খোশমেজাজে। হায়দরাবাদ হাউসের বাগানে বারাক ওবামার সঙ্গে নরেন্দ্র মোদী। ছবি: রয়টার্স
হিমঘর থেকে বার করে এনে ভারত-মার্কিন অসামরিক পরমাণু চুক্তিকে আজ কার্যত নতুন জন্ম দিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এবং মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা।
প্রজাতন্ত্র দিবসের আগের দিন দু’দেশের শীর্ষ পর্যায়ের বৈঠককে তাই ঐতিহাসিক অ্যাখ্যা দিচ্ছেন কূটনীতিকেরা। যে জটগুলির কারণে এত দিন কার্যত ঠান্ডা ঘরে পড়েছিল এই চুক্তি, আজ তার সমাধান হয়েছে বলে সরকারি সূত্রেই বলে দেওয়া হচ্ছে। বারাক ওবামাকে পাশে নিয়ে আজ মোদী বলেন, “গত চার মাসে পরমাণু চুক্তি নিয়ে আমরা ভেবেচিন্তে এগিয়েছি। আজ আনন্দের সঙ্গে জানাচ্ছি, আমাদের দেশের আইন এবং আন্তর্জাতিক আইনের বাধ্যবাধকতা মেনেই এই চুক্তির ভিত্তিতে বাণিজ্যিক সহযোগিতা শুরু হতে চলেছে।” ওবামাও জানান যে, পরমাণু চুক্তির ক্ষেত্রে জট খোলা সম্ভব হয়েছে।
শীর্ষ বৈঠকের শেষে তাই খুশির হাওয়া সাউথ ব্লকে। কারণ গত তিন-চার মাস একেই পাখির চোখের মতো দেখেছেন মোদী এবং তাঁর টিমের সদস্যেরা। গত বছর মে মাসে বিপুল ভাবে জিতে ক্ষমতায় আসার পর বিদেশনীতির সঙ্গে বাণিজ্যনীতির যোগসূত্র তৈরির কৌশল নিয়েছিলেন তিনি। তখনই ঘনিষ্ঠ শিবিরে প্রধানমন্ত্রী জানিয়েছিলেন, ভারত-মার্কিন অসামরিক পরমাণু চুক্তিটি দ্রুত রূপায়ণ করতে চান তিনি। কারণ এটি তাঁর ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ নীতির সঙ্গে সাযুজ্য রেখে চলে। এটি রূপায়িত হলে পুরোপুরি ভাবে মার্কিন বিনিয়োগে ভারতে বিরাট মাপের পরমাণু চুল্লি বা কারখানা তৈরি করা সম্ভব হবে। এর ফলে তেল বা ফসিল-জ্বালানির উপর (যা ভারতকে বিপুল বিদেশি মুদ্রা খরচ করে আমদানি করতে হয়) নির্ভরতা কমবে। এই ধরনের বড় প্রকল্প ভারতে হলে তার ইতিবাচক প্রভাব পড়বে দেশের অর্থনীতিতে। কর্মসংস্থানও বাড়বে অনুসারী শিল্পের মাধ্যমে।
প্রধানমন্ত্রীর দফতর সূত্রের খবর, মোদী এটাও মনে করেছেন যে, এই চুক্তিটির ক্ষেত্রে তাঁর বড় সুবিধে হল তাঁকে বিষয়টি শূন্য থেকে শুরু করতে হচ্ছে না। চুক্তি সইসাবুদ হয়ে রয়েছে, এখন শুধু সরকারকে তার উপর থেকে ধুলোটা ঝেড়ে ব্যবহারযোগ্য জায়গায় নিয়ে আসতে হবে। গত সেপ্টেম্বরে মোদী যখন ওবামার আমন্ত্রণে ওয়াশিংটনে গিয়ে তাঁর সঙ্গে বৈঠক করেন, তখনই এই ‘ধুলো ঝাড়ার’ কাজটিকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়। তখনই দু’দেশের মধ্যে পরমাণু ‘কন্ট্যাক্ট গ্রুপ’ তৈরির সিদ্ধান্ত হয়। গত চার মাসে তিন বার কিছুটা গোপনে এই গোষ্ঠীর সদস্যেরা বৈঠকে বসেন। সরকারি সূত্রের দাবি, ভারতে এই বৈঠক হলে বিষয়টি নিয়ে যদি অন্য রকম প্রচার হয়, তাই এই তিনটি বৈঠকের মধ্যে প্রথমটি ভিয়েনায় এবং শেষটি (ওবামার সফরের ঠিক আগে) হয়েছিল লন্ডনে।
রবিবার সন্ধ্যায় বিদেশসচিব সুজাতা সিংহ জানান, চুক্তি নিয়ে আমেরিকার আপত্তি এবং আশঙ্কার জায়গাগুলিকে দূর করা গিয়েছে। শুধু মুখের কথা নয়। পরমাণু চুক্তি রূপায়ণের বিষয়টিকে ভারত-মার্কিন যৌথ বিবৃতিতেও রাখা হয়েছে। বলা হয়েছে, ‘২০১৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে কন্ট্যাক্ট গ্রুপ তৈরি করা হয়েছিল দ্বিপাক্ষিক পরমাণু সহযোগিতাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য। ডিসেম্বর এবং জানুয়ারিতে তিন বার এই গ্রুপ বৈঠক করেছে। দু’দেশের নেতারাই পরমাণু দায়বদ্ধতা এবং এর প্রশাসনিক দিকগুলি নিয়ে একমত হয়েছেন। যত দ্রুত সম্ভব ভারতের শক্তিক্ষেত্রে নিরাপত্তা বাড়াতে আমেরিকার তৈরি পরমাণু চুল্লি বসানো হবে।’ সুজাতা সিংহ জানান, জেনারেল ইন্সিওরেন্সের নেতৃত্বে মোট পাঁচটি রাষ্ট্রায়ত্ত বিমা সংস্থা একযোগে একটি বিমা তহবিল তৈরি করবে। পরমাণু চুল্লির যন্ত্রাংশ খারাপ হলে এই তহবিল ব্যবহার করা হবে। বিদেশসচিবের কথায়, “মোট ৭৫০ কোটি টাকার তহবিল তৈরি হচ্ছে। বিশ্বে এই ধরনের মোট ২৬টি তহবিল রয়েছে। ভারতীয় পরমাণু তহবিলটিও সেই আদলেই করা হবে। এর ফলে সরবরাহকারীর উপর কোনও আর্থিক বোঝা আসবে না। এটি ঝুঁকি কমানোর একটি পদ্ধতি।” আগে চুল্লিতে দুর্ঘটনা হলে বিপুল দায়বদ্ধতার মুখে পড়তে হতো সরবরাহকারী সংস্থাকে। কিন্তু ভারত জানিয়ে দিয়েছে, এই দায়বদ্ধতা সীমাহীন নয়। সীমা নির্ধারণের জন্য অ্যাটর্নি-জেনারেল মার্কিন প্রশাসনের সঙ্গে আলোচনা শুরু করেছেন। আন্তর্জাতিক পরমাণু সংস্থার (আইএইএ) বিধি মেনেই বিষয়টি নিয়ে সিদ্ধান্ত হবে। আলোচনা ইতিবাচক দিকে যাচ্ছে বলেই খবর। সংশ্লিষ্ট অফিসাররা জানাচ্ছেন, এক দিনে সিদ্ধান্তে পৌঁছনো সম্ভব হয়নি। সময় লেগেছে।
শেষ পর্যন্ত তহবিল গঠন নিয়ে ঐকমত্য হলেও সমস্যা হয় অন্যত্র। এবং তা-ও একেবারে অন্তিম মুহূর্তে অর্থাৎ ওবামা আসার দু’দিন আগে, লন্ডনে ‘কন্ট্যাক্ট গ্রুপের’ শেষ বৈঠকে। পরমাণু চুল্লি যে হেতু আমেরিকা তৈরি করবে, তাই তারা চাইছিল এখানে যে সব তেজস্ক্রিয় পদার্থ ব্যবহার করা হবে, সেগুলিকে মার্কিন পর্যবেক্ষণের আওতায় রাখতে। তাদের আশঙ্কা ছিল, এই সব তেজস্ক্রিয় পদার্থ থেকে পুনর্ব্যবহারের (রিসাইক্লিং) মাধ্যমে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির সম্ভাবনা রয়েছে। শেষ পর্যন্ত এ নিয়ে ঐকমত্যে পৌঁছনো সম্ভব হয়েছে মোদী-ওবামা বৈঠকে। মোদীকে আজ ওবামা জানিয়ে দেন, পর্যবেক্ষণের বিষয়টিতে তাঁরা নাক গলাতে চান না। ভারতকে পরমাণু সরবরাহকারী গোষ্ঠীতে (এনএসজি) ঢোকানোর প্রক্রিয়াতেও গতি আনা হয়েছে।
২০০৮ সালে জর্জ বুশের জমানায় প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ এই চুক্তি করে বিশ্বে বিপুল খ্যাতি পেলেও তা দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। কূটনৈতিক শিবিরের মতে, মনমোহনের একান্ত ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও তাঁর সামনে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল শরিকি চাপ। পরমাণু চুক্তির বিরোধিতা করে বামেরা সমর্থন প্রত্যাহার করে নিলেও অন্য শরিকদের চাপের মুখে এগোতে পারেননি মনমোহন। ইউপিএ-র দ্বিতীয় দফায় কংগ্রেস আসন বাড়িয়ে ক্ষমতায় এলেও শরিকি চাপেই নীতিপঙ্গুত্বের শিকার হন মনমোহন। তার সঙ্গে ছিল ভোটের অঙ্কও। আর এ সবের নিট যোগফল পরমাণু চুক্তির ঠান্ডাঘরে চলে যাওয়া। এমনও একটা সময় গিয়েছে, যখন প্রায় প্রতি দু’মাস অন্তর সাউথ ব্লকে এসে দরবার করেছেন মার্কিন আমলারা। মার্কিন বাণিজ্য সংস্থাগুলিরও (পরমাণু ক্ষেত্রে) প্রবল চাপ ছিল। কিন্তু ওয়াশিংটনের তরফে ধারাবাহিক দৌত্য বহাল থাকা সত্ত্বেও বরফ গলেনি। ভারতীয় সংসদে পাশ হওয়া পরমাণু দায়বদ্ধতা আইন মানলে মার্কিন সরবরাহকারী সংস্থাগুলিকে যে পরিমাণ ক্ষতিপূরণ দিতে হতো, তা দেখে উৎসাহে ভাটা পড়ছিল তাদের। এই অচলাবস্থা থেকে মুক্তি পাওয়ার কোনও সম্ভাবনাও কিন্তু তৈরি করতে পারেননি দু’তরফের কোনও নেতাই।
আট বছর পরে যা করে দেখালেন নরেন্দ্র মোদী। বারাক ওবামাকে পাশে নিয়ে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy