আষাঢ়ে রথযাত্রা হয় সর্বত্র। ঠালিগ্রামে রথ চলে পৌষ সংক্রান্তিতেও। পুরীর রথ কী পাড়ার রথ— জগন্নাথ-সুভদ্রা-বলরামকে নিয়েই চলে শোভাযাত্রা। কিন্তু ঠালিগ্রামের রথে চড়েন শ্রীকৃষ্ণ। এর আরও এক বিশেষত্ব — পুরুষরা নন, রথের রশি প্রথম টানেন এলাকার মহিলারা। চাকা নড়ে ওঠার পরই পুরুষরা হাত লাগাতে পারেন।
এই বিশেষ রথের জন্য অপেক্ষায় থাকেন উধারবন্দ বিধানসভা আসনের বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষ। আগের দিন শিবেরবন্দ ফাঁড়ি মন্দিরের সামনে থেকে রথকে নিয়ে রাস্তায় রাখা হয়। রঙিন কাগজের পতাকা আর রঙচঙে কাপড়ে সাজিয়ে তোলা হয় চতুর্দিক।
পৌষ সংক্রান্তির সকালে রথের পাশে হয় ঘটপূজা। সেই ঘটের সামনে প্রণাম জানিয়ে দল-উপদলে বিভক্ত হয়ে বেরিয়ে পড়ে কীর্তনীয়ারা। তাঁরা প্রত্যেক শ্রমিকের বাড়ি যান, চলে লুট। বাতাসা, কমলা, কলা। যাঁর যেমন ইচ্ছে বা সামর্থ। বিকেলে সব দল ফিরে এসে মিলিত হয় মন্দিরের সামনে। চলে রথকে ঘিরে পূজার্চনা। মহিলারা রথের চার চাকায় ছোট চারটি ঘট বসান। তার উপরে ফুল। প্রতি ঘটের পাশে একটি করে ভোগ।
মহিলারা রথের রশি টানতেই শুরু হয় হর্ষোল্লাস। বাগানের ভিতরে বিভিন্ন শ্রমিক-লাইন পেরিয়ে রথ নিয়ে যাওয়া হয় ৭০০ মিটার দূরে ঠালিগ্রামের মূল বাগান-মন্দিরে। সেখানে চলে আরেক প্রস্ত গান-কীর্তন, লুট। শিবেরবন্দ মন্দিরের প্রবীণ পূজারিণী রঙ্গদেবী বড়াইক জানালেন, মূল মন্দিরে ৮ দিন অবস্থানের পর শ্রীকৃষ্ণকে ফের রথে চড়িয়ে নিয়ে আসা হবে। তাঁর কথায়, ‘‘সর্বত্র জগন্নাথদেবের মাসীর বাড়ি যাওয়াকেই রথযাত্রা হিসেবে পালন করা হয়। কিন্তু পৌষমাসের শেষ দিনে অক্রুর মুণি যে শ্রীকৃষ্ণকে রথে চড়িয়ে মথুরা নিয়ে গিয়েছিলেন, তা কোথাও গুরুত্ব পায়নি।’’ তাই তাঁদের গুরুদেব সেবকানন্দ গোস্বামী তাঁর ঠালিগ্রামের শিষ্যদের মকরসংক্রান্তিতে রথযাত্রার নির্দেশ দিয়েছিলেন। তিনি নিজে রামমানিকপুর থাকতেন। পৌষ সংক্রান্তিতে চলে আসতেন ঠালিগ্রামে। শিষ্যদের নিয়ে নিজের হাতে রথ সাজাতেন, পুজো করতেন। তাঁর প্রয়াণের পরও গুরুদেবের নির্দেশ পালন করে চলেছেন শিষ্যরা।
শিবেরবন্দের যুবক লক্ষ্মীরাম বড়াইক জানান, আগে বিষয়টি শুধু সেবকানন্দ গোস্বামীর শিষ্যদের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। এখন তা ঠালিগ্রাম ও তার ফাঁড়িবাগানগুলির প্রত্যেক শ্রমিকের উৎসবে পরিণত হয়েছে।
মকর সংক্রান্তির অপেক্ষায় থাকেন বরাক উপত্যকার অধিকাংশ বাগান শ্রমিক। সেখানে অবশ্য রথযাত্রার জন্য নয়। অন্যত্র হয় টুসু বন্দনা। তা আসলে শস্যপূজা। পৌষমাসের প্রথম দিনে বাগানের সর্বজনীন মণ্ডপে বিশেষ বেদী স্থাপন হয়। প্রতিদিন চলে পূজার্চনা। সংক্রান্তির দিনে তাকে ঘিরে হয় নাচ-গান। টুসু উপলক্ষে বাগান শ্রমিকদের নিজস্ব গান রয়েছে। সমসাময়িক স্থানীয় ঘটনার উপর গান রচনা ও গাওয়া হয়। দুপুরে প্রসাদ বিতরণ। সূর্যাস্তের পর দেবীকে নিয়ে সবাই রওনা হন বিসর্জনে। মহিলারাই বিশেষ বেদী নদীর জলে বিসর্জন দেন।
লোকগবেষক অমলেন্দু ভট্টাচার্য জানিয়েছেন, টুসু মূলত বাঁকুড়া, বীরভূম, পুরুলিয়ার পূজা। ওই সব অঞ্চল থেকে প্রচুর লোক অসমের চা বাগানে নিয়োজিত রয়েছেন। এখন অবশ্য তা বিশেষ অঞ্চলের শ্রমিকদের মধ্যে আটকে নেই। বরাক উপত্যকার প্রতিটি চা শ্রমিক টুসুতে মেতে ওঠেন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy