Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪
National News

মহাষ্টমীতে প্রণবের বীরভূমের বাড়িতেও হাজির ছিলেন আরএসএস নেতারা!

২০১৫ সালে প্রথম বার সরসঙ্ঘচালক মোহনরাও ভাগবতকে দেখা গিয়েছিল রাষ্ট্রপতি ভবনে। রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়কে দেওয়ালির শুভেচ্ছা জানাতে গিয়েছিলেন ভাগবত। তার পরে ফের ২০১৭, রাষ্ট্রপতি পদ থেকে প্রণববাবুর অবসরের মাসখানেক আগে ফের রাইসিনা হিলসে যান আরএসএস প্রধান।

গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।

গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।

ঈশানদেব চট্টোপাধ্যায়
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৯ মে ২০১৮ ১৭:৩৩
Share: Save:

রাষ্ট্রপতি ভবন ছেড়ে বেরিয়ে এসেছেন ২০১৭ সালের জুলাই মাসে। বয়স এখন ৮২। দেশের সর্বোচ্চ সাংবিধানিক পদে ছিলেন। তাই প্রথামতো সক্রিয় রাজনীতির বাইরে। কিন্তু ঢেঁকি স্বর্গে গিয়েও ধান ভানে। তাই ভারতীয় রাজনীতির দীর্ঘ কালের ‘চাণক্য’ প্রণব মুখোপাধ্যায়ের সঙ্ঘ ঘনিষ্ঠতাকে কিছুতেই অরাজনৈতিক চোখে দেখতে পারছে না রাজনৈতিক শিবিরের বিরাট অংশ। এতেই অবশ্য শেষ নয়। সঙ্ঘের নেতৃত্ব আর যা জানাচ্ছে, তা আরও চাঞ্চল্যকর। আরএসএস সর্বভারতীয় নেতৃত্ব শুধু রাষ্ট্রপতি ভবনে নয়, প্রণববাবুর বীরভূমের বাড়ি থেকেও ঘুরে এসেছেন। খবর সঙ্ঘ সূত্রের।

২০১৫ সালে প্রথম বার সরসঙ্ঘচালক মোহনরাও ভাগবতকে দেখা গিয়েছিল রাষ্ট্রপতি ভবনে। রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়কে দেওয়ালির শুভেচ্ছা জানাতে গিয়েছিলেন ভাগবত। তার পরে ফের ২০১৭, রাষ্ট্রপতি পদ থেকে প্রণববাবুর অবসরের মাসখানেক আগে ফের রাইসিনা হিলসে যান আরএসএস প্রধান। মধ্যাহ্নভোজও সারেন। রাজনৈতিক শিবিরে সে বারও জোর জল্পনা শুরু হয়েছিল। কিন্তু রাষ্ট্রপতি ভবন এবং সঙ্ঘ, দু’তরফ থেকেই জানানো হয়, প্রণব-ভাগবত সাক্ষাৎ নিতান্তই সৌজন্যের।

কিন্তু প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায় এ বার সঙ্ঘের যে অনুষ্ঠানে যোগ দিচ্ছেন, তাকে আর সৌজন্যমূলক অংশগ্রহণ বলা যাচ্ছে না। সঙ্ঘ শিক্ষা বর্গের তৃতীয় বর্ষের যে সমাপ্তি সমারোহ নাগপুরে আরএসএস-এর সদর দফতরে অনুষ্ঠিত হয়, সেই অনুষ্ঠানেই যোগ দিচ্ছেন প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি। সঙ্ঘের প্রশিক্ষণে উত্তীর্ণ হচ্ছেন যাঁরা, দেশ-কাল-সমাজ নিয়ে তাঁদের সামনে ভাষণ দেবেন তিনি।

যত ব্যস্ততাই থাক, পৈতৃক ভিটের দুর্গোৎসব থেকে দূরে থাকতে চাইতেন না প্রণব মুখোপাধ্যায়। —ফাইল চিত্র।

পশ্চিমবঙ্গের আরএসএস নেতৃত্বের মতে, প্রণববাবুর এই নাগপুর সফরে বিস্মিত হওয়ার কিছুই নেই। সঙ্ঘের সঙ্গে প্রণবের ঘনিষ্ঠতা গত পাঁচ বছর ধরেই বাড়ছিল। বীরভূমের মিরাটিতে প্রণব মুখোপাধ্যায়ের পৈতৃক ভিটেতে যে দুর্গোৎসব হয়, সেখানে উপস্থিত থাকার জন্য প্রণববাবু আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন সঙ্ঘ নেতৃত্বকে। ২০১৬ সালে সঙ্ঘের প্রতিনিধিরা রাষ্ট্রপতির পৈতৃক ভিটের দুর্গোৎসবে সামিল হন বলেও আরএসএস-এর রাজ্য (প্রান্ত) নেতৃত্ব সূত্রে জানা যাচ্ছে।

ইন্দিরা জমানায় কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার সেকেন্ড-ইন-কম্যান্ড ছিলেন প্রণব মুখোপাধ্যায়। ক্যাবিনেটে ইন্দিরার সবচেয়ে ভরসার পাত্র ছিলেন। কয়েক দশক কাটিয়ে ইউপিএ-১ এবং ইউপিএ-২ মন্ত্রিসভাতেও সেই গুরুত্ব অক্ষুণ্ণ ছিল প্রণবের। অবশেষে রাষ্ট্রপতি হওয়া। কিন্তু যখন যে পদেই থাকুন, দুর্গাপুজোর সময়ে বীরভূমের ভিটেয় ফেরা এবং ধুতি-উত্তরীয়ে সেজে চণ্ডীপাঠে অংশ নেওয়ায় ছেদ পড়তে দিতে চাইতেন না প্রণব। ২০১৬ সালের দুর্গাপুজোই ছিল রাষ্ট্রপতি পদে থাকা প্রণবের শেষ দুর্গাপুজো। সে বার মহাষ্টমীতে সঙ্ঘের অন্তত পাঁচ জন প্রতিনিধি প্রণববাবুর বাড়িতে যান বলে জানা গিয়েছে।

রাষ্ট্রপতির আমন্ত্রণেই তাঁর পৈতৃক ভিটের দুর্গোৎসবে যোগ দিয়েছিলেন সঙ্ঘের প্রতিনিধিরা। খবর আরএসএস সূত্রের। কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের তরফে দু’জন প্রতিনিধি ছিলেন, বাকিরা রাজ্য ও জেলা স্তরের। সঙ্ঘ সূত্রে জানা গিয়েছে, প্রণববাবু সঙ্ঘ নেতাদের সঙ্গে পরিজনদের এবং অন্য অতিথি-অভ্যাগতদের আলাপ করিয়ে দেন। তাঁদের মধ্যে প্রণববাবুর এক বাল্যবন্ধুও ছিলেন, যিনি মুসলিম। সঙ্ঘ নেতাদের সঙ্গে তাঁর আলাপ করিয়ে প্রণববাবু জানান, প্রতি বছরই তাঁর বাড়ির দুর্গোৎসবে তাঁর ওই বাল্যবন্ধু সক্রিয় ভাবে অংশ নেন এবং এটাই বাংলার ছবি। ছোট থেকে কখনও হিন্দু-মুসলিম ভেদাভেদ দেখে বড় হননি বলে রাষ্ট্রপতি জানিয়েছিলেন সঙ্ঘের প্রতিনিধিদের, বাংলায় সাম্প্রদায়িক উত্তেজনার বাড়বাড়ন্ত নিয়ে তিনি আক্ষেপও প্রকাশ করেছিলেন। জানা গিয়েছে আরএসএস সূত্রেই।

গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।

আরও পড়ুন: সদ্যোজাতকে রক্ত দিতে রোজা ভাঙলেন তরুণ

কিন্তু প্রণব মুখোপাধ্যায়ের মতো খাঁটি কংগ্রেসি সম্পর্কে কেন আগ্রহী হল সঙ্ঘ? কেনই বা প্রণব আগ্রহী হলেন সঙ্ঘে? আরএসএস-এর এক রাজ্য স্তরের নেতার ব্যাখ্যা, ‘‘প্রণব মুখোপাধ্যায় বুঝতে পারছিলেন যে, দেশের বর্তমান পরিস্থিতি যে রকম, তাতে সঙ্ঘকে দরকার। সঙ্ঘও মনে করতে শুরু করেছিল যে, প্রণব মুখোপাধ্যায়ের মতো ব্যক্তিত্বের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়ানো জরুরি।’’ ওই আরএসএস কার্যকর্তার আরও ব্যাখ্যা, ‘‘বিদগ্ধ ব্যক্তিত্বদের সঙ্গে এবং বিশিষ্ট নাগরিকদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখা বা তাঁদের সঙ্গে পরামর্শ করা সঙ্ঘের কাছে নতুন কিছু নয়। এমনটা আমরা করেই থাকি।’’

প্রণব মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে কবে থেকে বাড়ছিল যোগাযোগ? সঙ্ঘ সূত্রের খবর, ২০১৩ সাল থেকে। অর্থাৎ, প্রণববাবু রাষ্ট্রপতি পদে বসার বছরখানেক পর থেকেই। ২০১৫ সালে মোহন ভাগবত রাষ্ট্রপতি ভবনে যাওয়ার পর সেই যোগসূত্র প্রকাশ্যে দৃশ্যমান হয় বলে সঙ্ঘ নেতৃত্ব জানাচ্ছে।

আরও পড়ুন: কংগ্রেসের দয়া বলেও পিছিয়ে গেলেন কুমার, মন্ত্রিসভা নিয়ে কথা দিল্লিতে

কংগ্রেস অত্যন্ত বিব্রত প্রণবের নাগপুর সফর নিয়ে। প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি নাগপুরের আমন্ত্রণ স্বীকার করতেই একাধিক কংগ্রেস নেতা বিরূপ প্রতিক্রিয়া দিয়েছিলেন। কংগ্রেস মুখপাত্র টম ভড়ক্কন বলেছেন, ‘‘যা জিজ্ঞাসা করার, প্রণব মুখোপাধ্যায়কেই করুন। আমাদের একমাত্র মন্তব্য হল, কোনও মন্তব্য নয়।’’ তিনি আরও বলেন, ‘‘আমরা শুধু বলতে পারি যে, আমাদের এবং আরএসএস-এর মতাদর্শে বিস্তর ফারাক রয়েছে।’’

প্রতিক্রিয়া মিলেছে দিল্লির প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী শীলা দীক্ষিতের পুত্র তথা গাঁধী পরিবার ঘনিষ্ঠ প্রাক্তন সাংসদ সন্দীপ দীক্ষিতের কাছ থেকেও। সন্দীপও সরাসরি প্রণব মুখোপাধ্যায়কে আক্রমণ করেননি। তবে তিনি বলেছেন, ‘‘প্রণব মুখোপাধ্যায় বিভিন্ন সভায় গিয়ে বার বার আরএসএস-কে আক্রমণ করেছেন। আরএসএস সাম্প্রদায়িক রাজনীতি করে, বিভাজনে বিশ্বাস করে, সঙ্ঘের লোকজনের কোনও চরিত্র নেই— এমন কথা তিনি বহু বার বলেছেন। আজ নিজেদের সদর দফতরে ভাষণ দেওয়ার জন্য প্রণববাবুকে আমন্ত্রণ জানিয়ে আরএসএস স্বীকার করে নিচ্ছে যে, প্রণববাবু ওঁদের সম্পর্কে যে সব কথা বলতেন, সেগুলো ওঁরাও বিশ্বাস করেন।’’

আরএসএস মুখপত্র ‘অর্গানাইজার’-এ অবশ্য লেখা হয়েছে, এই প্রথম বার সঙ্ঘের বাইরের কোনও প্রখ্যাত ব্যক্তিত্ব সঙ্ঘ শিক্ষা বর্গের সমাপ্তি অনুষ্ঠানে যোগ দিচ্ছেন, এমন নয়। সেখানে লেখা হয়েছে, ‘‘১৯৩৪ সালে মহাত্মা গাঁধী ওয়ার্ধায় সঙ্ঘের একটি শিবিরে উপস্থিত হয়েছিলেন এবং ভারতের ভবিষ্যৎ নিয়ে আলোচনা করেছিলেন প্রথম সরসঙ্ঘচালক কে বি হেডগেওয়ারের সঙ্গে।’’

আপাতত সঙ্ঘের তুলে ধরা এই তথ্যই আশার সলতে হতে পারে কংগ্রেসের জন্য। প্রণব মুখোপাধ্যায় সঙ্ঘের আমন্ত্রণ স্বীকার করার পরে যে অস্বস্তিতে কংগ্রেস পড়েছে, তার থেকে কংগ্রেসকে কিছুটা রেহাই দিতে পারে এই তথ্য।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE