Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪

বাণিজ্যমেলায় রাজ্যের পুঁজি শুধু শাড়ি-গুড়

সুচিত্রা-উত্তম-সত্যজিৎ-ঋতুপর্ণ রয়েছেন। ‘কন্যাশ্রী’ রয়েছে। ‘নির্মল বাংলা মিশন’ রয়েছে। ‘বিশ্ব বাংলা’ ব্র্যান্ডের তাঁতের শাড়ি, হস্তশিল্প, নলেন গুড়ও রয়েছে। ডাকের সাজের দুর্গা প্রতিমা রয়েছে।

বিস্তর ফারাক। শিল্পমেলায় পশ্চিমবঙ্গের প্যাভিলিয়ন (বাঁ দিকে) এবং তামিলনাড়ুর প্যাভিলিয়ন। —নিজস্ব চিত্র।

বিস্তর ফারাক। শিল্পমেলায় পশ্চিমবঙ্গের প্যাভিলিয়ন (বাঁ দিকে) এবং তামিলনাড়ুর প্যাভিলিয়ন। —নিজস্ব চিত্র।

প্রেমাংশু চৌধুরী
নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ১৩ নভেম্বর ২০১৫ ০৩:০০
Share: Save:

সুচিত্রা-উত্তম-সত্যজিৎ-ঋতুপর্ণ রয়েছেন। ‘কন্যাশ্রী’ রয়েছে। ‘নির্মল বাংলা মিশন’ রয়েছে। ‘বিশ্ব বাংলা’ ব্র্যান্ডের তাঁতের শাড়ি, হস্তশিল্প, নলেন গুড়ও রয়েছে। ডাকের সাজের দুর্গা প্রতিমা রয়েছে।

নেই শুধু শিল্পের ছবি। কিংবা শিল্পে লগ্নির আহ্বান। দিল্লির প্রগতি ময়দানে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলায় পশ্চিমবঙ্গের প্যাভিলিয়নের বাইরের ছবিটা এ রকমই।

বাণিজ্য মেলার এ বারের থিম ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’। যার মূল মন্ত্র, দেশবিদেশের শিল্পপতিদের কারখানা তৈরিতে এ দেশে আহ্বান। সব রাজ্যই নিজেদের প্যাভিলিয়নে ‘সাকসেস স্টোরি’ হিসেবে কোন কোন শিল্প চালু রয়েছে, তা তুলে ধরেছে। শিল্পের জন্য কোথায়, কী ধরনের সুবিধা বা পরিকাঠামো রয়েছে, তা ঘোষণা করছে। অন্ডালের নতুন বিমানবন্দরের ছবি ছাড়া পশ্চিমবঙ্গের প্যাভিলিয়নের আর যা রয়েছে, তার সঙ্গে শিল্পের সম্পর্ক খুঁজে পাওয়া ভার।

মুখ্যমন্ত্রীর প্রিয় নীল রঙের প্যাভিলিয়নের ভিতরের মূল আকর্ষণ এ বার নেতাজি ফাইল। এত দিন রাজ্য সরকারের হেফাজতে থাকা যে সব গোপন ফাইল সদ্য জনসমক্ষে এনেছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার। আমজনতার জন্য ভিতরে নেতাজি ফাইল মূল আকর্ষণ হলেও বাইরে নজর টানবে টয় ট্রেন, বাউল মেলা, হাজারদুয়ারি বা সুন্দরবনের বাঘ। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে শিল্প বা ব্যবসা করার ইচ্ছা নিয়ে কেউ এই প্যাভিলিয়নে হাজির হলে তাঁর বিভ্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। শিল্পমন্ত্রী অমিত মিত্র শনিবার মেলার প্রথম দিনে এই প্যাভিলিয়নেরই উদ্বোধন করবেন।

পশ্চিমবঙ্গের উল্টো দিকেই তামিলনাড়ুর প্যাভিলিয়ন। মূল ফটকেই বড় হরফে ঘোষণা--‘বিনিয়োগকারীদের স্বর্গরাজ্য’। ভারী শিল্পের জয়জয়কার। গুজরাত, মহারাষ্ট্র, কর্নাটক তো বটেই। অসমও ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’-র মন্ত্রে হস্তশিল্প থেকে ভারী শিল্পে যাওয়ার কথা বলছে। এই সব রাজ্যের সঙ্গে লগ্নি টানার প্রতিযোগিতায় নেমে পশ্চিমবঙ্গের শিল্পচিত্র সেই তাঁত ও হস্তশিল্পেই সীমাবদ্ধ।

প্যাভিলিয়নের শেষ মুহূর্তের কাজের দেখভালে ব্যস্ত রাজ্য সরকারের এক আমলা বলেন, ‘‘নবান্নের নির্দেশে এ বারের মূল ফোকাস হবে বিশ্ব বাংলা। রাজ্যের তাঁত ও হস্তশিল্পজাত পণ্যকে বিশ্ব বাজারে বিপণনের জন্য মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বিশ্ব বাংলা ব্র্যান্ডের পরিকল্পনা করেছেন। বাণিজ্যমেলাতেও সেই চেষ্টাই হচ্ছে।’’ শিল্পমন্ত্রী অমিত মিত্রর সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করে লাভ হয়নি। শিল্প দফতরের কর্তারা এ বিষয়ে কথা বলতেই নারাজ। রাজ্য শিল্পোন্নয়ন নিগমের এক কর্তার যুক্তি, ‘‘পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে তাঁত ও হস্তশিল্পের সঙ্গে দশ লক্ষের বেশি মানুষ যুক্ত। ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প মন্ত্রক তাই এই ক্ষেত্রের উপর বিশেষ ভাবে জোর দিচ্ছে।’’

এই যুক্তি শুনে শিল্পমহল বিস্মিত। তাঁদের প্রশ্ন, হস্তশিল্পের বিপণনের সঙ্গে ভারি শিল্পের বিরোধ কোথায়? অটোমোবাইল, রসায়ন, বস্ত্র, রেল, খনি, বিদ্যুতের মতো ২৫টি ক্ষেত্রে এ দেশে কারখানা তৈরিতে লগ্নি টানতে ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’-র কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে। এইসব ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের সুবিধা দেওয়া হচ্ছে, কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরিতে বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা হচ্ছে। শিল্পমহলের বক্তব্য, এই সব শিল্পক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গে কী সুবিধা দেওয়া হচ্ছে, সেটাই তুলে ধরা উচিত ছিল। বণিকসভার এক কর্তা মনে করিয়ে দিচ্ছেন, শিল্পের জন্য রাজ্য যে সব সুবিধার কথা ঘোষণা করেছে, সেগুলো তারা দিচ্ছে না বলেই ২৫০০ কোটি টাকার লগ্নি আটকে রয়েছে।

বিজেপি নেতা তথা শিল্পপতি শিশির বাজোরিয়া বলেন, ‘‘বর্তমান সরকারের আর ছয় মাস মেয়াদ বাকি। এই সাড়ে চার বছরে শিল্প ক্ষেত্রে তুলে ধরার মতো কিছু নেই। কন্যাশ্রী প্রকল্প ভাল হতে পারে। কিন্তু শিল্প না হলে রাজস্ব আসবে কোথা থেকে? কন্যাশ্রী প্রকল্পেরই বা টাকা আসবে কোথা থেকে?’’ বিরোধী শিবিরের অভিযোগ, শিল্পায়ন, চাকরির সুযোগ তৈরি হয়নি বলেই রাজ্যে সিন্ডিকেট, তোলাবাজি, চাঁদার জুলুম বাড়ছে।

দিল্লির বণিকসভার এক কর্তা বলেন, সিঙ্গুরে ছোট গাড়ির কারখানার বিরুদ্ধে আন্দোলন করে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ক্ষমতায় আসেন ঠিকই। সিঙ্গুর-পরবর্তী অধ্যায়েও তিনি শিল্পমহলকে সাহায্য করার বদলে শিল্প-বিরোধী জমিনীতি নিয়েছেন। জমির ঊর্ধ্বসীমা আইন নিয়ে অনড় মনোভাব দেখিয়েছেন। ছবিটা পাল্টাতে দিল্লির আন্তর্জাতিক বাণিজ্যমেলাকে কাজে লাগানো যেত। কিন্তু সেখানেও শিল্পের বদলে ভোটার-মন জয়ের সামাজিক প্রকল্পই তুলে ধরা হল।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE