প্রতি বছর ৭ ফেব্রুয়ারি প্রকাশ কারাট ও তিনি একে অপরকে ‘হ্যাপি বার্থডে’-র শুভেচ্ছা জানান। দু’জনেরই জন্ম একই মাসের একই দিনে। বছরটা আলাদা। প্রকাশ কারাটের থেকে তিনি ঠিক দশ বছরের বড়।
কারাট ক্রাইম ফিকশনের ভক্ত। তিনি থ্রিলারের। ইদানীং মজেছেন চেতন ভগতে। ‘হাফ গার্লফ্রেন্ড’ ছাড়া বাকি সব ক’টা উপন্যাস পড়ে ফেলেছেন।
সাতাত্তর বছর বয়সেও নিয়মিত এক ঘন্টা সাঁতার কাটেন দিল্লির কনস্টিটিউশন ক্লাবের সুইমিং পুলে। সাঁতার না কাটলে ‘মর্নিং ওয়াক’ করে পুষিয়ে নেন।
দিল্লিতে থাকলে রোজ নিয়ম করে সকাল আটটায় পার্টির সদর দফতরে আসেন। কাজকর্ম সেরে বেরোন রাত আটটায়।
এ কে গোপালন ভবনের বাইরের জগতে, দিল্লির অভিজাত মহলে, সংবাদমাধ্যমে বা আমজনতার কাছেও সীতারাম ইয়েচুরি ঠিক যতখানি পরিচিত মুখ, ততটাই অপরিচিত এস রামচন্দ্রন পিল্লাই। ওরফে ‘এসআরপি’। কিন্তু প্রকাশ কারাটের পর সাধারণ সম্পাদক হওয়ার পথে সীতারামের সামনে রামচন্দ্রনই সব থেকে বড় বাধা। শুধু বাধা বললে ভুল হবে। ইয়েচুরির মতো তিনিও সাধারণ সম্পাদক পদের প্রবল দাবিদার।
সিপিএমের একাংশ মনে করে, ইয়েচুরি শীর্ষপদে এলে দলে খোলা হাওয়া আসবে। বস্তাপচা ধ্যানধারণা থেকে মুক্তি মিলবে। রাজনৈতিক রণনীতিতেও সিপিএম অনেক বেশি বাস্তবমুখী হবে। কিন্তু আর একটা অংশ মনে করে, পার্টির এখন সবকিছু ভুলে নিজের সাংগঠনিক শক্তি, জনসমর্থনের ভিত বাড়ানো উচিত। সাধারণ মানুষের সমস্যা নিয়ে আন্দোলনে নজর দেওয়া উচিত। সে কাজে এসআরপি অনেক বেশি নির্ভরযোগ্য। কারণ তিনি একেবারে দলের নিচু তলা থেকে কাজ করে পলিটব্যুরোয় উঠে এসেছেন। সিপিএম এখন যে কংগ্রেস বা আঞ্চলিক দলের সঙ্গে আঁতাঁতে না গিয়ে শুধুই বামদল ও সংগঠনগুলিকে নিয়ে আন্দোলনের পথে যেতে চাইছে, এসআরপি সেই পথেরই প্রবক্তা।
দলের সামনে যে কঠিন চ্যালেঞ্জ, তা নিয়ে এসআরপি-র মনে কোনও সংশয় নেই। তাঁর স্পষ্ট কথা, ‘‘দল সব রাজ্যে সমান ভাবে বাড়েনি। তার মধ্যেই আমরা পশ্চিমবঙ্গে বড় ধাক্কা খেয়েছি। দলের শক্তি এখন বাড়ছে না। কমছে। কেন বাড়ছে না, সেই প্রশ্নই ধাক্কা দিচ্ছে।’’ এসআরপি মনে করেন, ‘‘এ নিয়ে ১৯৭৮ সালে সালকিয়া প্লেনাম হয়েছিল। সেই প্লেনামের সিদ্ধান্ত রূপায়ণ করেও তিন রাজ্যের বাইরে দলের শক্তি বাড়েনি।’’ তাঁর মতে, এর মধ্যেই ক্রমশ জটিল হচ্ছে পরিস্থিতি। সিপিএম শ্রমিক বা কৃষকদের নিয়ে আন্দোলন করতে চাইলেও অন্য দল জাতপাতের ভিত্তিতে ভেদাভেদ তৈরি করেছে। আর্থিক সংস্কারের ফলে মানুষের উচ্চাশা তৈরি হয়েছে, সেখানে সিপিএম সাড়া দিতে পারছে কি
না, সেই প্রশ্ন উঠেছে। আর তরুণ প্রজন্মের কাছে দলের মতাদর্শকে আকর্ষণীয় করে পেশ করা কঠিন চ্যালেঞ্জ হয়ে গিয়েছে।
এসআরপি কি এই কঠিন দায়িত্ব সামলাতে পারবেন?
তাঁর ঘনিষ্ঠ শিবির বলছে, প্রবীণ নেতার ঝুলিতে অভিজ্ঞতা অফুরন্ত। ১৯৮৯ সালে কারাট, ইয়েচুরি ও এসআরপি তিন জনে একই সঙ্গে কেন্দ্রীয় সম্পাদকমণ্ডলীতে এসেছিলেন। কিন্তু তার আগে এসআরপি ব্রাঞ্চ সেক্রেটারি, এরিয়া কমিটি, জেলা কমিটি, জেলা সম্পাদক, রাজ্য কমিটি, রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলী—সব স্তরেই কাজ করেছেন। দীর্ঘদিন কেরলের কায়ামকুলান পুরসভার কাউন্সিলর ছিলেন। রাজ্যসভাতেও ছিলেন টানা দশ বছর। বহু বছর কৃষক সভার সাধারণ সম্পাদক ও সভাপতি হিসেবে কাজ করেছেন। এসআরপি নিজেও বিশ্বাস করেন, ‘‘দলের প্রত্যেক সদস্যের গণ সংগঠনে কাজ করা উচিত।’’
এসআরপি-র বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি ভাল হিন্দি বলতে পারেন না। গোটা দলে অপেক্ষাকৃত নবীনদের নিয়ে আসার প্রক্রিয়া চলছে। অথচ একেবারে শীর্ষপদে বর্তমান সাধারণ সম্পাদকের থেকে দশ বছরের বড় কেউ বসলে ভুল বার্তা যাবে। অঙ্ক বলছে, এসআরপি-কে সাধারণ সম্পাদক হতে হলে তাঁর নিজের রাজ্য কেরল তো বটেই, তামিলনাড়ু, অন্ধ্রের মতো রাজ্য নেতৃত্বের সমর্থন পেতে হবে। যদি কেরলের ভোটে ইয়েচুরি ভাগ বসান, তা হলে এসআরপি-কেও বাংলার নেতাদের (যার সিংহভাগই ইয়েচুরির দিকে যাবে বলে মনে করা হয়) ভোটে ভাগ বসাতে হবে। প্রকাশ কারাট কী করবেন, সেটাই বড় প্রশ্ন। কেননা, কেন্দ্রীয় কমিটিতে আজও প্রকাশেরই জোর। নতুন কেন্দ্রীয় কমিটি গঠন হলেও এই সমীকরণ উল্টে যাওয়ার সম্ভাবনা নেই।
কারাট নিজেও আজ এই ‘সাসপেন্স’ ধরে রাখতে চেয়েছেন। ইয়েচুরিই সাধারণ সম্পাদক হবেন কি না--প্রশ্নের উত্তরে শুধু বলেছেন, ‘‘পার্টি কংগ্রেসের শেষ দিনে এর উত্তর পাবেন।’’ স্বভাবরসিক এসআরপি এ সব প্রশ্ন শুনলেই উড়িয়ে দিচ্ছেন। হাসতে হাসতে তাঁর জবাব, ‘‘মিডিয়ার নজর টানতে আমরাই এ সব সাসপেন্স তৈরি করছি!’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy