Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪
ললিত আঘাতে ঘায়েল সুষমা

মেনে নিলেন, সাহায্য করেছেন ‘ভিসা’ পেতে

বিদেশমন্ত্রী সুষমা স্বরাজের ‘মানবিক’ পদক্ষেপের জেরে প্রবল বিড়ম্বনার মুখে পড়ে গেল সদ্য বর্ষপূর্তিতে নিজেদের দুর্নীতিমুক্ত হিসেবে তুলে ধরা নরেন্দ্র মোদীর সরকার। চাপের মুখে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী তথা সরকারপক্ষ সর্বশক্তি দিয়ে বিদেশমন্ত্রীর পাশে দাঁড়ালেও বিরোধীদের সম্মিলিত আক্রমণের মুখে দিনের শেষে তারা কিন্তু যথেষ্ট অস্বস্তিতে।

২০১০। সুষমা তখন বিরোধী নেত্রী, ললিত মোদী আইপিএল কমিশনার। নয়াদিল্লিতে একটি ম্যাচ চলাকালীন। — ফাইল চিত্র

২০১০। সুষমা তখন বিরোধী নেত্রী, ললিত মোদী আইপিএল কমিশনার। নয়াদিল্লিতে একটি ম্যাচ চলাকালীন। — ফাইল চিত্র

নিজস্ব সংবাদদাতা
নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ১৫ জুন ২০১৫ ০৫:২০
Share: Save:

বিদেশমন্ত্রী সুষমা স্বরাজের ‘মানবিক’ পদক্ষেপের জেরে প্রবল বিড়ম্বনার মুখে পড়ে গেল সদ্য বর্ষপূর্তিতে নিজেদের দুর্নীতিমুক্ত হিসেবে তুলে ধরা নরেন্দ্র মোদীর সরকার। চাপের মুখে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী তথা সরকারপক্ষ সর্বশক্তি দিয়ে বিদেশমন্ত্রীর পাশে দাঁড়ালেও বিরোধীদের সম্মিলিত আক্রমণের মুখে দিনের শেষে তারা কিন্তু যথেষ্ট অস্বস্তিতে।

আর্থিক কেলেঙ্কারিতে অভিযুক্ত এবং ইডি-র মামলা এড়াতে ‘পলাতক’, ক্রিকেট–কর্তা ললিত মোদীকে ভিসা পেতে সাহায্য করেছেন ভারতীয় বিদেশমন্ত্রী, এই খবর আজ সকালে প্রকাশ্যে আসার পরে রাজনৈতিক শিবিরে কার্যত বোমা ফেটেছে! নাটকীয় ভাবে টুইট করে সুষমা নিজেই স্বীকার করে নেন যে, গত বছর জুলাই মাসে তিনি ‘মানবিক কারণে’ ললিত মোদীকে তাঁর স্ত্রীর চিকিৎসার জন্য পর্তুগালে যাওয়ার জন্য আন্তর্জাতিক সফরের অনুমতিপত্র (ট্র্যাভেল ডকুমেন্ট) পেতে সাহায্য করেছিলেন। এই স্বীকারোক্তির পরে বিরোধীরা আরও সুর চড়ায়। কংগ্রেস-সহ বিরোধীরা একজোটে বিদেশমন্ত্রীর পদত্যাগের দাবি তোলে। এই প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রীকেও তোপ দাগে বিরোধীরা। গোড়ায় চুপ থাকলেও শেষ পর্যন্ত মাঠে নামেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী-সহ বিজেপির একাধিক শীর্ষ নেতা। দলীয় সমীকরণে মোদী-বিরোধী শিবিরের অন্যতম মুখ সুষমা স্বরাজের পদত্যাগের দাবি খারিজ করে তাঁর পাশেই দাঁড়ান প্রধানমন্ত্রী। যা দেখে অনেকেই বলছেন, মোদীর জন্যই প্রাক্তন বিদেশমন্ত্রী নটবর সিংহের পরিণতি হলো না সুষমার! বিজেপি সূত্রের বক্তব্য, বিরোধীদের চাপের মুখে নতিস্বীকার করে বিদেশমন্ত্রীর পদ থেকে সুষমাকে সরালে আখেরে রাজনৈতিক ফায়দা হতো সনিয়া গাঁধীরই। বিশেষত যখন দাবি উঠছে, গোটা ঘটনায় প্রধানমন্ত্রীর ভূমিকা স্পষ্ট করার। তাই দীর্ঘ আলাপ-আলোচনার পর গোটা বিষয়টিতে মানবিকতার মোড়ক দিয়ে এ যাত্রা সুষমা তথা সরকারের পরিচ্ছন্ন ভাবমূর্তি বজায় রাখার চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া হল বিজেপির তরফে।

শুধু সুষমা এবং ললিত মোদী নন, গোটা ঘটনার অন্যতম পার্শ্বচরিত্র হিসেবে উঠে এসেছে ভারতীয় বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ এমপি কিথ ভাজের নাম। ভারতীয় বংশোদ্ভূতদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সময় ধরে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে এমপি রয়েছেন এই কিথ ভাজ। ললিতকে ট্র্যাভেল ডকুমেন্ট পাইয়ে দেওয়ার জন্য সুষমা তাঁকেই লিখিত অনুরোধ করেছিলেন। বিরোধীদের অভিযোগ, ললিত মোদী এবং কিথ ভাজের কাছ থেকে অতীতে বিভিন্ন রকম সুবিধা নিয়েছেন সুষমার স্বামী স্বরাজ কৌশল এবং তাঁর পরিবারের অন্য সদস্যরা। তাদের অভিযোগ, এই কিথ ভাজই ২০১৩ সালে সুষমার ভাইপো জ্যোতির্ময় কৌশলকে ব্রিটিশ আইন কলেজে ভর্তি করতে সাহায্য করেছিলেন। ললিত মোদী বিতর্কে জড়িয়ে ব্রিটিশ পার্লামেন্টের তদন্ত কমিটির মুখে পড়তে চলেছেন কিথ ভাজ।

এই মুহূর্তে কিথের মতো তদন্ত কমিটির সামনে অবশ্য পড়তে হচ্ছে না সুষমাকে। তবে বিরোধীদের প্রবল চাপ অব্যাহত। আজ সকালে সংবাদমাধ্যমে ঘটনাটি প্রকাশ্যে আসার পরই আসরে নামেন কংগ্রেসের দিগ্বিজয় সিংহ, সিপিএমের বৃন্দা কারাট-সহ বিরোধী নেতারা। একযোগে আক্রমণ করেন সুষমা-সহ সরকার পক্ষকে। ওঠে বিদেশমন্ত্রীর পদত্যাগের দাবিও। দিগ্বিজয়ের কথায়, ‘‘গোটা ঘটনাটি মারাত্মক! একজন দাগি অপরাধীকে সরকার সাহায্য করেছে! এ ব্যাপারে সরকারকে জবাবদিহি করতে হবে।’’ বিরোধীদের তুমুল আক্রমণের মুখেও দীর্ঘ ছ’ঘণ্টা সংবাদমাধ্যমের সামনে আসেননি বিজেপির কোনও মুখপাত্র বা নেতা! সকালের প্রাথমিক ধাক্কা সামলে বেলার দিকে তারা নামে নিজেদের দুর্গ রক্ষায়। দফায় দফায় পরস্পরের মধ্যে কথা বলেন সুষমা, নরেন্দ্র মোদী, আরএসএস নেতৃত্ব, কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিংহ এবং বিজেপি সভাপতি অমিত শাহ। দীর্ঘ আলোচনার পর স্থির হয়, অস্বস্তি যতই বাড়ুক, কংগ্রেসের দাবিতে সুষমাকে সরালে বিরোধীদের হাত শক্ত করা হবে। মেনে নেওয়া হবে যে, এই সরকার প্রকারান্তরে আর্থিক নয়ছয়ের সঙ্গে জড়িত ললিত মোদীর সঙ্গে সুসম্পর্ক রেখে চলে। তার পরেই বিকেলে বিদেশমন্ত্রীর পদত্যাগের সম্ভবানায় জল ঢেলে অমিত শাহ বলেন, ‘‘এই ক্ষেত্রে নৈতিকতা লঙ্ঘনের কোনও প্রশ্ন উঠছে না। বিষয়টি নিয়ে এত হট্টগোলেরও কোনও কারণ নেই। মানবিক কারণে এই সাহায্যটুকু বিদেশমন্ত্রী করেছেন।’’ প্রায় একই সুরে সুষমার পাশে দাঁড়ান রাজনাথ সিংহও। আক্রমণই রক্ষণের সেরা উপায় এই তত্ত্বকে কাজে লাগিয়ে কংগ্রেসকে খোঁচা দিয়ে অমিত শাহ আরও বলেছেন, ‘‘এটা কুত্রোচ্চিকে দেশের বাইরে পাঠিয়ে দেওয়া বা ভোপাল দুর্ঘটনার পর অ্যান্ডারসনকে ফিরে যাওয়ার অনুমতি দেওয়ার মতো কোনও ঘটনা নয়!’’

তবে এ সব কথাতেও সরকার বা বিজেপির অস্বস্তি কাটল কই! কুত্রোচ্চি বা অ্যান্ডারসন প্রসঙ্গ তুলে কংগ্রেসকে বিপাকে ফেলার অমিত-প্রচেষ্টাকে পাল্টা ধাক্কা দিয়ে বিরোধী শিবিরের কটাক্ষ, ‘‘আজ যদি দাউদের স্ত্রী বা পরিবার কোনও সমস্যায় পড়ে, তা হলেও কি মানবিকতার খাতিরে ভারত সরকার দাউদকে সাহায্য করবে?’’ কংগ্রেসের তরফে আজ এক বিশেষ সাংবাদিক বৈঠক ডেকে ললিত মোদী প্রশ্নে কার্যত তুলোধনা করা হয় মোদী সরকারকে। দলের মুখপাত্র রনদীপ সিংহ সুরজেওয়ালা ১১টি প্রশ্ন তোলেন বিজেপি নেতৃত্ব তথা সরকারের প্রতি। সরাসরি প্রধানমন্ত্রীকেই নিশানা করে কংগ্রেসের কটাক্ষ, ‘‘এটি এক মোদীকে অন্য মোদীর সাহায্যের ঘটনা নয় তো!’’ কিথ ভাজের সঙ্গে ললিতের ভিসা নিয়ে কথা বলতে সুষমাকে খোদ প্রধানমন্ত্রী অনুমতি দিয়েছিলেন কিনা, সে প্রশ্নও তুলে মোদীকে চাপে ফেলার চেষ্টা করেছে কংগ্রেস। একই সঙ্গে বিরোধীদের প্রশ্ন, ‘‘কালো টাকা ফেরানো নিয়ে এই সরকার এত কথা বলেছে। অথচ এই ললিত মোদীর হাত ধরেই তো বহু কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয়েছে!’’

কী ভাবে জানা গেল এই ঘটনা? আজ সকালে। সুষমা স্বরাজ, কিথ ভাজ এবং ব্রিটিশ হাইকমিশনার জেমস বিভানের মধ্যে চালাচালি হওয়া ই-মেল প্রকাশ্যে আসে। তাতে দেখা যায়, আইপিএল-কেলেঙ্কারিতে জড়িত অভিযোগে ২০১০ থেকে ইডি-র ‘ওয়ান্টেড’ তালিকায় থাকা এবং ব্রিটেনে আশ্রয় নেওয়া প্রাক্তন ক্রিকেট-কর্তা ললিত মোদীর ‘ট্রাভেল ডকুমেন্ট’-এর জন্য দরবার করছেন ভারতীয় বিদেশমন্ত্রী। বৈদ্যুতিন চ্যানেলের মাধ্যমে এই খবর রাজনৈতিক শিবিরে হইচই ফেলে দেওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই আত্মপক্ষ সমর্থনের ঢঙে একের পর এক টুইট করতে থাকেন সুষমা। বলেন, ‘‘ললিত মোদী লন্ডনে রয়েছেন। তিনি আমায় জানিয়েছিলেন যে তাঁর স্ত্রী ক্যানসারে আক্রান্ত। পর্তুগালে তাঁর অপারেশনের সময় মোদীকে হাজির থাকতে হবে কিছু কাগজে সই করার জন্য। মানবিকতার খাতিরেই আমি ব্রিটিশ হাইকমিশনকে বিষয়টি জানাই। এ কথাই বলি যে, ব্রিটিশ আইন-কানুনকে মান্য করেই ললিত মোদীর আবেদনটি খতিয়ে দেখুক ব্রিটিশ সরকার। এর ফলে ভারত এবং ব্রিটেনের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের কোনও সমস্যা হবে না।’’

ঘটনা হল, ব্রিটিশ হাইকমিশনারের পাশাপাশি কিথ ভাজকেও একই অনুরোধ করে একটি মেল পাঠান সুষমা। সুষমার সুপারিশের ভিত্তিতে ভাজ ফের মেল করেন ব্রিটেনের ভিসা এবং অভিবাসন দফতরের ডিরেক্টর জেনারেল সারা রাপসনকে। সেই মেলে তিনি সুষমার অনুরোধের প্রসঙ্গটি বিশেষ ভাবে উল্লেখ করে সারার উপর চাপ তৈরি করেন যে, ভারতের দিক থেকে যখন কোনও সমস্যা নেই, তখন যেন অতি দ্রুত ললিত মোদীর আবেদন মঞ্জুর করা হয়। এবং ঘটনা হল, কিথ ভাজের সুপারিশের মাত্র ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই কাঙ্খিত ট্র্যাভেল ডকুমেন্ট দেওয়া হয় ললিত মোদীকে! পর্তুগাল বা বিশ্বের কোনও জায়গায় যাওয়ার জন্য ললিত মোদীর বিশেষ ভিসা বা ‘ট্রাভেল ডকুমেন্ট’ জরুরি এই কারণেই যে, দিল্লি হাইকোর্ট তাঁর পাসপোর্ট বাজেয়াপ্ত করে রেখেছে। নয়াদিল্লি ললিতকে প্রত্যর্পণ করার অনুরোধের পাশাপাশি তাকে অন্য কোনও দেশে যাওয়ার প্রশ্নেও কড়া নিষেধাজ্ঞা জানিয়ে রেখেছে ব্রিটেনকে।

সেই প্রেক্ষিতে মন্ত্রিসভার এক জন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য হিসেবে সুষমার এই অনুরোধ আগামী দিনে তাঁর ব্যক্তিগত ভাবমূর্তিকেও কালিমালিপ্ত করবে বলে মনে করছে রাজনৈতিক শিবির।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE