Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

টার্মিনালে মেঝেতে ঘুমিয়েই কাটল রাত্তিরটা

চিৎকার করতে করতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম। তার উপর ভোর রাতে গরম গরম ভাত-ডাল-তরকারি খেয়ে চোখটা লেগে এসেছিল। চেন্নাই বিমানবন্দরের কার্পেট মোড়া মেঝেতে শুয়েই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম অগত্যা।

মধুমিতা মুখোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ০৩ ডিসেম্বর ২০১৫ ০৪:১২
Share: Save:

চিৎকার করতে করতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম। তার উপর ভোর রাতে গরম গরম ভাত-ডাল-তরকারি খেয়ে চোখটা লেগে এসেছিল। চেন্নাই বিমানবন্দরের কার্পেট মোড়া মেঝেতে শুয়েই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম অগত্যা।

বুধবার ঘুম যখন ভাঙল তখন সবে আলো ফুটেছে। কাচে মোড়া টার্মিনাল থেকে সেই প্রথম বাইরের অবস্থাটা চোখে পড়ল। গত কাল সন্ধে থেকেই এখানে বসে আছি। এখান থেকে বাইরেটা এক্কেবারে ঘুটঘুটে অন্ধকার দেখায়। সকালের দৃশ্য দেখে হতভম্ব হয়ে গেলাম। সার দিয়ে সব বিমান দাঁড়িয়ে। প্রত্যেকটার চাকা জলের নীচে। ভেসে গিয়েছে গোটা অ্যাপ্রন এলাকা! যত দূর চোখ যায় শুধু জল আর জল।

বৃষ্টি তখনও হয়ে যাচ্ছে। অবিরাম।

মনে হচ্ছিল, যেন কোনও নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে আছি। বিমানবন্দরের এদিক থেকে ওদিকে বয়ে যাচ্ছে জলের স্রোত। ভেসে আসছে আগাছা। তার ঠিক মাঝখানে সারি সারি বিমান। চার পাশে ছড়িয়েছিটিয়ে রয়েছে ছোট-বড় প্রচুর গাড়িও। কাল সন্ধে থেকে টার্মিনালের ভিতর থেকে বুঝতেই পারিনি বাইরের অবস্থাটা। শুধু বৃষ্টির শব্দটুকুই কানে এসেছে। মনে হয়েছে, এমন বৃষ্টি তো আমার শহরেও হয়! তাতে তো আর উড়ান বন্ধ হয় না! সকালে অবস্থাটা দেখে অত অনুযোগ করার জন্য মনে মনে সত্যি লজ্জাই পেলাম।

কেন বিমান উড়বে না? আজ না হলেও কাল সকালে কেন আমাদের গন্তব্যে পৌঁছে দেওয়া হবে না? কেন হোটেলে থাকার ব্যবস্থা করা হবে না— এ সব প্রশ্ন করে মঙ্গলবার সন্ধে থেকে সমানে চিৎকার করে এসেছি আমার উড়ান সংস্থার কর্মীদের উপর। সহযাত্রীদের সঙ্গে মেঝেতে বসে ‘হায় হায়’ বলে স্লোগানও দিয়েছি। চেন্নাই থেকে মঙ্গলবার সন্ধের পরে শেষ বিমানটা উড়েছে। তার পর থেকে বিমান ওঠানামা বন্ধ। ‘রানওয়ে জলের তলায়’— অফিসারদের এই যুক্তি শুনে মনে হয়েছে, আমাদের বোকা বানাচ্ছে! এর পিছনে নিশ্চয়ই ওদের কোনও গাফিলতি রয়েছে।

কিন্তু এখন বুঝতে পারছি কী অবস্থা! এই পরিস্থিতিতে কেউ আমাকে বিমানে ওঠাতে চাইলে, আমি নিজেই রাজি হতাম না। বহু দেশ-বিদেশ ঘুরেছি। বিমানবন্দরের ভিতরের এমন অবস্থা কখনও দেখিনি।

আমার এই শহরে আসা কোচি বিশ্ববিদ্যালয়ে জীব-বৈচিত্র সংক্রান্ত এক সেমিনারে যোগ দিতে। মঙ্গলবার বিকেল পাঁচটায় চেন্নাই পৌঁছেছি। তখনই আকাশ কালো করে বৃষ্টি শুরু হয়েছে। চেন্নাই থেকে সন্ধে ৭টায় কোচির উড়ান ছিল। প্রথমে শুনি,
আধ ঘণ্টা দেরি হবে। জিনিসপত্রবিমানসংস্থার জিম্মায় দিয়ে টার্মিনালের গেটের কাছে চলে যাই। তারপর থেকেই শুরু অনন্ত অপেক্ষা। বিমান দেরি করে উড়বে— বারবার ঘোষণা করা হচ্ছিল। আমার মতো অনেকেই তত ক্ষণে পৌঁছেছেন টার্মিনালের গেটে। কয়েক জন যাত্রীকে দেখলাম খানিকটা ভিজে এসেছেন। বুঝলাম, শহর থেকে এসেছেন। বাইরে তুমুল বৃষ্টি। কাচের দেওয়ালের ও-পারটা নিকষ অন্ধকার।

বেগতিক বুঝে টার্মিনালের ভিতরের দোকান থেকেই জলের বোতল আর বিস্কুটের প্যাকেট কিনে নিয়েছিলাম। হাতের কাছে বিমানসংস্থার যাকেই পাচ্ছিলাম, তাকেই বকা-ঝকা করছিলাম। আমার সঙ্গে গলা মেলাচ্ছিলেন সহযাত্রীরাও। বিমানবন্দরের নিরাপত্তাকর্মীদের সঙ্গে আমাদের রীতিমতো ঝগড়া বেধে গিয়েছিল। রাত ১১টার সময়ে প্রথম বার ঘোষণা হল, সমস্ত উড়ান বাতিল। বলা হল, যাত্রীরা চাইলে টাকা ফেরত নিয়ে চলে যেতে পারেন। শুনে রাগে-বিরক্তিতে ফেটে পড়লাম। চলে যাব মানে? কোথায় যাব? এই রাতে চেন্নাইয়ের কোথায় জায়গা পাব? হোটেলে জায়গা আছে কি না জানি না। হোটেল কী করে পৌঁছব, তা-ও জানি না! জনা পাঁচেক যাত্রী মিলে বিমানসংস্থার অফিসে গিয়ে বললাম, আজ (মঙ্গলবার) রাতে না হলেও কালকের (বুধবার) প্রথম উড়ানে অন্তত আমাদের পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করা হোক। রাতে বাইরে বেরোনোর প্রশ্নই নেই!

ঠিক করলাম টার্মিনালের মেঝেতে শুয়েই রাতটা কাটিয়ে দেব। তার আগে গেটের কাছে ফিরে সকলে মিলে চিৎকার করে বিস্তর স্লোগান দিয়ে, ক্ষোভ উগরে দিলাম বিমান সংস্থার নামে। তার পর আস্তে আস্তে রাগ পড়েছে। আমরাও ছড়িয়েছিটিয়ে মেঝেতে জায়গা করে নিয়েছি। খিদেতে পেটে ব্যথা শুরু হয়েছিল মাঝরাত্তির থেকে। সাড়ে তিনটে নাগাদ বিমানসংস্থারই এক অফিসার ডেকে নিয়ে গেলেন। বললেন, ‘‘চলুন। খাবারের ব্যবস্থা হয়েছে।’’ তার পরেই আমার ভাত-ঘুম।

বুধবার ভোরে অবস্থাটা চাক্ষুষ করার পরে বেশ কয়েক বার বিমানসংস্থার ওই অফিসারকে দেখেছি। যাঁকে কিনা না বুঝেই অনেক গালমন্দ করেছি। মনে হয়েছে, গিয়ে এক বার ক্ষমা চেয়ে নেওয়া উচিত। তা আর করা হয়ে ওঠেনি অবশ্য। এ দিকে আবার নিরাপত্তাকর্মীরা বলছেন, অবিলম্বে টার্মিনাল খালি করে দিতে হবে। কবে, কখন বিমান ছাড়বে, কোনও স্থিরতা নেই। শুনলাম রবিবারের আগে বিমান চালু হওয়ার সম্ভাবনাই নেই।

শেষমেশ প্রচুর টাকা দিয়ে একটা গাড়ির ব্যবস্থা করে ভাসতে ভাসতে কী করে যে হোটেলে এসে উঠেছি, বলে বোঝাতে পারব না। তবে সকালে বিমানবন্দর ছাড়ার আগে দেখেছিলাম, তখনও টার্মিনালের ভিতরের ডিসপ্লে বোর্ড বলছে— সব বিমান নির্ধারিত সময়েই ছাড়বে।

লেখক মৎস্য দফতরের অতিরিক্ত অধিকর্তা

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE