Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪
National news

‘তৃতীয় লিঙ্গ’ পরিচয়ে এই প্রথম ভোট দিলেন প্রিয়া, কিন্তু...

ভোটার কার্ডে অন্যদের মতোই রয়েছে তাঁদের ছবি, নাম। তবে, ফারাকটা অন্য জায়গায়। লিঙ্গ পরিচয়ে। আর সেটাই স্পষ্ট করে লেখা রয়েছে সচিত্র ভোটার পরিচয়পত্রে, ‘তৃতীয় লিঙ্গ’।

প্রিয়া এবং কোমল (বাঁ দিক থেকে)।

প্রিয়া এবং কোমল (বাঁ দিক থেকে)।

উজ্জ্বল চক্রবর্তী
সোলান (হিমাচল প্রদেশ) শেষ আপডেট: ১১ নভেম্বর ২০১৭ ১৬:০৬
Share: Save:

নিজস্ব পরিচয়ে এটাই প্রথম ভোট। কারও কারও ক্ষেত্রে জীবনের প্রথম ভোটও বটে। তাই খুশি যেন বাধ মানছে না প্রিয়া, কোমলদের!

ভোটার কার্ডে অন্যদের মতোই রয়েছে তাঁদের ছবি, নাম। তবে, ফারাকটা অন্য জায়গায়। লিঙ্গ পরিচয়ে। আর সেটাই স্পষ্ট করে লেখা রয়েছে সচিত্র ভোটার পরিচয়পত্রে, ‘তৃতীয় লিঙ্গ’। পুরুষ নয়, নয় মহিলাও— এই ‘তৃতীয়’ পরিচয়টা একান্তই ওঁদের নিজস্ব। বহু দিনের লড়াই জিতে এই প্রথম বারের জন্য তৃতীয় লিঙ্গের নাগরিক হিসেবে হিমাচল প্রদেশের ভোটার তালিকায় ১৪ জনের নাম উঠেছিল। যদিও সদ্য শেষ হওয়া বিধানসভা নির্বাচনে তাঁদের মধ্যে ভোট দিতে এসেছিলেন মাত্র চার জন। এমনটাই জানালেন রাজ্যের মুখ্য নির্বাচনী আধিকারিক পুষ্পেন্দ্র রাজপুত। ওই চার জনের মধ্যেই রয়েছে প্রিয়া এবং কোমলের নাম।

শিমলা থেকে যে রাস্তা পাহাড় বেয়ে নেমে আসছে, তা ধরে ৪৫ ‌কিলোমিটার পেরোলে সোলান। হিমাচলের এক জেলা শহর। এই সোলানেই থাকেন প্রিয়া মহন্ত কিন্নর। সঙ্গে তিন ‘সন্তান’— কোমল, রোজা ও কোয়েল। সোলান পুরসভার ১১ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা বছর চল্লিশের প্রিয়ার ভোটার কার্ড হয়েছে বছর দশেক আগে। কিন্তু, সেখানে এত দিন লিঙ্গ হিসাবে পুরুষ লেখা ছিল। এ বার তা বদলে দিয়েছে নির্বাচন কমিশন।

এত দিন পর, এত আবেদন-নিবেদনের শেষে নিজের পছন্দের লিঙ্গ পরিচিতির স্বীকৃতিতে ভোট দিতে পেরে উচ্ছ্বসিত প্রিয়া। ভিন্ রাজ্যের সাংবাদিকের কাছে তা প্রকাশ করে বললেন, ‘‘আমি কিন্তু রূপান্তরকামী নই। জন্মসূত্রেই আমি তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ। এত দিন পর নিজের অধিকার বুঝে পাওয়ায় ভীষণ ভাল লাগছে। আর নিজের পরিচয়ে ভোট দেওয়াও তো আমার জন্মগত অধিকার।’’

প্রিয়ার আধার কার্ড।

প্রিয়াকে সোলানের অনেকেই গুরুজি বলে ডাকেন। ওই নামেই ডাকেন কোমল-রোজা-কোয়েলরা। গুরুজির সঙ্গে ওঁদের তিন জনের নামও ভোটার তালিকায় উঠেছে তৃতীয় লিঙ্গের পরিচয়ে। তবে প্রিয়া এবং কোমল ছাড়া বাকি দু’জন গত বৃহস্পতিবার ভোট দিতে পারেননি। কর্মসূত্রে বাইরে গিয়েছিলেন। আর তা নিয়ে কোয়েল-রোজাদের রীতিমতো আফসোস। ২৪ বছরের রোজা বললেন, ‘‘অনেক কষ্টে গুরুজি শেষমেশ ভোটার লিস্টে আমাদের লিঙ্গপরিচয়-সহ নামটা তুলিয়েই ছেড়েছিলেন। কিন্তু, ভোটটা দেওয়া হল না। পেট বড় বালাই! কাজে বেরিয়ে যেতে হল।’’

তবে জীবনের প্রথম ভোট ‘তৃতীয়’ পরিচয়ে দিতে পেরে ভীষণ খুশি কোমল। বছর আঠাশের কোমলের কথায়: ‘‘এত দিন ধরে অপেক্ষা করেছিলাম, আন্দোলনের স্বীকৃতি কবে মিলবে। শেষে গত মাসে জানতে পারি, নাম উঠেছে। এবং তৃতীয় লিঙ্গের নাগরিক হিসাবেই। এই ভোট দেওয়ার পর আনন্দটাই অন্য রকম। সারা জীবন মনে থাকবে।’’

আরও পড়ুন: রোজ বদল সিম, রাতে গোপনে বৈঠক জিজ্ঞেসের

রাজ্যে কয়েক হাজার তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ বাস করেন। ১৪ সংখ্যাটি শতাংশের হিসাবে নগন্য। তা নিয়ে অসন্তোষও রয়েছে এই ‘তৃতীয়’ নাগরিকদের। প্রিয়ার কথায়, ‘‘শিমলা, কালকা, রোড়ু, চম্বা, কাংড়া-সহ আরও বহু জায়গায় আমাদের মতো তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ রয়েছেন। সমাজও রয়েছে আমাদের। সকলকে এই তালিকার অন্তর্ভুক্ত করাই সরকারের দায়িত্ব। আশা করি দায়িত্বশীলরা সে কথা ভাবছেন।’’ প্রিয়ার এই দাবির কথা শুনে রাজ্যের মুখ্য নির্বাচনী আধিকারিক পুষ্পেন্দ্র রাজপুত বলেন, ‘‘যথাযথ ভাবে আবেদনপত্র পূরণ করলে, কমিশন তা খতিয়ে দেখে উপযুক্ত ব্যবস্থা নেবে। কারও অসুবিধা হওয়ার কথা নয়।’’

২০১৩-য় সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশের পর নির্বাচন কমিশন এ বার হিমাচলের ভোটের আগেই প্রিয়াদের সচিত্র ভোটার পরিচয়পত্র পাঠিয়ে দেয়। ভোটার তালিকাতেও তাঁদের নাম-ছবির পাশে ‘তৃতীয় লিঙ্গ’ লেখা হয়। কমিশনের দাবি, ওই ১৪ জনের মধ্যে ১৮ থেকে ২৫ বছর বয়সী রয়েছেন ৬ জন। ২৫ থেকে ৪০ এবং ৪০ থেকে ৬০-এর মধ্যে রয়েছেন ৪ জন করে নাগরিক। রাজ্য জুড়ে এ বার ভোট প্রদানের হার অনেকটাই বেশি।

তৃতীয় লিঙ্গের পরিচয়ে ভোটার তালিকায় নাম ওঠা বেশির ভাগ নাগরিক ভোট দেবেন, এমনটাই আশা করেছিল রাজ্য নির্বাচন দফতর। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ১৪ জনের মধ্যে ১০ জনের ভোট পড়েনি। নীরজ শর্মা নামে এক নির্বাচনী কর্তার কথায়, ‘‘রাজ্যে প্রথম এমন উদ্যোগ। বেশির ভাগ মানুষ সাড়া দিলে ভালই হত।’’

ভোটার তালিকায় রয়েছে তৃতীয় লিঙ্গ পরিচয়।

ভাল অবশ্যই হত। কিন্তু যে শুরুটা হল তা নেহাত কম কথা নয়। কারণ, সুপ্রিম কোর্টের রায় কিংবা নির্বাচন কমিশনের সাড়া পাওয়া— এ সব সত্বেও কঠিন লড়াইটা লড়েই যেতে হচ্ছে প্রিয়া, কোমলদের। সে লড়াইটা সমাজের মূল স্রোতের সঙ্গে। যে সমাজ আজও ওঁদের ‘কেমন চোখে’ চোখে দেখে। স্বাভাবিক মানুষ বলে মানতে অস্বীকার করে। তৃতীয় লিঙ্গ পরিচয়ে ভোটার লিস্টে নাম ওঠা ওই ১৪ জনের একজন তো ‘পুরুষ’ বা ‘নারী’ পরিচয়ে ফিরে যেতে নির্বাচন কমিশনে আবেদন করবেন বলে ঠিকই করে ফেলেছেন। এই প্রতিবেদকের সঙ্গে অনেক ক্ষণ ধরে কথা বলেও, নিজের নাম বা ছবি প্রকাশ করতে চাননি তিনি। কারণ, ভোটার লিস্টে তৃতীয় লিঙ্গের পরিচয়ে নাম ওঠার পর থেকেই পরিবারে ঝড় বইছে।

প্রিয়াও স্বীকার করলেন, লড়তে লড়তে সত্যিই ক্লান্ত লাগে এক এক সময়। কেউ হাল ছেড়ে দেন। কেউ কেউ লড়াইটা চালাতে থাকেন। প্রিয়ার কথায়, ‘‘শুধু ভোটার লিস্টে নতুন পরিচয় পেলেই তো হবে না! সমাজে স্বাভাবিক মানুষের মতো ব্যবহারটা পেতে হবে তো! চাকরি পেতে হবে তো! কাজ পেতে হবে।’’

আত্মপরিচয়ের মর্যাদা মিলেছে সরকারি ভাবে। সমাজ, সংসারও এই পরিচয় মেনে স্বাভাবিক মানুষের মর্যাদা দেবে, এই আশায় লড়ে চলেছেন ওঁরা— প্রিয়া-কোমল-রোজা-কোয়েলরা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE