কোচাঙের এই গির্জা-সংলগ্ন চত্বর থেকেই দুষ্কৃতীরা তুলে নিয়ে গিয়েছিল পাঁচ তরুণীকে। —নিজস্ব চিত্র।
বর্ষা আসছে। এ বার জঙ্গলে যাওয়া বন্ধ হবে সুখমতি মুন্ডার। তাই তিনি খুব ব্যস্ত। সারান্ডার জঙ্গলে কাঠ কুড়িয়ে হাটে বিক্রি করে কোনও মতে জীবন কাটান তিনি। শুকনো কাঠ সংগ্রহের শেষ সময়ে বিরক্ত করা মোটেই পছন্দ করেন না।
তাঁর পরিবারের আর কেউ বেঁচে নেই। সরকারের বার্ধক্য বা বিধবা ভাতা নেই। ভরপেট খাবার নেই। আরও অনেক কিছুই নেই। সেই নেই রাজ্যের বাসিন্দা তিনি।
কোচাং গ্রামে ঢোকার মুখে যেখানে বড় পাথর বসানো হয়েছে তার কাছেই কুঁড়ে তাঁর। বড় পাথরে হিন্দিতে অনেক কথা লেখা রয়েছে। সেখানে নাকি লেখা রয়েছে সুখমতির জঙ্গলের উপরে অধিকারের কথা।
আরও পড়ুন: অধ্যাপকের মুখে কালি দিল এবিভিপি
সুখমতি হিন্দি জানেন না। পড়তে পারা দূরের কথা, হিন্দিতে কথা পর্যন্ত বলতে পারেন না। মুন্ডারি ভাষায় কথা বলেন। সে ভাষা শহর থেকে আসা মানুষের কাছে দুর্বোধ্য। মুন্ডাদের গ্রামে বহিরাগতদের ‘দিকু’ বলেই ডাকা হয়। আচমকা গ্রামে ‘দিকু’দের আসা-যাওয়ায় চিন্তায় সুখমতি। কারণটাও জানেন তিনি। পাশের গ্রাম থেকে পাঁচটা মেয়ে নাটক দেখাতে এসেছিলেন। তাঁদের তুলে নিয়ে গিয়ে অত্যাচার করা হয়েছে।
ঘটনার দিন কোচাং গ্রামের মোড়েই বসেছিলেন সুখমতি। নাটক দেখছিলেন। হিন্দি ভাষায় করা প্রশ্নের অনুবাদ শোনার পরে তিনি বলেন, “গরিব মানুষের মেয়েদের সঙ্গে এখানে এর আগে কখনও এমন হয়নি। যারা করেছে নরকে যাবে তারা। তবে পুলিশ যাঁদের ধরেছে তাঁরা
দোষী নয়।” কারা করেছে? সুখমতি প্রশ্নটা শোনার পরে বেশ কিছুক্ষণ চোখের দিকে তাকিয়ে থাকেন। তারপর মুখ ঝামটা দিয়ে শুকনো কাঠের বোঝাটা নিয়ে এগিয়ে যান।
রাঁচী শহর থেকে কোচাং গ্রামের দূরত্ব প্রায় ৮৪ কিলোমিটার। জঙ্গলের মধ্যে থাকা গ্রামে পরিষেবা কিছুই নেই। একটা সরকারি মিডল স্কুল রয়েছে। তাতে শিক্ষক নেই। স্বাস্থ্যকেন্দ্র নেই। অনেক পরিষেবার ব্যবস্থা করেছে আর সি মিশন। পাঁচ আদিবাসী তরুণীর ধর্ষণ কাণ্ডে সেই মিশনের ফাদারকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ।
গ্রামের মাধ্যমিক পাশ তরুণী লুকি কান্ডারকে ধর্ষণ কাণ্ডের কথা বলতেই আশপাশ দেখে নেন। তিনি বলেন, “এখানে মুখ খুললেও বিপদ। না খুললেও বিপদ। ফাদার মুখ খুললে ওরা ছাড়ত না। এখন পুলিশ ধরেছে। তবে ওদের সাজা হওয়া দরকার।” ওরা কারা? এমন সময়ে হাজির হন গ্রামসভার নেতা সুখময় মুন্ডা এবং দুলাল কান্ডার। লুকির সঙ্গে কী কথা হচ্ছিল জানতে চান তাঁরা। লুকি হাসতে হাসতে বলেন, “আমার পড়াশোনার খবর নিচ্ছিলেন।”
কোচাং গ্রামে মোবাইল টাওয়ার নেই। ফোন-ইন্টারনেট নেই। গ্রামের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য নজরকাড়া। অথচ পুলিশ-মাওবাদী এবং পিএলএফআই জঙ্গিদের মাঝে পড়ে বিপন্ন সেই গ্রামের মানুষ। বিশেষ করে মেয়েরা। তাঁদের কথা শুনছে কে! কথা বলাই তো বারণ তাঁদের। ফেরার সময়ে গাড়ির জানালা দিয়ে দেখতে পাই একদৃষ্টিতে সুখমতি তাকিয়ে আছেন। অত্যাচারীর নরকবাসে যাওয়ার আশা নিয়ে বেঁচে থাকুন বৃদ্ধা!
(শেষ)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy