Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪

কোর্টে মনমোহনের হাজিরায় স্থগিতাদেশ

সুপ্রিম কোর্টের ৯ নম্বর এজলাসে দর্শকদের বসার জায়গা যত্‌সামান্য। সরু একফালি জায়গায় পরপর আটটি কাঠের চেয়ার। তারই তিনটিতে পাশাপাশি উপেন্দ্র সিংহ, দমন সিংহ এবং উপেন্দ্রর ছেলে রাঘব। মনমোহন সিংহের তিন মেয়ের মধ্যে সবচেয়ে বড়, দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের অধ্যাপিকা উপেন্দ্রর চোখেমুখেই টেনশনটা বেশি। কোলের উপর রাখা কাপড়ের পার্সটা মাঝেমধ্যেই ডান হাত দিয়ে আঁকড়ে ধরছেন।

প্রেমাংশু চৌধুরী
নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ০২ এপ্রিল ২০১৫ ০৩:১১
Share: Save:

সুপ্রিম কোর্টের ৯ নম্বর এজলাসে দর্শকদের বসার জায়গা যত্‌সামান্য। সরু একফালি জায়গায় পরপর আটটি কাঠের চেয়ার। তারই তিনটিতে পাশাপাশি উপেন্দ্র সিংহ, দমন সিংহ এবং উপেন্দ্রর ছেলে রাঘব। মনমোহন সিংহের তিন মেয়ের মধ্যে সবচেয়ে বড়, দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের অধ্যাপিকা উপেন্দ্রর চোখেমুখেই টেনশনটা বেশি। কোলের উপর রাখা কাপড়ের পার্সটা মাঝেমধ্যেই ডান হাত দিয়ে আঁকড়ে ধরছেন। সামনে উকিলদের গিজগিজে ভিড়। মাথা উঁচু করে কালো কোট পরা শরীরগুলোর ফাঁক দিয়ে নজর করার চেষ্টা করছেন, কত নম্বর মামলার শুনানি চলছে। ছেলে রাঘব বারবার চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়ছেন। মেজ বোন দমন বললেন, “জীবনে প্রথম বার সুপ্রিম কোর্টে এলাম। ভাল কিছুর আশা করেই বসে রয়েছি।”

ঘড়ির কাঁটায় ১১টা ২ মিনিট। ৩৩ নম্বর মামলার শুনানি শুরু হল। তিন জনেই চেয়ার ছেড়ে সটান উঠে পড়লেন। এজলাসে তখন যেন কলেজ স্কোয়ারের পুজোমণ্ডপের থেকেও বেশি ভিড়। উকিলদেরই শামলা টেনে-হিঁচড়ে ভিতরে ঢুকতে হচ্ছে। পরিস্থিতি দেখে বিচারপতি ভি গোপাল গৌড়াও মুচকি মুচকি হাসছেন। মনমোহনের আইনজীবী কপিল সিব্বল সওয়াল শুরু করলেন। পাক্কা আধ ঘণ্টার ঝোড়ো আইনি সওয়াল-জবাব। সাড়ে ১১টায় বিচারপতি গৌড়া ও বিচারপতি সি নাগাপ্পনের বেঞ্চ ভাল খবরই শোনাল মনমোহনের দুই কন্যা ও নাতিকে। আদালতে হাজির হওয়া থেকে আপাতত রেহাই পেলেন ৮২ বছরের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী। দ্রুত আদালত ছাড়লেন উপেন্দ্র-দমনরা।

কয়লা খনি বণ্টন দুর্নীতির মামলায় অভিযুক্ত সাব্যস্ত করে গত মাসে মনমোহনকে সমন পাঠিয়েছিল বিশেষ আদালত। বিচারক ভরত পরাশর নির্দেশ দিয়েছিলেন, আগামী ৮ এপ্রিল মনমোহন সিংহ, শিল্পপতি কুমারমঙ্গলম বিড়লা, প্রাক্তন কয়লাসচিব পি সি পরাখ-সহ ছ’জনকে আদালতে হাজির হতে হবে। সেই নির্দেশের উপরেই আজ স্থগিতাদেশ জারি করেছে সুপ্রিম কোর্ট। ২০০৫ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন কয়লা মন্ত্রকেরও অতিরিক্ত দায়িত্বে ছিলেন। সেই সময়ে বিড়লার হিন্দালকো সংস্থাকে নিয়মবিরুদ্ধ ভাবে ওড়িশার তালাবিড়া-২ কয়লাখনিটি পাইয়ে দেওয়া হয়েছিল বলে অভিযোগ ওঠে। দুর্নীতি, অপরাধমূলক ষ়ড়যন্ত্র-সহ বিভিন্ন ধারায় অভিযুক্ত করা হয় মনমোহনকে। বিশেষ আদালতে এই মামলার যাবতীয় শুনানির উপরেও আজ স্থগিতাদেশ জারি করেছে সর্বোচ্চ আদালত। সিবিআই-কেও তাদের বক্তব্য জানাতে বলা হয়েছে।

আদালতে প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রীর দুই মেয়ে উপেন্দ্র (বাঁ দিকে) ও দমন — রমাকান্ত কুশওয়াহা

মনমোহনকে আদালত সমন পাঠানোর পরেই মিছিল করে তাঁর বাড়িতে গিয়েছিলেন কংগ্রেস সভানেত্রী সনিয়া গাঁধী। বার্তা দিয়েছিলেন, দল মনমোহনের পাশেই রয়েছে। আইনি লড়াইয়ের পরিকল্পনা করছিলেন দুই প্রাক্তন আইনমন্ত্রী কপিল সিব্বল ও অশ্বিনী কুমার এবং সেই সঙ্গে অভিষেক মনু সিঙ্ঘভির মতো কংগ্রেসের দুঁদে আইনজীবী নেতারা। আজ সুপ্রিম কোর্টে সিব্বলের প্রধান প্রশ্নই ছিল— মনমোহনকে আদালতে তলব করা কতখানি আইনসঙ্গত? সিব্বল যুক্তি দেন, ফৌজদারি দণ্ডবিধির ১৯৭ ধারা অনুযায়ী বর্তমান বা প্রাক্তন কোনও সরকারি পদস্থ ব্যক্তিকে দুর্নীতিতে অভিযুক্ত করতে হলে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের আগাম অনুমতি নেওয়া দরকার। মনমোহন প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী। রাজ্যসভার সাংসদও। তাঁর ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতির অনুমতি নেওয়ার প্রয়োজন ছিল। অথচ বিশেষ আদালতের বিচারক সে সবের প্রয়োজন বোধ করেননি। সিবিআই বা অন্য কেউ এর জন্য আদালতে কোনও আবেদনও জানায়নি।

তালাবিড়া-২ কয়লা খনিটি প্রথমে রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা মহানদী কোলফিল্ড ও নেইভেলি লিগনাইট কর্পোরেশনকে বরাদ্দ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল কয়লা মন্ত্রকের স্ক্রিনিং কমিটি। সেই সিদ্ধান্ত খারিজ করে দিয়ে হিন্দালকো-কে ওই খনির কয়লার একাংশ বরাদ্দ করা হয়। এই সিদ্ধান্ত নিয়েই প্রশ্ন তুলেছিল বিশেষ আদালত। আজও বিচারপতিরা জানতে চান, কেন স্ক্রিনিং কমিটির সিদ্ধান্ত খারিজ হল? সিব্বল তখন বলেন, “স্ক্রিনিং কমিটির মাধ্যমে কয়লা খনি বণ্টনকে ইতিমধ্যেই ‘বেআইনি’ আখ্যা দিয়ে সমস্ত খনির বণ্টন বাতিল করেছে সুপ্রিম কোর্ট। অথচ সেই কমিটির সিদ্ধান্ত খারিজ করাকেই বেআইনি বলেছেন (নিম্ন আদালতের) বিচারক।”

সবিস্তারে দেখতে ক্লিক করুন

ভারতীয় দণ্ডবিধির ১২০(বি) ও ৪০৯ ধারায় ষড়যন্ত্র ও বিশ্বাসভঙ্গের দায়ে অভিযুক্ত করা হয়েছিল মনমোহনকে। এই আইনে দোষী সাব্যস্ত হলে সর্বোচ্চ সাজা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। সেই সঙ্গে দুর্নীতি দমন আইনের ১৩(১)(সি) ও ১৩(১)(ডি)(৩) ধারায় সরকারি পদস্থ ব্যক্তি হিসেবে সরকারি সম্পত্তি লুঠ বা লুঠের সুযোগ করে দেওয়া এবং আর্থিক সুবিধা নেওয়ার অভিযোগও তোলা হয়েছিল। যার বিরোধিতা করে সিব্বল বলেছেন, এ ক্ষেত্রে কোনও সরকারি সম্পত্তি লুঠ হয়নি। হিন্দালকো-কে ওই খনিটি দিতে অনুরোধ করে ওড়িশার মুখ্যমন্ত্রী নবীন পট্টনায়ক চিঠি লিখেছিলেন মনমোহনকে। সেই অনুযায়ী সিদ্ধান্ত হয়। এখানে ষড়যন্ত্রও ছিল না এবং এর থেকে মনমোহনের কোনও ব্যক্তিগত স্বার্থসিদ্ধি হয়নি।

সিব্বলরা যুক্তি দেন, কোনও প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত ভাল বা খারাপ হতে পারে। এখন যে সিদ্ধান্ত ঠিক বলে মনে হচ্ছে, পরে তা ভুল বলে প্রমাণিত হতে পারে। কিন্তু পরে ভুল প্রমাণিত হয়েছে বলে সিদ্ধান্ত নেওয়াটাই ‘অপরাধ’ হয়েছিল, এমন বলা যায় না। বিড়লার আইনজীবী হরিশ সালভেও আদালতে আজ দাবি করেন যে, ওড়িশার মুখ্যমন্ত্রীর চিঠি পেয়েই তালাবিড়া-২ খনি থেকে হিন্দালকো-কে কয়লা বরাদ্দের সিদ্ধান্ত হয়েছিল। কিন্তু ওই খনির মাত্র ১৫ শতাংশ কয়লা হিন্দালকো পেয়েছে। বাকি ৮৫ শতাংশ গিয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার কাছে। তা হলে কী ভাবে এই সিদ্ধান্ত ‘জনস্বার্থ-বিরোধী’ হতে পারে?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE