Advertisement
২৩ এপ্রিল ২০২৪

পাহাড়-জঙ্গলে শ্রীময়ী শ্রীখোলা

আমার বন্ধু-কাম-বর মলয় এতক্ষণ ধরে আমাদের কথোপকথন শুনছিল। আমি জিজ্ঞাসু মুখে মলয়ের দিকে তাকাতেই সে বলে উঠল, ‘‘দীপুদাকে বলো হোটেল আর গাড়িটা বুক করে দিতে। আমি তৎকালে টিকিটটা কেটে নিচ্ছি।’’

দোলা মিত্র
শেষ আপডেট: ১৫ অগস্ট ২০১৭ ০২:২২
Share: Save:

এপ্রিলের শেষাশেষি একটা রবিবারের বিকেল। প্রখর তপনতাপে সারাদুপুর ঝিমিয়ে থাকা পাড়াটা জেগে উঠছে। রোদ পড়ে গিয়ে সমস্ত আকাশজুড়ে সিঁদুরে লাল মেঘের কমনীয়তা। বারান্দায় রাখা জুঁই আর বেলফুলের টবে জল দিচ্ছিলাম আর মনে মনে রিওয়াইন্ড করছিলাম কয়েক বছরের বেড়াতে যাওয়ার স্মৃতিগুলোকে। চমকে উঠলাম ডানা ঝাপটানোর মৃদু আওয়াজে। মনের ভিতর ইচ্ছেডানারা পাখা মেলতে শুরু করেছে যে। কিন্তু কোথায় যাওয়া যায়? অফিস থেকে তো কিছুতেই তিন-চার দিনের বেশি ছুটি ম্যানেজ করা যাবে না। ভাবতে ভাবতেই মনে পড়ল দীপুদার কথা। দীপুদা অর্থাৎ দীপ্তেন্দ্রনাথ ঘোষ দার্জিলিঙের একটি হোটেলের কর্ণধার ও আমাদের পারিবারিক বন্ধু। মোবাইল দীপুদার কাছে আব্দার করলাম বেড়াতে যাওয়ার মতো একটা জায়গা খুঁজে দেওয়ার জন্য। উত্তর যেন দীপুদার ঠোঁটের আগাতেই ছিল। বলল—‘শ্রীখোলা ঘুরে এসো’।

‘‘শ্রীখোলা! সেটা কোথায়?’’ —আমি জিজ্ঞাসা করলাম।

দীপুদা বলল, ‘‘শ্রীখোলা একটা নদীর নাম। পাহাড়ি ভাষায় নদীকে বলে খোলা।’’

‘‘কিন্তু জায়গাটা কোথায় সেটা বলবে তো,’’ আমি কিছুটা অধৈর্য্য।

দীপুদার উত্তর, ‘‘দার্জিলিঙের খুব কাছে কিন্তু দার্জিলিং থেকে দূরে।’’

দ্বিধাগ্রস্ত গলায় বললাম, ‘‘অত দূরে যাব শুধু একটা নদী দেখতে?’’

‘‘আহা, গিয়েই দ্যাখো। পাহাড়-নদী-জঙ্গলের ফুল প্যাকেজ পাবে,’’ —বলে দীপুদা আশ্বস্ত করল।

আমার বন্ধু-কাম-বর মলয় এতক্ষণ ধরে আমাদের কথোপকথন শুনছিল। আমি জিজ্ঞাসু মুখে মলয়ের দিকে তাকাতেই সে বলে উঠল, ‘‘দীপুদাকে বলো হোটেল আর গাড়িটা বুক করে দিতে। আমি তৎকালে টিকিটটা কেটে নিচ্ছি।’’

উঠল বাই তো শ্রীখোলা যাওয়া চাই। উৎসাহিত হয়ে আলমারির তাক থেকে জামাকাপড়গুলো নামিয়ে নিয়ে গোছগাছ শুরু করে দিলাম আর ফাঁকা তাকে রেখে দিলাম আমার দ্বিধাদ্বন্দ্বগুলোকে। পরের শুক্রবার সন্ধে সাড়ে সাতটায় নিজেদের আবিষ্কার করলাম উত্তরবঙ্গ এক্সপ্রেসের এসি টু টায়ার কোচে। মাঝখানের তিন-চারটে দিন কেনাকাটা, লাগেজ গোছানো আর টিকিট কাটার টেনশনের মধ্যে দিয়ে যে কীভাবে কেটে গেল কে জানে? রাত ১১টার মধ্যে দুজনে দুটো আপার বার্থে বিছানা করে নিলাম। এসির কনকনে ঠাণ্ডায় দুচোখে ঘুম নেমে আসতে দেরি হল না।

পরের দিন সকাল সাতটায় নিউজলপাইগুড়ি স্টেশনে। গোটা স্টেশন তখন আড়মোড়া ভাঙছে। ড্রাইভারকে চিনি না তাই ফোন করলাম। মিনিট তিনেকের মধ্যেই সে হাজির। দেখি, দীপুদার কল্যাণে একটা ছটফটে পাহাড়ি ড্রাইভার পাওয়া গেছে—নাম রনি। রনি বলল, ‘‘আপলোগ জলদিসে চায়ে-নাস্তা কর লিজিয়ে। ফির ইঁহাসে কম-সে-কম ছে ঘণ্টেকা রাস্তা হ্যায়।’’ যখন গাড়ির পেটে নিজেদের চালান করলাম তখন ঘড়িতে সময় সকাল ৮টা। গাড়ি ছুটে চলল তীব্র গতিতে। চা-বাগান, অসংখ্য বাঁশঝাড় আর বড় বড় গাছ, পথের ধারে ফুটে থাকা থোকা থোকা বুনোফুলের গন্ধের মৌতাত নিতে নিতে আমিও চললাম পরীর দেশে বন্ধ দুয়ারে হানা দিতে।

নলার বাইরে তাকিয়ে থাকতে থাকতে বোধহয় চোখদুটো একটু লেগে এসেছিল। হঠাৎ চটকা ভাঙল গাড়ি থেমে যেতে। জায়গার নাম ঘুম। এক টানা আড়াই ঘণ্টা সফরের পর এখানেই একটা চা-পানের বিরতি। গাড়ী থেকে নেমেই হাত-পাগুলোকে চার- পাঁচবার শূন্যে ছুঁড়ে দিলাম খিল ছাড়াবার জন্য। এখানকার প্রকৃতি বেশ ঠান্ডা। উপরে নীলাভ আকাশের চাঁদোয়া আর তার নীচে ঝলমলে রোদ মেখে দাঁড়িয়ে আছে ঘুম রেল স্টেশন।

প্রায় ১১টা নাগাদ গাড়ী আবার স্টার্ট দিল। ঘুম থেকে এগিয়ে আধ ঘণ্টা হয়েছে কি হয়নি, আরম্ভ হল এক অপরূপ দৃশ্য। রাস্তার প্রতিটি বাঁকে, পাহাড়ের খাঁজে ফুটে আছে অপূর্ব সুন্দর সব ফুল। একি! স্বপ্ন দেখছি না তো! চোখ কচলে আবার তাকালাম। নাহ, এতো মায়া নয়। এ যে সত্যি। অবর্ণনীয় রঙের অর্কিডগুচ্ছ, রাজকীয় রোডোডেনড্রন, সারল্যমাখা ডেইজি, পিটুনিয়া, নানা জাতের টিউলিপ আর গোলাপ গোটা পাহাড় জুড়ে ফুলের আগুন লাগিয়েছে। প্রকৃতির অকৃপণ দানে ছোট ছোট কাঠের বাড়িগুলির বারান্দাতেও যেন ফ্লাওয়ার শো বসেছে। যাঁরা এই লেখাটি পড়ছেন তাদের কাছে আমি ক্ষমাপ্রার্থী কেননা এই সৌন্দর্য্য ভাষায় প্রকাশ করার ক্ষমতা আমার কলমের নেই।

ঘড়ির কাঁটা যখন প্রায় দুটো ছুঁইছুঁই, পৌঁছলাম রিম্বিক। থামার ইচ্ছে না থাকলেও থামতেই হল একটা কারণে। কারণটা আর কিছুই নয়, সেটা হল আমার অল্টিচিউড সিকনেস। আমরা সমতলের মানুষ, তাই পাহাড়ি পথের পাকদন্ডিকে সইয়ে নিতে সময় লাগে বৈকি। রিম্বিক বেশ ঘিঞ্জি জনপদ। কোনো বিশেষ দ্রষ্টব্য নেই, তবে বেশ দারুণ কয়েকটা কিউরিও শপ আছে। রনি ড্রাইভার জানাল, এখান থেকে শ্রীখোলা আর মিনিট দশেকের পথ। সেই সকাল আটটায় ব্রেকফাস্ট। তার পর রাস্তায় অজস্র বিস্কুট আর চকলেটের বংশ ধ্বংস করার পরেও দেখছি পেটের মধ্যে কারা যেন ডন মেরেই যাচ্ছে। ঠিক করলাম যে এখানেই লাঞ্চ সেরে নেব। লাঞ্চ করতে করতেই রোদের তেজটা কেমন যেন ঝিমিয়ে এল। দেখি, আকাশজুড়ে সিঁধ কেটেছে বাদল মেঘের দল। ক্রমশ জোরে হাওয়া বইতে শুরু করল আর সিঁধটা বড় হতে হতে মেঘের পাহাড় হুড়মুড় করে আকাশ ছেয়ে দিল। লাঞ্চ প্রায় শেষ এমন সময় নামল অঝোরধারা। একনাগাড়ে বৃষ্টি হল আধঘণ্টা।

বৃষ্টি থামলে পরে গাড়ীতে চাপলাম। আজকের যাত্রাপথের লাস্ট স্পেল। পথের অবস্থা কিন্তু বেশ খারাপ। গাড়ি কখনো ডানদিকে কাত হয়ে যাচ্ছে, কখনও বাঁদিকে। রাস্তার ডান দিকে খাদ। কয়েক জায়গায় ধস নেমেছে। তবে এ পথে আমাদের জন্য আরেক বিস্ময় অপেক্ষা করে ছিল। বলা যেতে পারে যে শুধু পাথর ছড়ানোই নয়, পথের সৌন্দর্য্য ঝরনা ঝরানোও বটে। তিন জায়গায় তিনটে পাহাড়ি ঝোরা বৃষ্টির জলে পুষ্ট হয়ে ঝরঝর করে নেমে আসছে পাহাড়ের গা বেয়ে। গাড়ী থামিয়ে ছবি তুলতে গিয়ে দশ মিনিটের পথ নিয়ে নিল পাক্কা আধ ঘণ্টা। মাঝে মাঝে ভাবি, ভাগ্যিস এখন ডিজিটাল ক্যামেরার যুগ। নাহলে, আগেকার দিনের মতো রিল ভরা ক্যামেরায় ছবি তুলতে হলে কত রিল যে খরচা হত কে জানে।

হোটেলটা নদীর একদম গায়ে। হোটেলের রুমে কোনমতে লাগেজটা রেখেই বাইরে চলে এলাম। চারিদিক ঘন বনে ঘেরা। গাছের ডালের ফাঁকে ফাঁকে চাপ চাপ কুয়াশা জমাট বেঁধে আছে। বৃষ্টি আর হয়নি বটে, তবে রোদও ওঠেনি। শেষ বিকেলের মেদুর আলোয় দেখতে পেলাম কলকল শব্দে নির্ঝরিণী বয়ে চলেছে। কিন্তু সে দিন ওটুকু দেখাই সার। দেখতে দেখতে আকাশ থেকে ঝুপ করে নেমে এল রাতের নিকষ কালো অন্ধকার।

সন্ধেবেলায় হাড়কাঁপানো ঠান্ডতেও দুজনে দুটো চেয়ার টেনে বাইরে বারান্দায় বসে আছি। অবশ্য আমাদের কাছে রাত আটটা সন্ধে মনে হলেও এখানে মধ্যরাত। ইচ্ছে করেই বারান্দার আলো জ্বালাইনি। একটানা নদীর গর্জন শোনা যাচ্ছে। বাইরে ঝিঁঝিঁমুখর নৈঃশব্দ্য। উপরে নক্ষত্রখচিত আকাশ। আকাশে যে এত তারা গিজগিজ করে, সেটা কলকাতায় বসে টেরই পাইনি। বুনো গন্ধে চারপাশ ম ম করছে। কেমন যেন ঝিম ধরে এসেছিল। হঠাৎ মলয় আমার হাতে মৃদু টোকা দিল। ওর দিকে তাকাতেই ফিসফিসে গলায় প্রশ্ন করল, ‘কাল পূর্ণিমা ছিল নাকি’? বলে আমার উত্তরের অপেক্ষায় না থেকে আঙুল তুলে দেখাল। লম্বা গাছগুলোর মাথার উপর থেকে ঈষৎ জাফরানি আলো মেখে বেরিয়ে আসছে গোলাকৃতি চাঁদ। সে আলোয় সমস্ত জঙ্গল মাতোয়ারা। নদীর কালো জলে জায়গায় জায়গায় রুপোলি ঝিলিক। পূর্ণিমার পরের দিনের মরা আলোর মাদকতা যে পূর্ণিমার চেয়েও বেশি সেটা এখানে না এলে কে জানত?

সকালে ঘুম ভাঙার সঙ্গে সঙ্গে বিছানা থেকে তড়াক করে নামলাম। আধ ঘণ্টার মধ্যে রেডি হয়ে হোটেলের বাইরে চলে এলাম। রোদ্দুর থৈ থৈ সকাল। যেদিকে চোখ যায় সেদিকেই সবুজ চলকে পড়ছে। আকাশের গায়ে ঠোঁট ছোঁয়ানো পাইন, ওক এবং চেস্টনাটের পাতার ফাঁকে লেগে থাকা শিশিরবিন্দু থেকে ঠিকরে পড়ছে সোনাঝরা আলো। আর সেই ঘন বনের বুক চিরে বয়ে চলেছে শ্রীখোলা নদী। শরীরে তার পঞ্চদশীর প্রাণোচ্ছলতা। শীতের শীর্ণা জলধারা গ্রীষ্মকালে বৃষ্টিস্নাত হয়ে নবযৌবনের উন্মেষে বয়ঃসন্ধির নিরাবরণ কিশোরীর মতই শিহরিতা, গর্বিতা, আপনবেগে পাগলপারা। তার রূপে বুঁদ হয়ে গেলাম। কিছুটা এগিয়ে একটা বোল্ডারের উপরে বসলাম। আমাদের কয়েক হাত দূরে আরেকজন ট্যুরিস্ট দিব্যি মাছধরার সরঞ্জাম নিয়ে এসেছেন। এ জায়গাটা সিঙ্গালিলা ন্যাশনাল ফরেস্টেরই একটা অংশ। অগুনতি পাখি গাছে গাছে তাদের সাম্রাজ্যবিস্তার করেছে। থ্রাশ, সুইফট্, স্কারলেট মিনিভেট, জাঙ্গল ওয়ার্বলার-কী নেই! বাইনোকুলারে চোখ রেখে দেখি কোন পাখি সুরেলা গলায় একটানা শিস দিয়ে চলেছে, কেউ বা ব্যস্তভাবে বাসা বাঁধার কাঠকুটো খুঁজতে খুঁজতে পাশের সঙ্গীকে একটু বকে দিচ্ছে, কেউ বাচ্চার মুখে খাবার তুলে দিতে দিতে গদ্গদ স্বরে আদর করছে। পাখিদের কলতান, নদীর মন্দ্রমুখর তরঙ্গ আর পাহাড়ের গায়ে ধাক্কা লেগে ফিরে আসা শনশন হাওয়ার প্রতিধ্বনি ছাড়া কোথাও শব্দ নেই। এই অখণ্ড নিস্তব্ধতার নেশায় তলিয়ে যেতে যেতে অনুভব করলাম আমি বোধহয় সভ্য মানুষের পৃথিবী থেকে বিচ্যুত হয়ে কোটি আলোকবর্ষ দূরের কোনও এক গ্রহাণুতে চলে এসেছি।

বেশ কিছুক্ষণ পরে আমরা উঠে পড়ে হাঁটতে লাগলাম। পাহাড়ি পথ ফুলে ফুলে ঢাকা। মনোরম একটা ঝুলন্ত কাঠের ব্রিজের উপর দিয়ে নদীর এক দিক থেকে আরেক দিকে চলে গেলাম। বনের সুঁড়িপথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে অনেকদূর চলে গিয়েছিলাম। ফিরতি পথে কিছুটা এগোনোর পর একটা বাঁক ঘুরতেই দেখি আমাদের থেকে বেশ কয়েক ফুট দূরত্বে পিছু ফিরে দাঁড়িয়ে এক কাজলনয়না হরিণী। তাকে লেন্সে ধরলাম। কিন্তু তার সজাগ ষষ্ঠেন্দ্রিয় তাকে আমাদের উপস্থিতির বার্তা দিল। সেই বনহরিণী ঘাড় ঘুরিয়ে সচকিত দৃষ্টি মেলে কয়েক সেকেন্ড আমাদের জরিপ করেই লাফ দিয়ে অন্তর্হিত হল গভীর অরণ্যে।

যতক্ষণে ঝুলন্ত সেতুতে ফিরে এলাম, ততক্ষণে নীল জলরঙ ঢালা আকাশের ক্যানভাসে আরম্ভ হয়েছে কালচে ধূসর প্যাস্টেল শেডের পোষাকপরা মেঘবালিকাদের জমায়েত। মিনিট দুয়েকের মধ্যেই গোটা জঙ্গল হয়ে উঠল মেঘের চাদরে মোড়া অমরাবতী। তারপর শ্রীখোলার বুকে ঝেঁপে বৃষ্টি নামল। নদীর জলধারায় ভাসতে ভাসতে চলে গেলাম পরবর্তী গন্তব্যে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE