Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

থমথমে ডিমাপুরে নামল সেনা, চলছে কার্ফুও

সারা বছরের চেনা শান্ত ডিমাপুর চেনে না এই উন্মত্ত ডিমাপুরকে। শহরের পথে ক্ষিপ্ত জনতা ছুটছে জেলের দিকে। ঠেকানোর সাহস পাচ্ছে না পুলিশও। জেল থেকে তারা ছিনিয়ে আনল এক যুবককে। এর পর শুরু তাণ্ডব। ওই যুবককে নগ্ন করে চলছে গণপিটুনি। মোটরবাইকের পিছনে বেঁধে হিঁচড়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে পিচরাস্তা দিয়ে। পিছনে ছুটছে নানা বয়সের এক দল মানুষ। এর পর রক্তাক্ত যুবকের দেহটি ঝোলানো হল ফাঁসিতে।

ধর্ষণে অভিযুক্তকে হত্যার প্রতিবাদে ডিমাপুরে ছাত্র সংগঠন আমসু-র বিক্ষোভ। শুক্রবার। ছবি: পিটিআই।

ধর্ষণে অভিযুক্তকে হত্যার প্রতিবাদে ডিমাপুরে ছাত্র সংগঠন আমসু-র বিক্ষোভ। শুক্রবার। ছবি: পিটিআই।

রাজীবাক্ষ রক্ষিত
গুয়াহাটি শেষ আপডেট: ০৭ মার্চ ২০১৫ ০৩:৩৬
Share: Save:

সারা বছরের চেনা শান্ত ডিমাপুর চেনে না এই উন্মত্ত ডিমাপুরকে।

শহরের পথে ক্ষিপ্ত জনতা ছুটছে জেলের দিকে। ঠেকানোর সাহস পাচ্ছে না পুলিশও। জেল থেকে তারা ছিনিয়ে আনল এক যুবককে। এর পর শুরু তাণ্ডব। ওই যুবককে নগ্ন করে চলছে গণপিটুনি। মোটরবাইকের পিছনে বেঁধে হিঁচড়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে পিচরাস্তা দিয়ে। পিছনে ছুটছে নানা বয়সের এক দল মানুষ। এর পর রক্তাক্ত যুবকের দেহটি ঝোলানো হল ফাঁসিতে। শহরের কেন্দ্রস্থলে। দড়ি ছিঁড়ে পড়ে গেলে, সেই দেহ টেনে নিয়ে গিয়ে পুড়িয়ে দিল জনতাই। তারাই ‘শাস্তি’ দিল ধর্ষণে অভিযুক্ত ওই যুবককে।

গত কালের এই তাণ্ডবের পর আপাতত ডিমাপুর থমথমে। জারি রয়েছে কার্ফু। ঘটনাটি নিয়ে বিচার বিভাগীয় তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন নাগাল্যান্ডের মুখ্যমন্ত্রী টি আর জেলিয়াং। ঘটনার গুরুত্ব বুঝে জরুরি রিপোর্ট তলব করেছেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিংহ। সাসপেন্ড করা হয়েছে জেলাশাসক, পুলিশ সুপার ও সংশ্লিষ্ট জেলের সুপারকে। প্রশ্নের মুখে পড়েছে নাগাল্যান্ড সরকার, পুলিশ কেন এমন ঘটনা ঠেকালো না? পুলিশ-প্রশাসনের কর্তারা বলছেন, পুলিশের ছোড়া গুলিতে আজ এক জনের মৃত্যু হয়েছে। গত কাল জনরোষ এমন তীব্র ছিল যে, সামাল দেওয়া কঠিন হয়ে পড়েছিল। তায় স্কুল-পড়ুয়ারাও ছিল ওই ভিড়ে। গোড়াতেই গুলি চালালে পরিস্থিতি আরও বিগড়ে যেত।

রাজ্য সরকার নাগ্যাল্যান্ডে বসবাসকারী সকল মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য প্রশাসনকে নির্দেশ দিলেও, গত কাল বিকেল থেকেই ভিন্ রাজ্যের ব্যবসায়ীরা দলে দলে ডিমাপুর ছাড়ছেন। পালিয়েছেন জনরোষে নিহত বন্দির ভাই। লাগোয়া রাজ্য অসমে আজ সারাদিন ধরেই চলেছে বিক্ষোভ, অবরোধ। এই ঘটনার বিশেষ প্রভাব পড়েছে বরাকের করিমগঞ্জ জেলায়। করিমগঞ্জের বদরপুরেই নিহতের বাড়ি। আজ অসমের বিভিন্ন স্থানে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ ও নাগাল্যান্ডের মুখ্যমন্ত্রী জেলিয়াং-এর কুশপুতুল পোড়ানো হয়। বিভিন্ন সংগঠন নাগাল্যান্ডগামী রাস্তা দফায় দফায় অবরোধ করে। নাগাল্যান্ডমুখী যাত্রীবাহী যান চলাচলও বন্ধ ছিল। অসমের সব দল ও সংগঠন নাগাল্যান্ডের বিরুদ্ধে রাজ্য সরকারকে কঠোর হওয়ার দাবি তুলেছে। অসমের মুখ্যমন্ত্রী তরুণ গগৈয়ের মতে, এই ঘটনা অমানবিক ও বর্বরোচিত। এ নিয়ে তিনি নাগাল্যান্ডের মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলেছেন। রাজ্যের মুখ্যসচিবকে বিষয়টি নিয়ে নাগাল্যান্ডের মুখ্যসচিবের সঙ্গে আলোচনারও নির্দেশ দিয়েছেন গগৈ। ইতিমধ্যে একটি সংগঠন কাল ১২ ঘণ্টার অসম বন্ধের ডাক দিয়েছে।

ঘটনার সূত্রপাত গত ২৪ ফেব্রুয়ারি। ডিমাপুরের এসডি জৈন কলেজের এক ছাত্রী থানায় অভিযোগ জানান, গত কাল সন্ধেয় এক তাঁকে ধর্ষণ করেছে এক ব্যক্তি। নাম শরিফুদ্দিন ওরফে করিম খান। এক বন্ধুর মাধ্যমে তাঁকে ডেকে নিয়ে গিয়ে জোর করে মদ খাওয়ানো হয় ও দফায় দফায় ধর্ষণ করা হয়। অভিযোগ দায়েরের দিনে অর্থাৎ ২৪ ফেব্রুয়ারিই অভিযুক্তকে গ্রেফতার করে পুলিশ। মেয়েটির ডাক্তারি পরীক্ষা করানো হয়। ৫ দিন পুলিশ হেফাজতে রাখার পরে অভিযুক্তকে ডিমাপুর কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠানো হয়।

ডিমাপুর-কাণ্ডের প্রতিবাদে বদরপুরে অবরোধ। শুক্রবার শীর্ষেন্দু শী-র তোলা ছবি।

ঘটনাটি নিয়ে জল ঘোলা হচ্ছিল। গত দিন তিনেক ধরে তা ক্রমশ জটিল আকার নিতে শুরু করে। বন্ধ, মিছিল, ধর্না তো চলছিলই। তারই সঙ্গে যোগ হয় ভিন্রাজ্যের মানুষ ও অনুপ্রবেশকারীদের নিয়ে বিতর্ক। বিভিন্ন সংগঠন দাবি তোলে, ওই অভিযুক্ত অনুপ্রবেশকারী। রাজ্য থেকে অবিলম্বে সব অনুপ্রবেশকারীকে বের করার দাবিও জানায় তারা। ডিমাপুরে থাকা বেশ কিছু ব্যবসায়ীর ট্রেড লাইসেন্স বাতিল করার দাবি নিয়ে জনতা জেলা প্রশাসনের দফতরেও হানা দেয়। উত্তপ্ত অবস্থা সামাল দেওয়ার জন্য ডিমাপুরে নিরাপত্তা ব্যবস্থা কঠোর করা হয়। জারি হয় ১৪৪ ধারা। তার মধ্যেই কলেজ ছাত্ররা হাজি পার্ক, হংকং মার্কেটে বহু দোকানে ভাঙচুর চালায়। ডিমাপুরের নিউ মার্কেটেও কয়েকটি দোকানে তারা আগুন লাগায়।

কাল সকাল থেকেই ডিমাপুরের সব দোকান, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ছিল। সকালে তথাকথিত বিদেশি ও ভিন্ রাজ্যের মানুষের বিরুদ্ধে স্থানীয় ছাত্র সংগঠন ‘ও সুমি হো হো’ মিছিল বের করে। জেলাশাসক ওয়েজিও কেনি তাদের শান্ত করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। মিছিল ‘চার মাইল’ এলাকায় ডিমাপুর কেন্দ্রীয় কারাগারের দিকে এগোয়। পুলিশ ব্যর্থ হয় তাদের আটকাতে। অভিযুক্তকে তাদের হাতে তুলে দেওয়ার দাবিতে এর পর জনতা কারাগারে ঢোকার চেষ্টা করে। রক্ষীদের কাবু করে দু’টি গেট ভেঙে ফেলে তারা। জেল-অফিসে ভাঙচুর চালায়। পুলিশ লাঠি চালিয়ে, কাঁদানে গ্যাস ছুড়ে, শূন্যে গুলি চালিয়ে ঠেকাতে পারেনি। শেষে বেনজির ভাবে জেল কর্তৃপক্ষ কারাগারের মূল ফটক খুলে দিতে বাধ্য হয়। অভিযুক্তকে বার করে আনে জনতা।

এর পর ওই যুকবকে নগ্ন করে পেটাতে পেটাতে শহরের কেন্দ্রস্থল ক্লক টাওয়ারের দিকে রওনা হয় জনতা। পুরানা বাজার এলাকায় তাকে বাঁধা হয় মোটরবাইকের পিছনে। টানতে টানতে নিয়ে আসা হয় ক্লক টাওয়ারে। শেষ পর্যন্ত জনতাকে ছত্রভঙ্গ করতে গুলি চালায় পুলিশ। কয়েক জন বিক্ষোভকারী জখম হয়। তবে ততক্ষণে গণপিটুনিতে মারা গিয়েছে অভিযুক্তও। ক্লক টাওয়ারে ওই দেহটিই ফাঁসিতে ঝোলায় উন্মত্ত জনতা। দড়ি ছিঁড়ে পড়ে গেলে দেহটিকে রেলিঙে ক্রুশে ঝোলানোর মতো করে ঝুলিয়ে রেখে চলে উল্লাস। এর পরে দেহটিতে আগুন দেয় জনতা। পুলিশের ১০টি বাস ও গাড়িতেও আগুন লাগানো হয়। জনতার ছোড়া পাথরে বহু পুলিশকর্মী ঘায়েল হওয়ার পরে আধাসেনা গিয়ে পরিস্থিতি সামাল দেয়।

নিহত অভিযুক্তের ভাই নাসিরের বক্তব্য, “ধর্ষণের অভিযোগ পুরোটাই সাজানো।” তাঁরা বিদেশি, এই অভিযোগ উড়িয়ে দিয়ে নাসির বলেছেন, “বিষয়টিকে অন্য দিকে ঘুরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে।” কাল গভীর রাতে আধাসেনার সাহায্যে পুলিশ নিহত অভিযুক্তের অর্ধ-দগ্ধ দেহ উদ্ধার করে গোপনে শেষকৃত্য করেছে। নাসির জানান, আজ আড়াই মাইলে তাঁদের বাড়িও ঘেরাও করে উত্তেজিত জনতা। তিন বছরের মেয়েকে নিয়ে ভাইয়ের স্ত্রী ওই বাড়ি ছেড়ে অন্যত্র আশ্রয় নিয়েছেন।

গত বছরও, নাগাল্যান্ডের ফেক জেলায় এক যুবতীকে ধর্ষণ ও হত্যার অভিযোগে এক অভিযুক্তকে পিটিয়ে মেরেছিল জনতা। গত কালের ঘটনাটিকে ‘দুর্ভাগ্যজনক’ আখ্যা দিয়ে নাগাল্যান্ডের মুখ্যমন্ত্রী জেলিয়াং জানান, পুলিশ-প্রশাসনের দোষ থাকলে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলেও মুখ্যমন্ত্রী জানিয়েছেন। তবে সাসপেন্ড হওয়ার আগে ডিমাপুরের এসপি মেরেন জামির এ দিন বলেন, “স্কুল-কলেজের ইউনিফর্ম পরা ছাত্রদের রেখে এত মানুষ জেল আক্রমণ করল যে আমরা কিছুই করতে পারিনি। গুলি চালালে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হতে পারত।” একই বক্তব্য ডিজিপি এল এল ডংগলেরও। তিনি জানান, বিভিন্ন ফুটেজ থেকে আইনভঙ্গকারীদের শনাক্ত করার চেষ্টা হচ্ছে এবং কয়েক জনকে গ্রেফতারও করা হয়েছে। তিনি জানান, পরিস্থিতি শান্ত না হওয়া পর্যন্ত কার্ফু থাকবে। সেনা, সিআরপি, রিজার্ভ ব্যাটালিয়ন, আসাম রাইফেল্সের জওয়ানরা টহল দিচ্ছেন ডিমাপুরের পথে পথে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

dimapur rape rajibakhsya raxit guahati
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE