Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

ডি ভোটার সন্দেহে বন্দি আদিবাসী রমণী

আদিবাসী রমণীকেও বিদেশি হিসেবে চিহ্নিত করা হল কাছাড়ে! ২০ দিন ধরে জেলে বন্দি রয়েছেন তিনি। ‘ডাউটফুল’ ভোটার (ডি ভোটার), এনআরসি নিয়ে নেতাদের তরজা বেড়েই চলেছে। কিন্তু সেই পরিস্থিতির মধ্যেই শচীন্দ্র গোস্বামীর বদলে সুচন্দ্রা তিন দিন জেলে থাকলেও কাউকে পাশে পান না। একই ভাবে ২০ দিন ধরে বন্দি রয়েছেন কাছাড়ের প্রতিমা পাহাড়ি। কেউ তাঁর খোঁজও নেয়নি।

উত্তম সাহা
শিলচর শেষ আপডেট: ১৬ জুন ২০১৫ ০৩:২৮
Share: Save:

আদিবাসী রমণীকেও বিদেশি হিসেবে চিহ্নিত করা হল কাছাড়ে! ২০ দিন ধরে জেলে বন্দি রয়েছেন তিনি।

‘ডাউটফুল’ ভোটার (ডি ভোটার), এনআরসি নিয়ে নেতাদের তরজা বেড়েই চলেছে। কিন্তু সেই পরিস্থিতির মধ্যেই শচীন্দ্র গোস্বামীর বদলে সুচন্দ্রা তিন দিন জেলে থাকলেও কাউকে পাশে পান না। একই ভাবে ২০ দিন ধরে বন্দি রয়েছেন কাছাড়ের প্রতিমা পাহাড়ি। কেউ তাঁর খোঁজও নেয়নি।

ভুবনহিল পঞ্চায়েতের প্রতিমাদেবীকে প্রথমে ‘ডি ভোটার’ হিসেবে সন্দেহ করেছিল পুলিশ। মামলা যায় ফরেনার্স ট্রাইব্যুনালে। বিচারক তাঁকে বিদেশি বলে রায় দেন। বিচারপ্রক্রিয়ার খবর জানতে পারেননি প্রতিমাদেবী, তাঁর স্বামী মতিলাল পাহাড়ি।

স্থানীয় সূত্রে খবর, ২৬ মে স্বামী-স্ত্রী ক্ষেতে কাজ করছিলেন। ঘরে ছিল তাঁদের ৬ সন্তান। ছোট ছেলে দু’বছরের। মা কাজ সেরে ফিরলে দুধ খাওয়ার অপেক্ষায় বসেছিল। পুলিশ ওই দম্পতির কোনও কথা শুনতে রাজি হয়নি। ক্ষেত থেকেই তুলে নিয়ে যায় প্রতিমাদেবীকে। ডাক্তারি পরীক্ষার পর সোজা জেলে।

প্রতিমাদেবী আজও জানেন না, কী তাঁর অপরাধ। ডি ভোটার, ফরেনার্স ট্রাইব্যুনাল শব্দগুলি অচেনা তাঁর কাছে। কী কী দোষ করলে এক জন ডি ভোটার হিসেবে চিহ্নিত হন, তা জানেন না মতিলালও। প্রতিমা-মতিলাল, দু’জনেরই জন্ম কাছাড় জেলায়। প্রতিমা ছিলেন ভুবনহিল পঞ্চায়েতের ভুবননগরে। মতিলাল একই পঞ্চায়েতের কালাখালে। দু’দশক আগে তাঁদের বিয়ে হয়। কবে, কোথা থেকে পূর্বপুরুষরা অসমে এসেছিলেন, সে সব জানা নেই দম্পতির। মা-বাবার মুখে মতিলাল শুনেছিলেন, শ’দেড়েক বছর আগে চা বাগানে কাজের জন্য তাঁদের পূর্বপুরুষদের এখানে নিয়ে এসেছিল ইংরেজ শাসকরা। এখন আর মতিলাল চা বাগানে কাজ করেন না। অনেক দিন ধরেই তিনি ক্ষেতমজুর। স্বামী-স্ত্রী-সন্তানের কেউ স্কুলের বারান্দায় পা রাখেননি। তাই বলে সমন পাঠানো হলে আদালতে হাজির হতে হয়, এইটুকু অজানা নয় মতিলালের। কিন্তু তাঁর অভিযোগ, তাঁদের হাতে কোনও সমন পৌঁছয়নি। খবর পাননি আদালতের নির্দেশেরও। ক্ষেত থেকে পুলিশ তাঁর স্ত্রীকে ধরে নিয়ে যাওয়ায় অসহায় মতিলাল। বিস্মিত ওই দম্পতির পড়শিরা।

বাংলাদেশ থেকে অনেকে বেআইনি ভাবে অসমে ঢুকে পড়েছে। সে দিকে তাকিয়ে অসমে শুরু হয়েছে বিদেশি খেদাও আন্দোলন, ডি ভোটার, ১৯৭১ সালের ২৪ মার্চের আগের কাগজ দেখানোর ব্যাপার। একমাত্র বঙ্গভাষীরাই রয়েছেন সন্দেহের তালিকায়। চা জনগোষ্ঠীর মহিলাকে কী ভাবে অনুপ্রবেশকারী সন্দেহ করা হল, তারই উত্তর খুঁজছেন পরিজনরা। গ্রামবাসীদের দাবি, পুলিশ থানায় বসে ভোটার তালিকা দেখে ‘ডি ভোটার’ চিহ্নিত করে। বঙ্গভাষী ভেবে যেমন খুশি নামের পাশে ডি লিখে দেয়। প্রতিমা নামটিই আদিবাসী ওই রমণীর বিপদের কারণ হয়েছে। পুলিশ তাঁকে বাঙালি ভেবে ডি ভোটার হিসেবে চিহ্নিত করেছে।

যার ভুলেই হোক, প্রতিমাদেবী ও তাঁর স্বামী-সন্তানরা পড়েছেন বিপাকে। মায়ের জন্য কেঁদে আকুল দু’বছরের শিশু। এখনও স্পষ্ট করে কথা বলতে পারে না। আধো বুলিতে জানতে চায়— মা কোথায়। জবাব খুঁজে পাননি মতিলাল। স্ত্রীর জামিনের টাকা জোগাড়ের জন্য একমাত্র গরু বিক্রি করে দিয়েছেন। আইনজীবীর সঙ্গে কথা বলেছেন। কিন্তু নথিপত্রের জন্য জামিনের আবেদন করতে পারছেন না। শিক্ষার অভাবে আদিবাসীদের অধিকাংশের হাতে নাগরিকত্ব প্রমাণের কোনও কাগজ নেই। কোনও নথি যত্ন করে রাখার জায়গাও নেই তাঁদের একচিলতে কুঁড়েঘরে।

শুধু প্রতিমাদেবীই নন, একই দিন ওই একই এলাকা থেকে ধরে জেলে ঢোকানো হয়েছে শিপ্রা দাস নামে এক বধূকে। তাঁর জন্মও কাছাড় জেলায়, দিদারখুশ পঞ্চায়েতের হরিণাবস্তিতে। স্বামী দিনমজুর অজিত দাস। স্ত্রীর জামিনের জন্য হন্যে হয়ে ঘুরছেন। কিন্তু এখনও পর্যন্ত কাউকে পাশে পাননি।

যখনই যিনি ভারতে এসেছিলেন না কেন, হিন্দুদের চিন্তার কোনও কারণ নেই— এই আশ্বাস দিয়ে চলেছেন বিজেপি নেতারা। কিন্তু প্রতিমা পাহাড়ি, শিপ্রা দাসদের গ্রেফতারের খবর জানা নেই অসমে দলের সাধারণ সম্পাদক রাজদীপ রায় বা মুখপাত্র অবধেশ সিংহের। তাঁদের বক্তব্য— ‘আমাদের কেউ কিছু বলেননি। খোঁজ নেব।’

অন্য দিকে, রাজ্যের পরিবহণ, আবগারি, ক্রীড়া এবং যুবকল্যাণ মন্ত্রী অজিত সিংহ বরাক চা শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক। তাঁর কথায়, ‘‘চা জনগোষ্ঠীর মহিলার কারাবাসের কথা জেনেছি। খবর পাঠিয়েছি, কাগজপত্র নিয়ে দেখা করতে বলেছি।’’ কিন্তু কাকে দিয়ে খবর পাঠালেন, কেউ জানেন না। মতিলালের কাছে মন্ত্রীর বার্তা পৌঁছয়নি এখনও। প্রতিমা-শিপ্রাদের নিয়ে তবে কী করা? নিরুত্তর পেশায় আইনজীবী, সাংসদ সুস্মিতা দেবও।

রাজনৈতিক নেতাদের ভূমিকায় ক্ষোভ ব্যক্ত করেছে সারা ভারত কৃষক শ্রমিক মহাসমিতি। প্রতিমা-শিপ্রার মুক্তির দাবিতে তাঁরা আন্দোলনে নামছেন। প্রথম দফায় ৩০ জুন জেলাশাসকের কার্যালয়ের সামনে ধর্নায় বসবেন সমিতির সদস্যরা। মহাসমিতির কাছাড় জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক শ্রীপদ ধর বললেন, ‘‘শুধু প্রতিমা-শিপ্রা নন, বহু লোকের নামে একতরফা রায় ঘোষণা করা হয়েছে। কোনও নোটিস কেউ পাননি। তাই রায়ের কথাও কেউ জানেন না।’’ প্রতিমাদেবীর মত চা জনগোষ্ঠীর মহিলার কারাবাসের ঘটনাকে তিনি দুর্ভাগ্যজনক বলে উল্লেখ করেন। তাঁর কথায়, ‘‘ওঁরা আদিবাসী। পশ্চিমবঙ্গ, বিহার, ওড়িশা-সহ ভারতের বিভিন্ন জায়গা থেকে এখানে এসেছেন। তাঁদের কী ভাবে বিদেশি বলে সন্দেহ করা যায়!’’ বিদেশির নামে ভারতীয়দের হেনস্থা বন্ধ করার দাবি করেন শ্রীপদবাবু।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE