Advertisement
১৬ এপ্রিল ২০২৪

বাঙালি যাত্রীর হার্ট অ্যাটাক! চেন্নাইয়ের অটোচালক কী করলেন...

চোখ বুজলেই অটোচালকের যে মুখ বা চেহারা ভেসে ওঠে, তা অবশ্য বেশির ভাগ সময়েই বিশেষ বন্ধুবৎসল নয়। চোখে-মুখে ফুটে উঠছে অজানা ক্রোধ, শরীরী ভাষা বুঝিয়ে দিচ্ছে তীব্র ঔদ্ধত্য, মুখগহ্বর ভরে আছে পানমশলায়, হাতের স্টিলের বালায় ঠিকরে যাচ্ছে নাগরিক রোদ, কানের কাছে ড্রাম পেটাচ্ছে গানের নামে অত্যাচার, খুচরোই হোক বা গন্তব্য, যাত্রীর সঙ্গে কথায় কথায় তর্ক জোড়া— এককথায় এটাই অটোচালকদের সম্পর্কে আম আদমির ধ্যানধারণা।

নিজস্ব প্রতিবেদন
শেষ আপডেট: ১২ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ ১৬:০৯
Share: Save:

এই শহর জানে তার অটোর সব কিছু...

এবং জানেও না!

চোখ বুজলেই অটোচালকের যে মুখ বা চেহারা ভেসে ওঠে, তা অবশ্য বেশির ভাগ সময়েই বিশেষ বন্ধুবৎসল নয়। চোখে-মুখে ফুটে উঠছে অজানা ক্রোধ, শরীরী ভাষা বুঝিয়ে দিচ্ছে তীব্র ঔদ্ধত্য, মুখগহ্বর ভরে আছে পানমশলায়, হাতের স্টিলের বালায় ঠিকরে যাচ্ছে নাগরিক রোদ, কানের কাছে ড্রাম পেটাচ্ছে গানের নামে অত্যাচার, খুচরোই হোক বা গন্তব্য, যাত্রীর সঙ্গে কথায় কথায় তর্ক জোড়া— এককথায় এটাই অটোচালকদের সম্পর্কে আম আদমির ধ্যানধারণা। টিভির পর্দায় আর খবরের কাগজের পাতায় চোখ রাখলে মাঝেমধ্যেই অটো-দৌরাত্মের খবর। দেশের নানা প্রান্তের নানা শহরে এটাই নিয়মিত ফ্রেম!

কিন্তু এই ফ্রেমে চেন্নাইয়ের কে রবিচন্দ্রন পড়েন না!

ব্যতিক্রমী চরিত্র? এটা বললে কিছুটা বলা হল বটে, কিন্তু আদপে কিছুই বলা হল না!

মাস কয়েক আগের কথা। সেটা ছিল এক রবিবার। কলকাতা থেকে আসা এক বাঙালি প্রৌঢ় চেন্নাইয়ের রামাপুরম থেকে উঠেছিলেন রবিচন্দ্রনের অটোয়। গন্তব্য শহরেরই ত্রিপলিকেন। তারিখ মনে না পড়লেও সে দিনের কথা স্পষ্ট মনে করতে পারেন এই অটোচালক। ‘‘যাচ্ছিলাম মাউন্ট রোড ধরে। হঠাৎ গোঙানির শব্দ শুনে পিছন ফিরে দেখি ওই যাত্রী যন্ত্রণায় বুকটা চেপে ধরে রেখেছেন।’’ পরিস্থিতির গুরুত্ব বুঝেই তিনি ওই যাত্রীকে সঙ্গে সঙ্গে স্থানীয় এক ক্লিনিকে নিয়ে যান। সেখানে নানা পরীক্ষার পরে ওই প্রৌঢ়কে চেন্নাইয়ের একটি সরকারি হাসপাতালে পাঠানো হয়। রবিচন্দ্রন কিন্তু সেখান থেকে চলে না গিয়ে ওই যাত্রীর সঙ্গেই ছিলেন। সেখানে চিকিৎসকেরা তাঁকে পরীক্ষা করে জানান, তাঁর রক্তবাহী ধমণীর তিনটি জায়গায় ‘ব্লক ’ হয়েছে। অবিলম্বে তাঁর পেসমেকার বসানো প্রয়োজন।

ওই বাঙালি প্রৌঢ়ের কাছ থেকে তাঁর ছেলের নম্বরে ফোন করে রবিচন্দ্রন তাঁকে চেন্নাই চলে আসতে বলেন। ওই দিন রাতেই বিমানে তাঁর ছেলে পৌঁছে যান চেন্নাই। হাসপাতালে কথাবার্তা বলে তিনি জানতে পারেন, পেসমেকার এবং চিকিৎসার খরচ বাবদ প্রায় এক লক্ষ টাকা প্রয়োজন। কিন্তু বিমানের ভাড়া দিয়ে ছেলের হাতে ছিল সাকুল্যে ১৫ হাজার টাকা। এর পর আবার নানা আবেদন-নিবেদনের পরে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ চিকিৎসা ব্যয় কমিয়ে ৪৭ হাজার টাকায় আনতে রাজি হন। কিন্তু সে টাকাও তাঁদের হাতে ছিল না। ওই যাত্রীর ছেলের সঙ্গে কথা বলে রবিচন্দ্রন বুঝতে পারেন, তাঁরা আদৌ স্বচ্ছল পরিবারের নন।

অতঃপর কী করণীয়?

আরও পাঁচটি ক্ষেত্রে যা হয়, নেহাত দিন-আনা-দিন-খাওয়া অটোচালক সেটাই করতে পারতেন। সামান্য এক যাত্রীর অসুস্থতার জন্য সারা দিনের রোজগার মাটি না করে স্বচ্ছন্দে রামচন্দ্রন সেখান থেকে বিদায় নিতে পারতেন। কিন্তু, তিনি যে ব্যতিক্রমীর মধ্যেও ব্যতিক্রমী! কী বলছেন রবি? নেহাতই ‘সাধারণ’ এক অটোচালক বলছেন, ‘‘ঠিক করলাম, আমার অটো-টা বন্ধক রেখে চিকিৎসার বাকি টাকা জোগাড় করব। কারণ, এই অটোই আমার একমাত্র সম্পত্তি।’’

তাঁর এই কাজের জন্য রবিচন্দ্রনকে পুরস্কার দিয়ে সম্মানিত করেছে ‘অন্না অটো ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট’। অটোচালকদের ভাল কাজ করার জন্য উদ্বুদ্ধ করে এই সংস্থা। এই ট্রাস্টের কর্ণধার অনিল খিচা বলছেন, ‘‘কোনও অটোচালক ভাল কাজ করলে তাকে স্বীকৃতি দিতেই এই পুরস্কার। এই পুরস্কার তাঁকে আরও ভাল কাজ করতে উদ্বুদ্ধ করবে।’’

আরও পড়ুন-ঘট সাজিয়ে প্রসাদ বিলি, দীনদয়াল পুজো সঙ্ঘের

কপালে লাল টিপ, পরনে অটোচালকের নির্ধারিত খাকি পোশাক, বছর আটচল্লিশের রামচন্দ্রনের মুখই এখন চেন্নাইয়ের মুখ! অনিল বলেন, ‘‘চেন্নাই শহরে বাইরে থেকে কোনও যাত্রী এলে প্রথম সাক্ষাৎ হয় অটোচালকদের সঙ্গেই। কাজেই তাঁদের ব্যবহারই এই শহর সম্পর্কে তাঁর ধারণা তৈরি করে দিতে পারে।’’

একখানা রামচন্দ্রন ধার দেওয়া যায় না এই কল্লোলিনীর বুকে?

কোনও শহরই কি জানে তার অটোর সব কিছু!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

auto driver k ravichandran chennai
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE