লালকৃষ্ণ আডবাণী এখনও বিদ্রোহ করেননি। ‘ফোঁস’ করেছেন মাত্র। তাতেই নড়েচড়ে বসেছেন বিজেপি-র শীর্ষ নেতৃত্ব। আডবাণীকে ফোন করেছেন খোদ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী।
প্রধানমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ মহলের দাবি, আডবাণীকে ফোন করাটা কোনও আকস্মিক ঘটনা নয়। মোদী আজকাল মাঝে মধ্যেই আডবাণীকে ফোন করে তাঁর মতামত নেন। বিজেপির একটি সূত্র কিন্তু বলছে, নোট-নাকচের জেরে মোদী এখন ব্যাকফুটে। তাই নতুন করে আডবাণীকে তুষ্ট করার প্রয়াস শুরু হয়েছে।
এই অবস্থায় আরএসএস নাকি ঘরোয়া স্তরে আডবাণীকে রাষ্ট্রপতি পদপ্রার্থী করার প্রস্তাবও দিয়েছে। সঙ্ঘের সঙ্গে আডবাণীর সম্পর্ক একটা সময়ে বেশ বিষিয়ে উঠেছিল। কিন্তু সেই অধ্যায় এখন অতীত। গত এক মাসে দু’-দু’বার আডবাণীর সঙ্গে প্রাতরাশ বৈঠক করেছেন সঙ্ঘ-প্রধান মোহন ভাগবত।
আডবাণীকে রাষ্ট্রপতি করার প্রস্তাব মোদী এবং অমিত শাহ শেষ পর্যন্ত মেনে নেবেন কিনা, তা স্পষ্ট নয়। তবে এখনই বিরোধী সুর শোনাননি তাঁরা। বিজেপি শিবির মনে করছে, আডবাণীকে রাষ্ট্রপতি পদের প্রার্থী করার প্রস্তাবটা আসলে ৮৯ বছরের প্রবীণ এই নেতার সামনে ‘গাজর ঝোলানো।’ কারণ, নোট নাকচ নিয়ে আপাতত বিস্তর চাপে মোদী। দলের বেশ কিছু শীর্ষ নেতা চাইছেন, এই বাতাবরণে আডবাণী বিদ্রোহ করুন। তা হলে মোদীকে আরও চাপে ফেলে দেওয়া যাবে। এই নেতারা মোদী-বিরোধী হলেও নিজের থেকে মুখ খুলতে পারছেন না। যে হেতু তাতে দলে আরও কোণঠাসা হয়ে পড়ার সম্ভাবনা। কিন্তু আডবাণীর কথা আলাদা। তাঁর সম্পর্কে বিজেপির অন্দরে বলা হয়, মরা হাতি লাখ টাকা। এটা ঠিক যে আডবাণী মুখ খুললেই যে মোদীকে সরে যেতে হবে, পরিস্থিতি এমন নয়। কিন্তু দলের অন্যতম স্থপতি সমালোচনায় মুখর হলে সরকারের ভাবমূর্তি ধাক্কা খাবে। আর তখন মওকা বুঝে সরব হবেন মোদী-বিরোধী ওই সব নেতাও।
পাল্টা কৌশলে মোদীও তাই আডবাণীকে শান্ত রাখতে চাইছেন। আর এক-দেড় মাসের মধ্যে নোট-সঙ্কট মিটে যাবে বলে মোদী শিবিরের আশা। আর রাষ্ট্রপতি নির্বাচন জুলাইয়ে। আডবাণীকে তুষ্ট রেখে মোদী আশু সঙ্কট কাটিয়ে উঠতে পারলে জুলাই মাসে কী অবস্থান নেবেন বলা শক্ত।
বিজেপি সূত্র অবশ্য বলছে, আডবাণীকে রাষ্ট্রপতি পদপ্রার্থী করে মোদীকে চাপে রাখতে চাইতে পারে আরএসএস-ও। কারণ, সঙ্ঘ পরিবার এখন মোদীর ব্যাপারে উচ্ছ্বসিত নয়। নোট বদল নিয়ে তারা বেশ বিরক্ত। সঙ্ঘের শ্রমিক সংগঠন এবং বৈশ্য সম্প্রদায়ের সংগঠনগুলি তো প্রকাশ্যেই নোট-নাকচের সমালোচনা করছে। এই অবস্থায় মার্চ মাসে তিরুবনন্তপুরমে আরএসএসের সম্মেলন ডেকে সরকারের কাজকর্ম মূল্যায়ন করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। বিজেপি সূত্রের মতে, মোদীদুর্বল হলে সঙ্ঘ প্রভাবশালী হবে। ভাগবতের নিয়ন্ত্রণ বাড়বে। সেই লক্ষ্যে আডবাণী সঙ্ঘের হাতিয়ার হতে পারেন।
রাষ্ট্রপতি পদে এই বারই প্রথম নিজস্ব প্রার্থী বসানোর সুযোগ এসেছে বিজেপির সামনে। সেই সুযোগ স্বাভাবিক ভাবেই হাতছাড়া করতে নারাজ সঙ্ঘ। ফলে প্রণব মুখোপাধ্যায়কে সর্বসম্মত প্রার্থী করতে তারা রাজি নয়। এখন যদি পরিস্থিতি এমন হয় যে, আডবাণীকে রাষ্ট্রপতি পদপ্রার্থী করার জন্য সঙ্ঘ চাপ দেয়, তা হলে মোদী কী করবেন? বিজেপি সূত্র বলছে, আডবাণী রাষ্ট্রপতি হলে মোদীর বরং শাপে বর হবে। কারণ, আডবাণী আর যা-ই করুন, জ্ঞানী জৈল সিংহের মতো তিনি যে রাইসিনা হিলসে বসে ষড়যন্ত্রের নীল নকশা তৈরি করবেন না, সেটা নিশ্চিত। বরং সে ক্ষেত্রে আডবাণীকে সংবিধানের খাঁচায় বন্দি করে ফেলে তাঁর ফোঁসের হাত থেকে বাঁচতে পারবেন মোদী।
আডবাণী রাষ্ট্রপতি পদে প্রার্থী হলে কংগ্রেসের দিক থেকেও তেমন জোরদার বিরোধিতা আসবে না বলে আশাবাদী বিজেপি শিবির। কারণ, তাঁদের মতে, কংগ্রেসের মূল শত্রু এখন মোদী। আডবাণীর সঙ্গে তাদের তিক্ততা এখন অনেকটাই ইতিহাস। কংগ্রেস নেতাদের সঙ্গে ব্যক্তিগত সম্পর্কও অনেকটা সহজ করে ফেলেছেন আডবাণী। সম্প্রতি সনিয়া গাঁধীর জন্মদিনে আডবাণীই প্রথম নেতা যিনি সকালে ফোন করে তাঁকে শুভেচ্ছা জানান।
তবে রাষ্ট্রপতি পদপ্রার্থী হোন বা না হোন, পরের লোকসভা ভোটে আডবাণী যে আর লড়বেন না, সেটা একপ্রকার নিশ্চিত। তাঁর কেন্দ্র গাঁধীনগর থেকে আডবাণীর ছেলে জয়ন্ত বা মেয়ে প্রতিভাকে প্রার্থী করতে সঙ্ঘ রাজি। তবে শর্ত হলো, তাঁদের আগে দলে যোগ দিতে হবে এবং গাঁধীনগরে কাজ করে ধীরে ধীরে নিজেদের তৈরি করে নিতে হবে।
এ সবের অনেকটাই নির্ভর করছে উত্তরপ্রদেশের ভোটের ফলাফলের উপরে। বিজেপি হেরে গেলে মোদীর পক্ষে অনেক বেশি জরুরি হবে আডবাণীকে তুষ্ট রাখা। আর জিতলে দরকার ফুরোবে গাজর-রাজনীতির।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy