Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪
Toba Tek Singh

টোবা টেক সিংহদের পাশে আলোয় ফেরা হাসান

হাসানের লড়াই শুরু কলকাতার লুম্বিনী পার্ক মানসিক হাসপাতালে।

হাসান গালিব। নিজস্ব চিত্র

হাসান গালিব। নিজস্ব চিত্র

ঋজু বসু
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২০ ০৩:০৮
Share: Save:

জীবনে এ দেশের বাইরে কোথাও কখনও যাননি তিনি। তবু এ দেশের মাটির অধিকার ছিনিয়ে নিতে লড়াই কাকে বলে নিজের জীবনে আট বছর আগেই টের পেয়েছিলেন সেই যুবক। এখন তাঁর মতো একদা নাম-পরিচয় হারিয়ে ফেলা মানুষদের শিকড় খুঁজে পাওয়ার লড়াইয়ে ভরসার নাম হাসান গালিব। মানসিক রোগীদের ঘরে ফেরাতে সহায়তার পাশাপাশি দেশের নানা প্রান্তে সচেতনতার উদ্যোগে নাগরিকত্বের ‘কালা কানুনের’ বিপদের কথাও তিনি বলে বেড়াচ্ছেন।

হাসানের লড়াই শুরু কলকাতার লুম্বিনী পার্ক মানসিক হাসপাতালে। মানসিক রোগী-তকমা বয়ে এক যুগ আগে সেখানে ছিলেন অসমের শিবসাগরের যুবক। সুস্থ হয়েও হাসপাতালের ‘জেলখানার’ ও পার থেকে বেরোতে কম কাঠখড় পোয়াতে হয়নি। কেউ পাশে না-থাকায় ২০১২র সেপ্টেম্বরে নিজেই নিজের অভিভাবক দাবি করে কলকাতা হাইকোর্টের নির্দেশে মুক্তি পান হাসান। এর পরে ধাপে ধাপে নিজের সবটুকু হারানো পরিচয় খুঁজে পাওয়ার পাশাপাশি নিজের পায়ে দাঁড়ানোর শক্ত জমিটুকুও তৈরি করেছেন মধ্যচল্লিশের যুবক। শিবসাগরে নিজের কাপড়ের দোকান, ফাস্ট ফুড সেন্টার সামলানোর পাশাপাশি অসমের মানসিক রোগীদের বাড়ি ফেরানো, অভিভাবকদের কাউন্সেলিং থেকে রোগীদের পরিচয়পত্র খুঁজে আনার দুরূহ কাজে শরিক হাসান।

নিজের জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে বুঝেই যিনি বলছেন, ‘‘নাগরিকত্বের নতুন আইন আমাদের মতো মানসিক রোগে ভুক্তভোগী মানুষের জন্যও ভয়ঙ্কর।’’ কেন? হাসানের ব্যাখ্যা, ‘‘যে মানুষগুলোর অতীত-বর্তমান গুলিয়ে গিয়েছিল এবং কোনও রকম পরিচয়পত্র যাঁদের নাগালে নেই, তাঁদের তো এমনিতেই পদে পদে নাগরিকত্বের পরীক্ষা দিতে হয়। নতুন আইনে (সিএএ) অতি সহজেই তাঁদের পরিচয় নিয়ে ধোঁয়াশা তৈরি করা সম্ভব।’’ প্রান্তিক মানুষের অধিকার নিয়ে সক্রিয় এ দেশের বেশ কয়েকটি সংগঠন এবং নটিংহ্যাম বিশ্ববিদ্যালয়ের গাঁটছড়ায় একটি উদ্যোগের কাজে সম্প্রতি পুণেয় নিজের গল্প বলেছেন হাসান। সিএএ এবং জাতীয় নাগরিক পঞ্জির খাঁড়া ঘিরে পরিবারহারা মনোরোগীদের ‘বিপদ’ নিয়েও সরব হয়েছেন তিনি।

২০০৯ নাগাদ শিবসাগর থেকে কোনও ভাবে ট্রেনে কাকদ্বীপে এসে পৌঁছন হাসান। মাদকের প্রভাবে তখন প্রায় বেহুঁশ দশা তাঁর। পুলিশের হাত ধরেই ঠাঁই হয়েছিল লুম্বিনীতে। সেখানকার চিকিৎসায়-পরিচর্যায় ক্রমশ সেরে ওঠা। এর পরে বাড়ি ফিরতে চেয়েই হাসান টের পান, কী ভাবে তত দিনে বদলে গিয়েছে তাঁর পৃথিবী। বাড়িতে দিদি-জামাইবাবুরা তখনও ‘অসুস্থ’ হাসানকে ফিরিয়ে নিতে গররাজি। হাসান দেখলেন, ‘‘আমি কে, কোথায় ঠিকানা— তা বোঝাতেই হিমশিম খেতে হচ্ছে।’’ একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার ‘দিদিরা’ পাশে থাকলেও ফের মুক্ত পৃথিবীতে দাঁড়ানো সোজা ছিল না। তাঁদের অন্যতম শুক্লা দাস বড়ুয়ার মনে আছে, অসমের মুসলিম যুবক হাসান ‘বাংলাদেশি’ সন্দেহে নানা দ্বিধাদ্বন্দ্ব দেখা গিয়েছিল। হাইকোর্টের রায়ে হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে কিছু দিন বারাসতের কাছের একটি পুনর্বাসন কেন্দ্রে কাজ করেন হাসান। এর পরে ক্রমশ তাঁকে গ্রহণ করেন পরিজনেরা। সমাজকর্মী রত্নাবলী রায়ের মতে, ‘‘সিএএ আদতে পীড়নের আইন। তাতে হাসানের মতো মুসলিম নামধারী মানুষদের মূল স্রোতে ফেরার রাস্তা আরও কঠিন হয়েছে। তবে সাধারণ ভাবেই সহায়সম্বলহীন মানুষদের নাগরিকত্ব প্রমাণ করা এখন আরও মুশকিল।’’

মান্টোর গল্পে ‘টোবা টেক সিংহ’ ভারতীয় না পাকিস্তানি— নিষ্পত্তি হয়নি শেষ পর্যন্ত। নতুন আইনের জটে মনোরোগীদের বিপদের মোকাবিলায় চলছে আলোয় ফেরা হাসানদের লড়াই।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE