রাজ্যে জাতীয় নাগরিক পঞ্জির (এনআরসি) কাজ বন্ধ রাখার দাবি তুলল অসম নাগরিক মঞ্চ। কার্যত মুখ্যমন্ত্রী ও কংগ্রেস দলের মতের বিরুদ্ধে গিয়েই এই দাবি তুললেন মঞ্চের সভাপতি ও প্রাক্তন মন্ত্রী তথা হোজাইয়ের কংগ্রেস বিধায়ক অর্ধেন্দু দে। তাঁর সঙ্গে আছেন আরও এক প্রাক্তন মন্ত্রী তথা মুখ্যমন্ত্রীর বরাক বিষয়ক উপদেষ্টা, কাটলিচেরার বিধায়ক গৌতম রায়, লামডিং-এর বিধায়ক স্বপন কর ও শিলচরের সাংসদ সুস্মিতা দেব।
বরাক-ব্রহ্মপুত্র-বড়োভূমির ছ’শোর বেশি প্রতিনিধি নগাঁও জেলার হোজাইয়ে সমবেত হয়ে এই অরাজনৈতিক মঞ্চটি গঠন করেছেন। মঞ্চের উদ্যোগে আগামী ১৯ জুলাই কংগ্রেস, অগপ, বিজেপি, আসু, কৃষক মুক্তি সংগ্রাম সমিতি-সহ রাজ্যের সব দল-সংগঠনের প্রতিনিধিদের নিয়ে একটি গণ-সমাবেশের আয়োজন করা হয়েছে। মঞ্চের নেতাদের বক্তব্য, ‘‘ত্রুটিপূর্ণ এনআরসি প্রক্রিয়া কেবল বাংলাদেশ থেকে আসা হিন্দু বাঙালি নয়, ভিন রাজ্যের নাগরিক, চা-জনগোষ্ঠী-সহ অনেককেই সমস্যায় ফেলেছে। তাই এ নিয়ে বিধানসভার বিশেষ অধিবেশন ডাকার দাবি জানিয়েছেন তাঁরা। সুস্মিতাদেবী জানান, প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে এনআরসি প্রক্রিয়া আপাতত স্থগিত রাখার আর্জি জানাবেন তাঁরা।
বরাকের চার বিধায়ক ও অর্ধেন্দুবাবু সম্প্রতি ২০১৪ সালের ভোটার তালিকাকে নাগরিক পঞ্জি বা এনআরসির ভিত্তি করার দাবি জানান। এরপরেই মুখ্যমন্ত্রী বিবৃতি পাঠিয়ে জানান, ২০১৪ সালের ভোটার তালিকায় থাকা সকলেই যেহেতু নিয়মানুযায়ী ভারতীয় নাগরিক হিসেবে স্বীকৃত, সেই কারণে তাঁদের নাম এনআরসিতে স্বাভাবিকভাবেই অন্তর্ভূক্ত করা উচিত। তিনি বলেন, এ নিয়ে রেজিস্ট্রার জেনারেল অফ ইন্ডিয়ার কাছে সুপারিশ পাঠাবে রাজ্য। বিষয়টি যেহেতু সুপ্রিম কোর্টের বিচারাধীন তাই প্রয়োজনে সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হওয়ার কথাও রাজ্য ভাবতে শুরু করেছে। কংগ্রেস দলের তরফে সাংবাদিক সম্মেলন করে ঘোষণা করা হয়, ‘‘কোনও ভারতীয়র নাম যাতে এনআরসি থেকে বাদ না যায় তা নিশ্চিত করা কংগ্রেসের দায়িত্ব। তবে এ নিয়ে কেন্দ্র বা সুপ্রিম কোর্টের তরফে কোনও নতুন নির্দেশ না আসা অবধি বর্তমান পদ্ধতিতেই এনআরসির কাজ চলবে। কিন্তু সুস্মিতাদেবী, গৌতমবাবু, অর্ধেন্দুবাবুরা অবিলম্বে চলতি প্রক্রিয়া বন্ধের পক্ষে।
এনআরসি ফর্ম জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ৩১ জুলাই। নির্দিষ্ট সময় থেকে প্রায় দু’মাস পরে এনআরসির ফর্ম বিলি শুরু হলেও জমা দেওয়ার শেষ তারিখ পিছনো হয়নি। তার উপরে জটিল ফর্ম পূরণ করতে গিয়ে চা-শ্রমিক, পাহাড়ে বসবাসকারী মানুষ, নিরক্ষর ব্যক্তিরা নাজেহাল হচ্ছেন। রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে ২০০ থেকে ৫০০ টাকার বিনিময়ে ফর্ম পূরণের অসাধু চক্র গড়ে উঠেছে। পাশাপাশি, এনআরসির জন্য প্রয়োজনীয় লিগ্যাসি ডাটা জোগাড় করতে গিয়েও হিমসিম খাচ্ছেন মানুষ। বিশেষ করে চা-শ্রমিক ও প্রত্যন্ত অঞ্চলে থাকা উপজাতি সম্প্রদায়ের কাছে সরকার স্বীকৃত প্রমাণপত্র নেই। অনেকের জমির পাট্টাও নেই। এখন অবধি রাজ্যের তিন কোটি মানুষের মধ্যে দেড় কোটির বেশি মানুষ লিগ্যাসি ডাটা জোগাড়ই করতে পারেননি। ১৯৭১ সালের পরে রাজ্যে আসা ভারতের অন্য রাজ্যের মানুষদের নামও এনআরসিতে অন্তর্ভুক্ত না হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। উপযুত্ত তথ্যপ্রমাণ জোগাড় করতে না পেরে ইতিমধ্যেই বোকাজানে আনারকলি নামে এক মহিলা আত্মহত্যার চেষ্টা করেছেনয় হোজাইয়ে নারায়ণ মজুমদার নামে এক বৃদ্ধ হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গিয়েছেন।
এই পরিস্থিতিতে, এনআরসি সংক্রান্ত সাব-কমিটির সদস্য থাকা, তিনবারের মন্ত্রী অর্ধেন্দু দের সভাপতিত্বে তৈরি নাগরিক মঞ্চ ১১ দফা দাবি তুলেছে। তাঁরা জানিয়েছেন, ২০১৪ সালের ভোটার তালিকার ভিত্তিতে এনআরসি সংশোধন করা হোক। কারণ অসম চুক্তির পরে, ১৯৭১ সালের ভোটার তালিকা তৈরি হয়। তার ভিত্তিতেই প্রফুল্ল মহন্তর আমলে ১৯৯৭ সালে ভোটার তালিকা ঢেলে সাজা হয়েছিল। তখনই সন্দেহজনক ভোটারদের ডি বা ডাউটফুল ভোটার তালিকাভুক্ত করে মূল ভোটার তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়। এরপর প্রতি ৫ বছর অন্তর ভোটার তালিকা সংশোধন করা হয়েছে। অতএব ২০১৪ সালের ভোটার তালিকা বাংলাদেশিমুক্ত বলে ধরে নেওয়া যায়। তাঁদের আরও দাবি, দেশভাগের সময় বা তার পরে, ধর্মীয় চাপে ভারতে আশ্রয় নেওয়া হিন্দু, বৌদ্ধ, জৈনদের নাগরিকত্ব দিতে হবে। সে ক্ষেত্রে কোনও ভিত্তিবর্ষই থাকা চলবে না।
একই ভাবে ভিন রাজ্য থেকে ব্যবসা, চাকরি বা বৈবাহিক সূত্রে ১৯৭১ সালের পরে অসমে এসে বসবাস করা ব্যক্তিদের নামও এনআরসিতে তুলতে হবে। কারণ এনআরসি অসমের নাগরিক পঞ্জি নয়, জাতীয় নাগরিক পঞ্জি। তাই ভারতের অন্য রাজ্যের নাগরিকদের নাম সেখানে থাকতে বাধ্য। অসমের অনেকে অবিভক্ত মেঘালয়ের বাসিন্দা ছিলেন। তাঁরা ১৯৭২ সালে মেঘালয় তৈরি হওয়ার পরে অসমে এসেছেন। তাঁদের নামও এনআরসিতে রাখতে হবে। অসমে থাকা নেপালি, মণিপুরি, বিহারি, মাড়ওয়ারি সম্প্রদায়ের মানুষদের ক্ষেত্রে ও বাইরের রাজ্য থেকে আসা তাঁদের স্ত্রীদের ক্ষেত্রে এনআরসিতে নাম তোলার কোনও ভিত্তিবর্ষ থাকা চলবে না। ভূমিপুত্র উপজাতিদের ক্ষেত্রে কোনও প্রমাণ ছাড়াই এনআরসিতে নাম তুলতে হবে। যে কোনও বছরে হওয়া পাসপোর্ট, পিআরসি, রেশন কার্ড, সচিত্র ভোটার পরিচয়পত্র প্রামান্য নথি হিসাবে গ্রহণ করতে হবে। চা-শ্রমিকদের ক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষের দেওয়া শংসাপত্রই গ্রাহ্য করতে হবে। অর্ধেন্দুবাবু মেনে নেন, ‘‘এনআরসি সংক্রান্ত মন্ত্রিসভার সাব-কমিটিতে থাকার সময়ই আমার এ নিয়ে সরব হওয়া উচিত ছিল।’’
সুস্মিতাদেবী ফোনে বলেন, ‘‘এই নিয়ে আমাদের সঙ্গে রাজ্য সরকারের কোনও সংঘাত নেই। মুখ্যমন্ত্রী কেন্দ্রকে প্রস্তাব দেওয়ার পরে কেন্দ্র তা সুপ্রিম কোর্টে জানাবে। তার পরে আদালত চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে। এটি সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। তাই আপাতত এনআরসি প্রক্রিয়া স্থগিত রাখাই ভাল। আমি অর্ধেন্দুবাবুকে বলেছি, মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলে দিল্লি আসুন। আমরা এ নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে এনআরসি প্রক্রিয়া স্থগিত করার জন্য আর্জি জানাই।’’
এনআরসি প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে আসাম পাবলিক ওয়ার্কস ও বরাক উপত্যকা মানবাধিকার সুরক্ষা সমিতি সুপ্রিম কোর্টে মামলা করেছে। আসাম পাবলিক ওয়ার্কসের দাবি, অসমের ভূমিপুত্র উপজাতি, যাদের পদবিগুলি কেবল অসমেই রয়েছে, তাদের নাম প্রমাণপত্র ছাড়াই এনআরসিতে তুলতে হবে। অন্য দিকে, বরাক উপত্যার সংগঠনটির দাবি, এনআরসি নিয়ে বিভিন্ন সমস্যার সমাধান না হওয়া অবধি কাজ বন্ধ রাখা হোক। তারা সুপ্রিম কোর্টের সংশ্লিষ্ট বেঞ্চেও বদল চেয়েছেন। সমিতির সভাপতি তথা নবগঠিত অসম নাগরিক মঞ্চের কার্যনির্বাহী সভাপতি, আইনজীবী নীলাদ্রি রায় বলেন, ‘‘এনআরসি নিয়ে যে মামলাগুলি চলছে আমরা সেগুলিতে সামিল হতে চেয়েছি। পাশাপাশি আমরা আবেদন জানিয়েছি, দুই সদস্যের বেঞ্চকে যেন পাঁচ সদস্যের বেঞ্চ করা হয়। দুই সদস্যের বেঞ্চে থাকা বিচারপতি রঞ্জন গগৈয়ের বিরুদ্ধে আমাদের ব্যক্তিগত কোনও অভিযোগ নেই। কিন্তু যেহেতু মামলার মুখ্য বিষয় অসমিয়া বনাম অ-অসমিয়া, সেই কারণে দুই বিচারপতির মধ্যে একজন অসমিয়া হলে পক্ষপাতিত্বের আশঙ্কা থাকে।’’ ১৪ জুলাই এ নিয়ে শুনানি রয়েছে। এনআরসি নিয়ে আদালতের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত না হওয়া অবধি প্রক্রিয়া স্থগিত রাখারও আর্জি জানিয়েছেন তাঁরা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy