জানাতে হয় চাকরি প্রার্থী কোন সার্ভিসে যোগ দেবেন। আইএএস, আইএফএস, আইপিএস-সহ একাধিক বিকল্প থাকে সেই ফর্মে। নিজের পছন্দের তিনটি ক্রম লিখে জানানোর সেই ফর্মে রাকেশ একটি শব্দই তিন বার লিখেছিলেন, আইপিএস। কারণ? পুলিশ বাহিনীর মর্যাদা এবং অনুশাসন ছাত্রাবস্থা থেকেই তাঁকে অনুপ্রাণীত করে যে!
ওই বছরেই তিনি অ্যাসিস্ট্যান্ট পুলিশ সুপার হিসেবে কাজে যোগ দেন আকোলায়। দীর্ঘ সাড়ে তিন দশকেরও বেশি চাকরি জীবনে সেই প্রথম পোস্টিং-এ সহকর্মীদের কথা ভোলেননি রাকেশ। বিভিন্ন সময়ে সেই সব কনস্টেবলের কথা বলেছেন, যাঁরা তাঁকে রাতের টহলদারি গাড়িতে নিয়ে বেরোতেন। যাঁদের কাছে তিনি প্রথম কাজ শিখেছিলেন।
সেই শুরু। তার পর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি রাকেশকে। তিনিও দৌড়েছেন। আর তাঁর পেছনে দৌড়েছে বিতর্কও। গোটা চাকরি জীবনে বিতর্ক যেমন তাঁর পিছু ছাড়েনি, তেমনই একের পর এক সাফল্যেরও মুখ দেখেছেন বর্ষীয়ান এই পুলিশ কর্তা।
অথচ, পুলিশের চাকরিতে আসার কোনও কারণ ছিল না রাকেশের। তাঁর বাবা ছিলেন বলিউডের ডাকসাইটে চলচ্চিত্র প্রযোজক। কিন্তু, ছোটবেলা থেকে চলচ্চিত্র জগত্ তাঁকে তেমন একটা টানত না। কাজেই পারিবারিক সেই পরিমণ্ডল থেকে বেরিয়ে এসেছিলেন রাকেশ। মহারাষ্ট্র ক্যাডারের এই পুলিশ অফিসার ১৯৮৬তে মুম্বই শহরে আসেন। মূলত ট্র্যাফিক সামলানোয় পটু রাকেশ উপর মহলের নজর কাড়েন ১৯৯৩তে। ওই বছর মুম্বইয়ে ধারাবাহিক বিস্ফোরণে প্রাণ হারিয়েছিলেন ২৫৭ জন। আহত হয়েছিলেন প্রচুর। সেই মামলায় তদন্তকারীদের দলে ছিলেন রাকেশ মারিয়া। আর এই বিস্ফোরণই পাল্টে দিল তাঁর জীবন।
সেই থেকেই রাত জেগে মুম্বইয়ের রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়ানোর শুরু। ব্যক্তিগত সোর্সের সংখ্যা এত ছিল যে, তাদের দিয়ে একটা গোটা ব্যাটেলিয়ন বানানো যেতে পারত। সেই থেকেই তিনি মুম্বইয়ের অলিগলি নিজের হাতের তালুর মতো চেনেন। এই সময়েই তাঁর কাছে খবর আসে, অভিনেতা সঞ্জয় দত্ত বাড়িতে বেআইনি অস্ত্র রেখেছেন। দিনের পর দিন জেরা করে, সঞ্জয়কে দিয়ে রাকেশ কবুল করিয়েছিলেন তাঁর অপরাধের কথা। এমনকী, একে ৪৭ রাখার কথাও স্বীকার করেছিলেন সঞ্জয়। পুলিশ মহলের দেওয়ালে কান পাতলে একটা কথা শোনা যায়, সঞ্জয়য়ের অপরাধ কবুল করাতে তাঁর চুলের মুঠি ধরে চেয়ার থেকে তুলে তাঁকে মারধর করেছিলেন এই রাকেশই।
স্বল্পভাষী এবং শান্ত স্বভাবের রাকেশ যদিও মনে করেন, সাফল্যের সঙ্গেই আসে বিতর্ক। ২০০৩-এ রাকেশ প্রথম বড়সড় বিতর্কে জড়ালেন। ক্রিকেট বেটিং চক্রে তাঁর নাম জড়িয়ে পড়ে। সেই বিতর্কেও সেই বিতর্ক মুছে যেতে না যেতেই ফের তাঁর বিরুদ্ধে এক ভয়াবহ অভিযোগ ওঠে। মুম্বইয়ের একটি ধর্মস্থানে বিস্ফোরণের হুঁশিয়ারি জানানো হয় মারিয়ার মেল আইডি থেকে। পরে যদিও প্রমাণিত হয়, মেলটি রাকেশের আইডি থেকে ইন্সপেক্টর পদমর্যাদার অন্য এক পুলিশকর্মী করেছিলেন। যদিও এই ঘটনা প্রমাণ হওয়ার আগে রাকেশকে কম মর্যাদার বেশ কয়েকটি পদে কাজ করতে হয়। এর পর ২০০৭-এ মুম্বইয়ের যুগ্ম পুলিশ কমিশনার (অপরাধ দমন) হিসেবে নিয়োগ করা হয়।
ইন্ডিয়ান মুজাহিদিনের একটি বড়সড় মডিউলের হদিশও দেন এই পুলিশ কর্তা। ২০০৫ থেকে ভারতের বিভিন্ন জায়গায় অনেকগুলি বিস্ফোরণ হয়। তার সঙ্গে যে এই গোষ্ঠীর যোগাযোগ ছিল, তা প্রমাণ করেন রাকেশ। গাড়িচুরির সূত্র ধরে মোট ২২ জন মুজাহিদিনকে গ্রেফতার করেছিলেন রাকেশ।
এর পরই ২০০৮-এর ২৬ নভেম্বর সন্ত্রাসবাদী হামলার শিকার হয় মুম্বই। তারও তদন্ত ভার হাতে পেয়েছিলেন রাকেশ। তাঁরই নেতৃত্বে আসমল কাসভ মুম্বই পুলিশের হাতে ধরা পড়ে। কিন্তু, এখানেও বিতর্ক। ওই ঘটনায় নিহত পুলিশ আধিকারিক অশোক কামতের স্ত্রী রাকেশের বিরুদ্ধে কর্তব্যে গাফিলতির অভিযোগ আনেন। ফের বদলি করা হয় রাকেশকে। এডিজি (এটিএস) হিসেবে পুণে জার্মান বেকারি মামলা, মুম্বইয়ে ১৩/৭-এর ধারাবাহিক বিস্ফোরণ এবং পুণের জঙ্গলি মহারাজ রোডের বিস্ফোরণ নিয়ে তদন্ত করেন।
যে ললিত মোদী কাণ্ডে গোটা দেশ সম্প্রতি উত্তাল হয়, লন্ডনে গিয়ে সেই মোদীর সঙ্গেও দেখা করেন মারিয়া।
মুন্বইয়ের পুলিশ কমিশনার হিসেবে সম্প্রতি গোটা দেশে সাড়া ফেলে দিয়েছিলেন রাকেশ। শিনা বরা হত্যা মামলায় যে ভাবে তত্পরতার সঙ্গে তাঁর নেতৃত্বে কাজ করছিল মুম্বই পুলিশ, তাতে অনেকেই মনে করছিলেন ফের না কোনও নতুন বিতর্কে জড়িয়ে পড়েন ৫৮ বছর বয়সী এই পুলিশ কর্তা। শেষমেশ তিনি বিতর্কে না জড়ালেও, তাঁকে পুলিশ কমিশনার পদ থেকে তড়িঘড়ি সরিয়ে দিয়ে এ বার বিতর্কে জড়াল খোদ মহারাষ্ট্র প্রশাসন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy