Advertisement
১৬ এপ্রিল ২০২৪
National News

মোদী ও শাহের আমলে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলি লোপ পেতে বসেছে

স্থানীয় স্তরে হিন্দুত্ববাদের বিস্তার এবং কেন্দ্রীয় স্তরে সহায়ক সরকার গত চার বছরে সংখ্যালঘুদের ওপরে ক্রমবর্ধমান আক্রমণের জন্য দায়ী। যদিও এখানে আমাদের মনে রাখা দরকার যে এই দুটো বিষয় বাদ দিলেও ভারতবর্ষে ব্যক্তি এবং সম্প্রদায় বিশেষ কোনো না কোনো ভাবে হিংসার শিকার হয়েছে।

সংখ্যালঘুদের গণহত্যায় উদ্বেগ বেড়েছে দেশে। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।

সংখ্যালঘুদের গণহত্যায় উদ্বেগ বেড়েছে দেশে। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।

উজ্জ্বল কুমার চৌধুরী এবং সুনয়ন ভট্টাচার্য
শেষ আপডেট: ১৬ জুলাই ২০১৮ ১৮:৩৭
Share: Save:

পরিস্থিতি এবং পরিসংখ্যান

গণপিটুনি দিয়ে কাউকে হত্যা করা একটি দণ্ডনীয় অপরাধ। কিন্তু আইপিসি অনুযায়ী এটি কোনও পৃথক অপরাধ নয়। তাই এই বিষয়ে জানতে হলে আমাদের গণমাধ্যম বা গবেষণাপত্র অধ্যয়ন করা ছাড়া কোনও গতি নেই।

রবিবার, ১ জুলাই, মহারাষ্ট্রের ধুলে জেলায় পাঁচ জন ভিক্ষুককে মর্মান্তিক ভাবে পিটিয়ে মারা হয়। গুজব রটেছিল যে ওই পাঁচ জন নাকি ছেলেধরা ছিল। ১৩ থেকে ২০ জুনের মধ্যে চার জন মুসলমানকে উত্তরপ্রদেশের হাপুর এবং ঝাড়খণ্ডের গোড্ডা এবং রামগড়ে পিটিয়ে মারা হয়। IndiaSpend নামক ভারতবর্ষের প্রথম পরিসংখ্যান-ভিত্তিক সাংবাদিকতা প্ল্যাটফর্ম কিছু দিন আগে একটি ভয়ঙ্কর তথ্য সরবরাহ করেছিল। তাদের তদন্ত অনুযায়ী, ২০১০ থেকে ২০১৭ পর্যন্ত গাভী-সম্পর্কিত ৬০টি হিংসাকাণ্ডে ২৫ জন খুন হয়েছেন। এখানে বলে রাখা ভাল যে এর মধ্যে ৯৭ শতাংশ কাণ্ড মোদী ক্ষমতাসীন হওয়ার পরে ঘটেছে এবং মৃত ব্যক্তিদের মধ্যে ৮৪ শতাংশই মুসলমান। দক্ষিণপন্থী বৌদ্ধিক সংস্থা অবজার্ভার রিসার্চ ফাউন্ডেশন একটি গবেষণা সংগঠিত করেছিল। সেই গবেষণা অনুযায়ী গাভী-সম্পর্কিত হিংসাকাণ্ডের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য ভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। যেখানে ২০০৫ সনে গাভী-সম্পর্কিত হিংসাকাণ্ডের সংখ্যা মোট হিংসাকাণ্ডের ৫ শতাংশ ছিল, সেখানে ২০১৭-র জুন অবধি সেই সংখ্যা ২০ শতাংশে দাঁড়িয়েছে।

গণপিটুনির নিরিখে সন্দেহাতীত ভাবে এটা বলা যেতে পারে যে বহু জায়গায় আঞ্চলিক গাভী-সুরক্ষা বাহিনীগুলো অসহায় মানুষের মৃত্যুর পেছনে প্রধান ভূমিকা পালন করেছে। বহু ক্ষেত্রে সামাজিক মাধ্যমকে মিথ্যা ও প্ররোচনামূলক সংবাদ বিস্তার করার কাজে ব্যবহার করা হয়েছে। অনেক সময়েই পুলিশ নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করেছে এবং গাভি-সুরক্ষা আইনের সাহায্য নিয়ে ক্ষতিগ্রস্তদের বিরুদ্ধে বিরুদ্ধেই মামলা করেছে।

আরও পড়ুন
মোদীর চাপ বাড়াতে আজ বৈঠকে রাহুল

পুরাতন মালদহের সাহাপুর পঞ্চায়েতে ছেলেধরা সন্দেহে এক যুবককে নগ্ন করে গণপিটুনি। —ফাইল চিত্র।

স্থানীয় স্তরে হিন্দুত্ববাদের বিস্তার এবং কেন্দ্রীয় স্তরে সহায়ক সরকার গত চার বছরে সংখ্যালঘুদের ওপরে ক্রমবর্ধমান আক্রমণের জন্য দায়ী। যদিও এখানে আমাদের মনে রাখা দরকার যে এই দুটো বিষয় বাদ দিলেও ভারতবর্ষে ব্যক্তি এবং সম্প্রদায় বিশেষ কোনো না কোনো ভাবে হিংসার শিকার হয়েছে। সমাজও মাঝে মধ্যে এই হিংসাকে পরোক্ষয়ে সমর্থন যোগায়। হাজার হাজার বছর ধরে দলিতদের তীব্র বঞ্চনার এবং হিংসার শিকার হতে হয়েছে। সাংবিধানিক সুরক্ষা থাকা সত্ত্বেও দলিতদের আজও দৈনন্দিন অপমান সহ্য করতে হয়। যদি আমরা ভারতবর্ষের আধুনিক ইতিহাস পর্যালোচনা করি, তা হলে দেখতে পাব, দলিতদের শ্রেণিহিন্দুরা বিভিন্ন সময়ে গণহত্যা করেছে। কিলভেনমনি, বাথানিতোলা, লক্ষ্মণপুরা বাথে এবং খৈরলানজি আমাদের ইতিহাসে আজও কালো দাগ হিসেবে চিহ্নিত। সাম্প্রতিক কালের সংঘর্ষের মধ্যে আমরা উনা-র ঘটনার উল্লেখ করতে পারি যেখানে চার জন দলিত যুবককে গাভি-সুরক্ষা বাহিনী মৃত গাভীর চামড়া ছাড়ানোর ‘অপরাধ’-এ নির্দয় ভাবে প্রহার করেছিল। এই ঘটনার ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে ন্যায়বিচারের নামে ছড়িরে দেয়া হয়। ২০১৭ সনের বর্ষাকালীন অধিবেশনে সংসদে একটি প্রশ্নের জবাবে জানানো হয় যে ২০১৪ এবং ২০১৬-র মধ্যে ২৮৮টি খুন হয়েছে সম্মানরক্ষার নামে।

গণহত্যা: ফ্যাসিবাদের ঠিক আগের ধাপ

সংখ্যালঘুদের গণহত্যা একটি রাজনৈতিক সমস্যা। কিন্তু জাতিগত হিংসা এবং সম্মানরক্ষার নামে হত্যা সামাজিক পচনের লক্ষণ। রাজনৈতিক গুন্ডাবাহিনীর সৃষ্টি হয় কোনও একটি বিশেষ উদ্দেশ্য সফল করার জন্য, কিন্তু অসংঘটিত মানুষ যখন হত্যা করে তখন তার পেছনে কাজ করে কিছু মিথ্যে প্রতিশ্রুতি। অনেক সময়ে মানুষ নিজের হাতে আইন তুলে নেয় বিচারব্যবস্থা এবং প্রশাসনের প্রতি আস্থা হারিয়ে।

ভয়ের বিষয় হচ্ছে, বছরের শুরু থেকেই এমন কিছু রাজ্যে গণহত্যা সংগঠিত হচ্ছে যেখানে সম্প্রদায়গত হিংসা আগে উল্লেখযোগ্য ভাবে লক্ষ্য করা যায়নি। রাজ্যগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে তামিলনাড়ু, অন্ধ্রপ্রদেশ, তেলঙ্গানা এবং অসম। ছেলেধরা হওয়ার অভিযোগ সবচেয়ে সাধারণ কারণ হিসেবে লক্ষ্য করা গেছে। ছোটখাটো চুরি করা এবং জাদুবিদ্যা প্রয়োগ করা আরও দু’টি কারণ। আদিবাসী, মানসিক ভারসাম্যহীন ব্যক্তি, অভিবাসী কর্মীদল, একা মহিলা এবং পর্যটকেরা গণহত্যার বলি হয়েছেন। একটি রিপোর্ট অনুযায়ী (boomlive.in) ২০১৮-র প্রথমার্ধেই ১৩ জন গণহত্যার শিকার হয়েছেন। এই বিষয়টিকে সরকার শুধুমাত্র একটি অপরাধ হিসেবে গণ্য করছে, যদিও ভারতজুড়ে এর উপস্থিতি একেবারেই একটি সামাজিক অসুস্থতার লক্ষণ। সমষ্টিগত ভাবে আমরা হিংসার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারিনি। যে কোনও বিবেকসম্পন্ন ব্যক্তি গণহত্যার বিরোধী হতে বাধ্য। কিন্তু যে জিনিসের সব চাইতে বেশি প্রয়োজন তা হচ্ছে একটি সুচিন্তিত সামাজিক এবং রাজনৈতিক আন্দোলন। যে সমাজ গণহত্যাকে মেনে নেয়, সেই সমাজ কোনও দিন গণতান্ত্রিক হতে পারে না। যে সমাজ সামাজিক, পদ্ধতিগত এবং এলোমেলো হিংসাকে মেনে নেয়, সেই সমাজ যে কোনও সময়ে ফ্যাসিবাদের শিকার হতে পারে। ফ্যাসিবাদ মূলত গণতন্ত্রবিরোধী কারণ ফ্যাসিবাদ হিংসাকে একটি রাজনৈতিক উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করে বিশেষ বিশেষ রাজনৈতিক এবং সামাজিক দলের বিরুদ্ধে। যদি হিংসাকে সমর্থন জুগিয়ে ফ্যাসিবাদকে সহজ করে দেওয়া হয়, তা হলে হিংসার শিকড় আরও শক্ত হয়ে ওঠে। তাতে হিংসার বিরুদ্ধে লড়াই শুধুমাত্র একটি প্রহসনে পরিবর্তিত হয়।

হিন্দুদের ইতিহাস গাভীপূজনকে সমর্থন করে না

মহাভারত হোক বা রামায়ণ, কোনও হিন্দু গ্রন্থই গাভীপূজনকে সমর্থন করে না। স্বামী বিবেকানন্দ অথবা বি ডি সাভারকর, হিন্দু ধর্মের কোনও বিশেষজ্ঞই গাভীপূজনের পক্ষাবলম্বন করেননি। শুধু কি তাই, স্বামী বিবেকানন্দ মাদুরাইতে বলেছিলেন, “কোনও এক সময় ছিল যখন গোমাংস ভক্ষণ না করে কোনও ব্রাহ্মণ ব্রাহ্মণ থাকতেই পারতো না। বেদ অনুযায়ী, যখন কোনও সন্ন্যাসী বা রাজার মতো বিশেষ মানুষ আতিথ্য গ্রহণ করতেন, তখন বাড়ির সবচাইতে ভাল বলদ উৎসর্গ করা হত। কিন্তু সময়ের সঙ্গে আমরা কৃষিভিত্তিক জাতিতে পরিবর্তিত হই। তাই সবচাইতে ভাল বলদ উৎসর্গ করার অর্থ হয়ে দাঁড়াল জাতির নাশ।” সাভারকার ‘সমগ্র সাভারকার ভাঙমায়া’তে বলেছেন, “খাদ্য শারীরিক পুষ্টির জন্য প্রয়োজন। খাদ্যে ধার্মিক গুণাবলী আরোপ করলে তাকে ভগবানে পরিবর্তিত করা হয়। এই রকম কুসংস্কার দেশের সমষ্টিগত বুদ্ধি ক্ষয় করে। গাভীকে সংরক্ষণ করার কাজ যেন বৈজ্ঞানিক এবং অর্থনৈতিক মানদণ্ডে করা হয়।”

গণহত্যার আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট

আমরা যদি ইতিহাস ঘাঁটি তা হলে দেখতে পাব যে গণহত্যার শুরু উত্তর আমেরিকায়। ষোড়শ এবং সপ্তদশ শতাব্দীতে ইউরোপ থেকে আগত শ্বেতাঙ্গরা কাতারে কাতারে স্থানীয় আমেরিকানদের গণহত্যা করে তাদের জমি ছিনিয়ে নেয়। তার পরে শ্বেতাঙ্গরা আফ্রিকান-আমেরিকানদের মারা শুরু করে। ১৮৮২ এবং ১৯৬৮-র মাঝখানে ৩,৪৪৬ জন আফ্রিকান-আমেরিকানকে মারা হয়। ১৯১৯-এর কুখ্যাত ‘লাল গ্রীষ্মে’ বহু আফ্রিকান-আমেরিকান ওয়াশিংটন ডি সি-তে সাম্প্রদায়িকতা, বেকারত্ব, কমিউনিজম-বিরোধিতা এবং যুদ্ধ-পরবর্তী অতি-জাতীয়তাবাদের শিকার হয়ে মৃত্যুবরণ করে। ১৮৪৮ এবং ১৯২৮-এর মাঝখানে ৬০৫ হিস্পানিক-আমেরিকান মৃত্যুবরণ করেন গণরোষের শিকার হয়ে। ২০০১ সনের ৯/১১ পরবর্তী সময়ে ত্রুটিপূর্ণ দেশপ্রেমের স্রোতে খলনায়ক হয়ে দাঁড়ান মেক্সিকান-আমেরিকান, চিনা শ্রমিক, ইতালিও, পুঁজিবাদী বিরোধী, মজদুর সংস্থা, সমকামী, ইহুদি, মর্মনস, আমেরিকান-আরব, মুসলমান এবং শিখেরা। কিছু কিছু ক্ষেত্রে গণহত্যা জন হিস্টিরিয়ার জন্য হলেও, অন্যান্য ক্ষেত্রে তা ছিল ইচ্ছাকৃত। এখানে আমাদের মনে রাখতে হবে যে অনেক ক্ষেত্রেই এই গণহত্যাগুলি সুপরিকল্পিত ভাবে সংগঠিত হয়েছিল।

আরও পড়ুন
মোদী সরকারের অর্থনীতিবিদের নিশানায় অমর্ত্য

ছেলেধরা গুজবের জেরে গণপিটুনিতে নিহত কর্নাটকের সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার মহম্মদ আজম।

শ্বেতাঙ্গরা নিজেদের কর্তৃত্ব বজায় রাখার জন্য খুব সুচারু ভাবে গণহত্যা করত। অনেক সময় জাতিগত হিংসার মূলে থাকত অর্থনৈতিক কারণ। চাষের ক্ষেত্রে নিজেদের ক্ষমতা বজায় রাখার জন্য ধনী চাষিরা শ্রমিকদের ওপরে নিজেদের প্রভুত্ব বজায় রাখত। মার্কিন গৃহযুদ্ধের পরে তুলোর দাম পড়তে থাকে এবং ১৮৯০ অবধি তা চলতেই থাকে। গণহত্যা শুরু হয় যখন চাষিরা শ্রমিকদের ওপরে খবরদারি শুরু করে।

ভারতের ক্ষেত্রেও গণহত্যার পেছনে অর্থনৈতিক কারণ খুব স্পষ্ট। গালিচা শিল্প, জারি শিল্প এবং গবাদি পশু ব্যবসায় সংখ্যালঘু এবং দলিতদের একচ্ছত্র আধিপত্যও গণহত্যার একটা স্পষ্ট কারণ হতে পারে। অনেক সময় ভূমি মাফিয়ারা সস্তায় জমি পাওয়ার জন্য গুন্ডা বাহিনী নিযুক্ত করে এবং গণহত্যার রূপ দেয়।

মোদী-শাহ এবং বিজেপির ভারতে গণহত্যা একটি বিশ্লেষণ

যবে থেকে ভারতবর্ষে নরেন্দ্র মোদী এবং অমিত শাহ নিজেদের শাসন কায়েম করেছেন তবে থেকে ভারতবর্ষে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলি প্রায় লোপ পেতে বসেছে। এর সঙ্গে দেখা দিয়েছে আমজনতার নৈতিক অধঃপতন। যত মানুষ এই মিথ্যে বীরত্বে বিশ্বাস করবে এবং জনসমক্ষে মিথ্যে এবং গালির মিশ্রণকে সহ্য করবে তত তারা আরও গণহত্যার পথ খুলে দেবে।

এখানে বলে রাখা ভাল যে মোদীর পথনির্দেশক নীতি ছিল বসুধৈব কুটুম্বকম, অর্থাৎ সমগ্র বিশ্ব একই পরিবারের অংশ। কিন্তু আজকের ভারতে আমরা তার উল্টোটাই দেখতে পাচ্ছি। এক জন মুসলমান-চালিত ট্যাক্সিতে চড়তে এক জন নাগরিকের অস্বীকার, একটি মুসলমান ছেলের কাছ থেকে জিনিস নিতে আর এক জন নাগরিকের অস্বীকার, গুজবের ওপরে ভিত্তি করে কাউকে গণহত্য করা। সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ব্যাপার হচ্ছে শাসনতন্ত্রের অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ না করা। এতে ক্ষমতাসীন দলের বর্তমান পরিস্থিতির প্রতি পরোক্ষ সমর্থন প্রমাণিত হয়।

আরও পড়ুন
মিথ্যে বলছে পুলিশ, দাবি গণপিটুনিতে আহতের

দিল্লির যন্তর মন্তরে বিক্ষোভ। —ফাইল চিত্র।

মোদী-শাহ-যোগী শাসিত ভারতে তাজমহল স্থাপত্যশিল্পের অসাধারণ নিদর্শন না হয়ে মুসলমান প্রাধান্যের প্রমাণ হয়ে দাঁড়ায়। ইতিহাস এবং বিজ্ঞান হয়ে দাঁড়ায় মতাদর্শের যুদ্ধক্ষেত্র এবং প্রচণ্ড শক্তিশালী কিন্তু আকর্ষণীয় মিথ্যের কাছে সত্য পরাজিত হয়। এখন মানুষ বিশ্বাস করতে শুরু করেছে যে প্রাচীন ভারতে বিমান চলত এবং প্লাস্টিক অস্ত্রোপচার হত। এখন তো এ-ও শোনা যাচ্ছে যে প্রাচীন ভারতে টেস্টটিউব শিশুও জন্মগ্রহণ করেছিল। সত্য সেলুকাস, কি বিচিত্র এই দেশ! ইতিহাসকে পরিবর্তন করা হচ্ছে। রানা প্রতাপ এবং আকবরের যুদ্ধে বিজয়ীর নাম পাল্টে দেওয়া হচ্ছে। প্রত্যেকটি আন্তর্ধর্মীয় বিবাহকে প্রেম-জেহাদের রূপ দেওয়া হচ্ছে। যা এখানে সবচাইতে বেশি লক্ষণীয় সেটা হচ্ছে, যারা মারা পড়ছে এবং যারা মারছে, দু’পক্ষই সমাজের নিম্নমধ্য অথবা নিম্ন শ্রেণির মানুষ।

স্বাধীন ভারতবর্ষের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর গণহত্যা ’৮৪ সনে হয়েছিল, যখন কংগ্রেসের গুন্ডাবাহিনী দিল্লিতে শিখদের নির্দয় ভাবে হত্যা করেছিল। প্রত্যেকটি রাজনৈতিক দল এই ধরনের সহিংসতা পরোক্ষে সমর্থন করে। এই ধরনের হিংসার নিন্দা তখনই হয় যখন এই হিংসা দলীয় স্বার্থের বিরুদ্ধে হয়। এখন অনেকেই মনে করছেন যে বিজেপি এই ধরনের হিংসা আদর সহকারে মেনে নিচ্ছে। কারণ তাতে হিন্দু ভোট একত্রিত হচ্ছে।

আর একটি চিন্তার বিষয় হচ্ছে, এই গণহত্যাগুলির পিছনে সামাজিক মাধ্যমের অবদান। ফেসবুক এবং হোয়াটসঅ্যাপ এই বিষয়ে অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে। পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে, দাদরি গণহত্যার আগে হোয়াটসঅ্যাপে অনেকগুলি রক্তাক্ত গরুর ছবি বিতরণ করা হয়েছিল। কিন্তু আজ এই তথ্যের প্রাসঙ্গিকতা কী? মুজফ্‌ফরনগর, শামলি, বাগপত এবং মেরঠ— ২০১৩ সনের হিংসাত্মক ঘটনার পেছনে প্রধান কারণ ছিল হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে ছড়ানো কিছু উস্কানিমূলক বার্তা। ঠিক একই ঘটনা ঘটেছিলো আলওয়ার, হাপুর এবং অসমেও। কিন্তু এখনও উত্তরপ্রদেশ বা রাজস্থান বা কেন্দ্রীয় সরকার, এই হোয়াটসঅ্যাপ বার্তাগুলি যারা সৃষ্টি করেছিল, তাদের বিরুদ্ধে কোনও পদক্ষেপ করেনি।

সম্ভাব্য সমাধান: হিংসাত্মক ঘটনার বিরুদ্ধে একজোট হওয়া

রাজনৈতিক এবং সামাজিক দলগুলির উচিত এই ঘটনাগুলির বিরুদ্ধে একজোট হওয়া। ছাত্রদের এবং তরুণ-তরুণীদের সাহায্যে গণঅভিযান সংগঠিত করতে হবে। গাভী-সুরক্ষা বাহিনীগুলির গতিবিধিতে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে হবে। সমগ্র দেশে গাভী-সুরক্ষা আইন, যা গণহত্যার পথ মসৃণ করে, তা রদ করতে হবে। কোর্ট এবং পুলিশকে গণহত্যার বিরুদ্ধে নির্দিষ্ট পদক্ষেপ করতে হবে। ধর্ষণের মতো গণহত্যা রোধ করতেও বিশেষ আইন প্রণয়ন করতে হবে।

এখনই যদি এই বিষয়ে কোনও পদক্ষেপ করা না হয়, তা হলে এর ফল আমাদেরকেই ভোগ করতে হবে।

(দুই লেখকই শিক্ষাবিদ। এখানে প্রকাশিত অভিমত সম্পূর্ণ ভাবেই লেখকদের নিজস্ব।)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE