Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪
সিপিএমে সীতায়ন

বুদ্ধ-ভিএসের ব্যাটে জয়, পাশে কারাটও

সরে দাঁড়ালেন রামচন্দ্র! টানটান উত্তেজনার লড়াইয়ে বাজিমাত করলেন সীতা! সিপিএমের নতুন সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব গেল সীতারাম ইয়েচুরির হাতেই। দলের রাজ্যসভার নেতাকেই প্রকাশ কারাটের উত্তরসূরি হিসেবে বেছে নিল সিপিএমের ২১তম পার্টি কংগ্রেস। ইয়েচুরির চেয়ে বয়সে ১৫ বছরের বড় এস রামচন্দ্রন পিল্লাইকে দলের বড় অংশই নতুন কাণ্ডারী হিসেবে মেনে নিতে রাজি নয় বুঝে পার্টি কংগ্রেসের শেষ দিন নতুন কেন্দ্রীয় কমিটির সামনে সীতারামের নামই প্রস্তাব করলেন বিদায়ী সাধারণ সম্পাদক প্রকাশ।

অতীত ও বর্তমান। সিপিএমের পার্টি কংগ্রেস মঞ্চে সীতারাম ইয়েচুরি। পিছনে রয়েছেন প্রকাশ কারাট। রবিবার বিশাখাপত্তনমে। ছবি: পিটিআই।

অতীত ও বর্তমান। সিপিএমের পার্টি কংগ্রেস মঞ্চে সীতারাম ইয়েচুরি। পিছনে রয়েছেন প্রকাশ কারাট। রবিবার বিশাখাপত্তনমে। ছবি: পিটিআই।

সন্দীপন চক্রবর্তী, প্রেমাংশু চৌধুরী
বিশাখাপত্তনম শেষ আপডেট: ২০ এপ্রিল ২০১৫ ০৩:৪৭
Share: Save:

সরে দাঁড়ালেন রামচন্দ্র! টানটান উত্তেজনার লড়াইয়ে বাজিমাত করলেন সীতা!

সিপিএমের নতুন সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব গেল সীতারাম ইয়েচুরির হাতেই। দলের রাজ্যসভার নেতাকেই প্রকাশ কারাটের উত্তরসূরি হিসেবে বেছে নিল সিপিএমের ২১তম পার্টি কংগ্রেস। ইয়েচুরির চেয়ে বয়সে ১৫ বছরের বড় এস রামচন্দ্রন পিল্লাইকে দলের বড় অংশই নতুন কাণ্ডারী হিসেবে মেনে নিতে রাজি নয় বুঝে পার্টি কংগ্রেসের শেষ দিন নতুন কেন্দ্রীয় কমিটির সামনে সীতারামের নামই প্রস্তাব করলেন বিদায়ী সাধারণ সম্পাদক প্রকাশ। ভোটাভুটির অপ্রীতিকর পরিস্থিতি এড়িয়ে বিশাখাপত্তনমে শেষ পর্যন্ত মধুরেণ সমাপয়েত্ হল!

ইয়েচুরি অবশ্য বিলক্ষণ জানেন, সঙ্কটের সময়ে কাঁটার মুকুট চাপল তাঁর মাথায়! নাম ঘোষণার পরেই সিপিএমের নতুন সাধারণ সম্পাদক তাই বলেছেন, ‘‘দল যে গুরুদায়িত্ব আমাকে দিয়েছে, সাধ্যমতো তা পালন করার চেষ্টা করব। সামনে অনেক বড় চ্যালেঞ্জ। সকলকে সঙ্গে নিয়ে যৌথ ভাবেই পরিস্থিতির মোকাবিলা করে এগোতে হবে আমাদের।’’ গোটা দেশে কোণঠাসা হয়ে পড়া সিপিএম যে এখন নবীন প্রজন্মকে বিশেষ আকর্ষণ করতে পারছে না, খোলাখুলিই তা মেনে নিয়েছেন ইয়েচুরি। এবং বুঝিয়ে দিয়েছেন, নবীনদের আবার সিপিএমের দিকে ফেরানোই হবে তাঁর অন্যতম লক্ষ্য।

ভোটব্যাঙ্কে লাগাতার রক্তক্ষরণ চলছে। পশ্চিমবঙ্গের মতো এক সময়ের শক্ত ঘাঁটিতেও সংগঠন এখন রক্তশূন্য। এমন বিপর্যস্ত সিপিএমে এই মুহূর্তে ইয়েচুরির চেয়ে সার্বিক গ্রহণযোগ্য কোনও মুখ ছিল না। তবু তাঁর অভিষেক সম্পন্ন হল ঘোর নাটকীয় ঘটনাবলি পেরিয়ে! স্বয়ং কারাট শেষ পর্যন্ত ইয়েচুরির পিছনে এসে না দাঁড়ালে কেরল সিপিএমের গোটা রাজ্য নেতৃত্বের সমর্থন জোগাড় করা যেমন মুশকিল ছিল, তেমনই পর্দার আড়ালে এই পর্বান্তরে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থেকে গেল দুই রাজ্যের দুই প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীর। দু’জনেই এ বার কেন্দ্রীয় কমিটির পূর্ণাঙ্গ সদস্যপদ থেকে অব্যাহতি পেয়েছেন। এক জন সশরীর হাজির ছিলেন না বিশাখাপত্তনমে। আর এক জন ছিলেন, তবে নিজের রাজ্যের দলীয় নেতৃত্বের চক্ষুশূল হয়ে! তবু তাঁরাই জান লড়িয়ে ব্যাট করে গেলেন ইয়েচুরির জন্য!

প্রথম জন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। তাঁর পছন্দ যে ইয়েচুরিই, কারও অজানা ছিল না। কিন্তু শনিবার বেশি রাতে বিদায়ী পলিটব্যুরোয় যখন কিছুতেই ঐকমত্য হচ্ছে না, তখনও কলকাতায় বসে দৃঢ় ভাবে নিজের পছন্দের নেতার পক্ষে সওয়াল করে গিয়েছেন বুদ্ধবাবু। কারাট প্রথমেই নিজের মত চাপিয়ে না দিয়ে অন্যদের মতামত চেয়েছিলেন। পলিটব্যুরোয় কেরলের পিনারাই বিজয়ন, কোডিয়ারি বালকৃষ্ণনেরা কিছুতেই ইয়েচুরিকে মেনে নিতে রাজি হচ্ছিলেন না। তাঁদের সমর্থন ছিল কেরলের এস আর পিল্লাইয়ের দিকে। আর বুদ্ধবাবুর নেতৃত্বে নিরুপম সেন (শারীরিক ভাবে উপস্থিত না থেকেও), সূর্যকান্ত মিশ্র, বিমান বসুরা একজোট হয়েছিলেন এ রাজ্য থেকে নির্বাচিত রাজ্যসভার সাংসদ ইয়েচুরির পক্ষে। তাঁরা পাশে পেয়েছিলেন ত্রিপুরার মানিক সরকারকেও। কিন্তু কেরলের আপত্তিতেই শনিবার রাতে আড়াই ঘণ্টা আলোচনা করেও পলিটব্যুরোয় জটিলতা কাটানো যাচ্ছিল না! উল্টো দিকে বুদ্ধবাবুও আপস করতে নারাজ ছিলেন! অতীতে ইএমএস নাম্বুদিরিপাদের জায়গায় হরকিষেণ সিংহ সুরজিত্‌কে সাধারণ সম্পাদক করার সময় জ্যোতি বসুর যেমন উল্লেখযোগ্য ভূমিকা ছিল, ইয়েচুরির বেলায় তেমনই অবদান থেকে গেল বুদ্ধবাবুর।

বুদ্ধবাবু যদি রাত পর্যন্ত ব্যাট করে থাকেন, তা হলে সকালে ঠিক সেখান থেকেই ইনিংস ধরে নেন ভি এস অচ্যুতানন্দন। বিদায়ী কেন্দ্রীয় কমিটিতে গুরুত্বপূর্ণ রাজ্যগুলির সদস্যদের সঙ্গে এ দিন সকালে আলোচনায় বসেছিলেন কারাট। সেখানেই কেরলের বিরোধী দলনেতা পরিষ্কার জানিয়ে দেন, দলীয় নেতৃত্ব আনুষ্ঠানিক ভাবে পিল্লাইয়ের নাম প্রস্তাব করলে তিনিও সীতারামের নাম পাল্টা প্রস্তাব করবেন! সেই প্রস্তাবে কেউ এক জন সমর্থন দিয়ে দিলেই নতুন কেন্দ্রীয় কমিটিতে ভোটাভুটি করতে হবে! ঠিক এই রকমই পরিস্থিতি হয়েছিল ইএমএসের বদলে সুরজিত্‌কে দায়িত্ব দিতে চাওয়ার সময়। সে বার পরিস্থিতি সামাল দেওয়া হয়েছিল মধ্যাহ্নভোজের বিরতি ডেকে দিয়ে। এ বার কারাট অবশ্য নিজেই চাননি দায়িত্ব হস্তান্তর কেন্দ্রীয় কমিটিতে ভোটাভুটির দিকে গড়াক। কারাটের কথায়, ‘‘আমি বিদায়ী সাধারণ সম্পাদক হিসেবে সীতারামের নাম প্রস্তাব করেছি। সর্বসম্মতিতে সীতারাম সাধারণ সম্পাদক হয়েছেন।’’ ইয়েচুরির নেতৃত্বাধীন পলিটব্যুরোর এক জন সদস্য হিসেবেই এখন থেকে কাজ করবেন কারাট। যেমন বাংলায় সূর্যবাবুকে দায়িত্ব ছেড়ে দিয়ে কাজ করছেন বিমানবাবু।

এই নাটকীয় পর্ব পেরিয়ে ইয়েচুরির সাধারণ সম্পাদক পদে অধিষ্ঠান সিপিএমের রাজনীতিতে অবশ্য বেশ কিছু পরিবর্তনের ইঙ্গিতবাহী বলেই দলীয় সূত্রের ব্যাখ্যা। প্রথমত, সাধারণ সম্পাদক নিজেই রাজ্যসভার দলনেতা। তাঁর নেতৃত্বাধীন পলিটব্যুরোয় মহম্মদ সেলিম লোকসভার সাংসদ, আর এক নতুন মুখ হান্নান মোল্লাও প্রাক্তন সাংসদ। মানিক সরকার, সূর্যকান্ত, বালকৃষ্ণন, এম এ বেবিরা বিধায়ক। সংসদীয় রাজনীতির সঙ্গে সিপিএমের সংগঠনের শীর্ষ স্তরে এতটা মেলবন্ধন দলের ভাবনাচিন্তাকে নির্বাচনী রাজনীতির পক্ষে অনেকটা ‘বাস্তবমুখী’ করবে বলেই দলের বড় অংশের ধারণা।

দ্বিতীয়ত, ইয়েচুরির পরিচয় উদারপন্থী নেতা হিসেবেই। সংসদের ভিতরে-বাইরে বহু দলের সঙ্গে তাঁর সমন্বয় এই সিপিএমে যে কারও চেয়ে ভাল। সংসদের ভিতরে তিনি যেমন তৃণমূলের ডেরেক ও’ব্রায়েনের সঙ্গে প্রয়োজনে কক্ষ সমন্বয় করতে পারেন, তেমনই সংসদের বাইরে সনিয়া গাঁধীর সঙ্গে বিজেপির বিরুদ্ধে পথে নামতে পারেন। সিপিএমের মতো দলে সাধারণ সম্পাদক ব্যক্তিগত ভাবে যে কোনও সিদ্ধান্ত নিয়ে বসতে পারেন না ঠিকই। কিন্তু ইয়েচুরি দায়িত্বে আসায় তাঁদের সঙ্গে বামেদের সমন্বয় বাড়বে বলেই কংগ্রেস নেতৃত্বের একাংশের আশা। আবার বিজেপির একাংশের আশঙ্কা, কংগ্রেস থেকে জনতা পরিবার— সকলের সঙ্গে তাল মিলিয়ে নরেন্দ্র মোদীর সরকারের বিরুদ্ধে বৃহত্তর বিরোধী জোটের কারিগর হয়ে উঠতে পারেন ইয়েচুরি। আরএসপি-র অবনী রায়ের মতো ঘরের বন্ধুরা তো বলেই দিচ্ছেন, ‘‘সীতারাম দায়িত্বে আসায় বাম ঐক্য আরও শক্তিশালী হবে।’’

তৃতীয়ত এবং সিপিএমের জন্য আরও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, মার্ক্সবাদী তত্ত্ব গুলে খেলেও কঠোর বাস্তবের ভাষায় কথা বলতে জানেন ইয়েচুরি। কোঝিকোড়ে গত পার্টি কংগ্রেসে দলের মতাদর্শগত দলিল তিনিই তৈরি করেছিলেন। আবার তিনিই এই পার্টি কংগ্রেসে আসার দিনকয়েক আগে বণিকসভার আমন্ত্রণে গিয়ে শিল্পায়নের নীতির পক্ষে সওয়াল করে এসেছেন। যা আসলে বুদ্ধবাবুদের লাইন। তত্ত্বের গুরুত্ব অস্বীকার না করেও বাস্তবের প্রয়োজন বুঝে নেওয়ার দক্ষতার জন্যই বাম কর্মী-সমর্থকদের বাইরে আরও নতুন নতুন মানুষের কাছে নিজেদের বক্তব্য ইয়েচুরি পৌঁছ দিতে পারবেন বলেই সিপিএম আশা করছে।

ইয়েচুরি নিজে অবশ্য বলছেন, ‘‘পার্টি কংগ্রেসে বসে শুধু দলের রাজনৈতিক ও কৌশলগত লাইন ঠিক করলেই তো হল না! সংগঠন ছাড়া সে সব বাস্তবায়িত হবে কী করে? সংগঠনের হাল ফেরানো তাই প্রধান কাজ। এই লক্ষ্যেই চলতি বছরে দলের সাংগঠনিক প্লেনাম হবে।’’ প্রতিটা রাজ্য শাখার কাছে তার জন্য প্রশ্নমালা পাঠাবে নতুন পলিটব্যুরো। রাজ্যগুলোর উত্তর পেয়ে তার পরে সাংগঠনিক দাওয়াইয়ের খোঁজে প্লেনামের রিপোর্ট তৈরি করবেন কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব।

ইয়েচুরির নেতৃত্বে এ বার ১৬ সদস্যের নতুন পলিটব্যুরো তৈরি হয়েছে। শারীরিক কারণে বুদ্ধ-নিরুপম অব্যাহতি পেয়েছেন। ভি এস এবং মহম্মদ আমিনের মতোই তাঁরা এখন থেকে কেন্দ্রীয় কমিটির বিশেষ আমন্ত্রিত সদস্য। পলিটব্যুরো থেকে বাদ পড়েছেন কৃষক নেতা কে বরদারাজন। সেলিম-হান্নানের পাশাপাশি পলিটব্যুরোয় এসেছেন সুভাষিণী আলি ও তামিলনাড়ু সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক জি রামকৃষ্ণন। বিশাখাপত্তনমে পার্টি কংগ্রেসের মঞ্চে অন্তিম লগ্নে নতুন পলিটব্যুরোর বাকি ১৫ জনের নাম পড়ে দিয়ে ইয়েচুরি বলেছেন, ‘‘আমি এঁদের মধ্যে ষোড়শ ব্যক্তি!’’ যা শুনে পরে দলের এক পলিটব্যুরো সদস্যের মন্তব্য, ‘‘সীতারাম একশো শতাংশ টিম ম্যান! দলটার ভাল হবে।’’ তবে সত্যিই কতটা ভাল, উত্তর ভবিষ্যতে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE