Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪

কাক বললেন, প্রায় সবই ব্যাদে আছে

কে এই বিজ্ঞানী? আমেরিকায় ওকলাহোমা স্টেট ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক সুভাষ কাক।

কলকাতার বসু বিজ্ঞান মন্দিরে অধ্যাপক সুভাষ কাক। শনিবার। ছবি: স্বাতী চক্রবর্তী

কলকাতার বসু বিজ্ঞান মন্দিরে অধ্যাপক সুভাষ কাক। শনিবার। ছবি: স্বাতী চক্রবর্তী

পথিক গুহ
কলকাতা শেষ আপডেট: ০১ ডিসেম্বর ২০১৯ ০২:২৬
Share: Save:

সব ব্যাদে আছে। একদা ব্যঙ্গচ্ছলে উচ্চারণ করেছিলেন বিজ্ঞানী মেঘনাদ সাহা। আধুনিক বিজ্ঞানে এমন কোনও আবিষ্কার নেই, যা প্রাচীন ভারতীয়রা জানতেন না— এই দাবির বিরুদ্ধেই ছিল তাঁর ব্যঙ্গ। আজ কলকাতার বসু বিজ্ঞান মন্দিরে ৮১তম আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু স্মৃতি বক্তৃতা দিয়ে বস্তুত মেঘনাদের বক্তব্যের পাল্টা দিলেন আমেরিকায় অধ্যাপনারত এক ভারতীয় বংশোদ্ভূত বিজ্ঞানী। তাঁর দাবি: কম্পিউটার চলে যে যুক্তি নির্ভর করে, তার জন্ম ভারতে; চেতনা, যে গবেষণা নিয়ে খাবি খাচ্ছেন পাশ্চাত্য বিশেষজ্ঞেরা, সে সম্পর্কে শেষ কথা বলা আছে বেদান্ত দর্শনে; বিনা তারে যোগাযোগও বেদান্ত দর্শন থেকেই ধার করা।

কে এই বিজ্ঞানী? আমেরিকায় ওকলাহোমা স্টেট ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক সুভাষ কাক। যাঁর গবেষণা কৃত্রিম বুদ্ধি, তথ্য-প্রযুক্তি নিরাপত্তা এবং বিজ্ঞানের ইতিহাস নিয়ে। পদ্মশ্রী সম্মানে ভূষিত এই বিশেষজ্ঞ ভারতে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সায়েন্স, টেকনোলজি অ্যান্ড ইনোভেশন অ্যাডভাইসরি কাউন্সিলের অন্যতম সদস্য। ভারতে বিজ্ঞানের জার্নাল ‘কারেন্ট সায়েন্স’-এ প্রকাশিত কাক-এর লেখাপত্রের বিরুদ্ধে ইতিমধ্যেই সরব হয়েছেন জনা কয়েক বিজ্ঞানী। সামাজিক মাধ্যমে সরব হয়েছেন কেউ কেউ।

আজ বসু বিজ্ঞান মন্দিরে তাঁর ভাষণে কাক বললেন, কম্পিউটার যুক্তি-নির্ভর যন্ত্র। যুক্তিগুলির প্রণেতা তিন জন। জর্জ বুল, চার্লস ব্যাবেজ এবং অগস্টস ডি মর্গ্যান। বুল-এর স্ত্রী মেরি বুল ১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দে লেখা তাঁর স্মৃতিকথায় জানিয়েছেন, ওঁরা তিন জনই যাঁর চিন্তায় প্রভাবিত হয়েছিলেন, তিনি হলেন ভারতে বসবাসকারী সার্ভেয়র-জেনারেল জর্জ এভারেস্ট, যাঁর নামে এভারেস্ট শৃঙ্গ চিহ্নিত। মেরির মতে, নব্য ন্যায় দর্শন-এ বিবৃত যুক্তিশাস্ত্রই এভারেস্ট শিখিয়েছিলেন তিন শিষ্যকে। নব্য ন্যায় দর্শনে বিধৃত গাণিতিক যুক্তিই কম্পিউটার বিজ্ঞানের ভিত।

আরও পড়ুন: ধুলোর উঁচু উঁচু স্তম্ভই কি উড়িয়ে দিয়েছে মঙ্গলের সবটুকু জল!

বেতার যোগাযোগের প্রশ্নে কাক বললেন, আমেরিকায় ১৮৯৬ খ্রিস্টাব্দে স্বামী বিবেকানন্দের সঙ্গে দেখা হয়েছিল ওখানকার অন্যতম শ্রেষ্ঠ ইঞ্জিনিয়ার নিকোলা টেসলা-র। দেখা হয়েছিল এক পার্টিতে। সে আড্ডার আয়োজক অভিনেত্রী সারা বার্নডট। বিবেকানন্দ টেসলাকে বলেছিলেন, বেদান্ত-চিন্তার কথা, যাতে আকাশ বা ইথার-এর ধারণা আছে। টেসলা বিবেকানন্দকে বলেছিলেন, তিনি পদার্থ এবং শক্তির সমতা প্রমাণ করে ছাড়বেন। এটা আলবার্ট আইনস্টাইনের E=mc2 সমীকরণ আবিষ্কারের আগের কথা। টেসলা অবশ্য সেই সমতা প্রমাণ করতে পারেননি। তবে তিনি বিনা তারে এনার্জি বা শক্তি পরিবহণ নিয়ে অনেক কাজ করেছিলেন। আকাশ হল বৈশেষিক দর্শনে আলোচিত এক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।

বসু বিজ্ঞান মন্দিরে কাক-এর বক্তৃতার শিরোনাম ছিল ‘কম্পিউটেশন, ইন্ডিয়ান সায়েন্টিফিক ট্র্যাডিশন অ্যান্ড আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স’। স্বাভাবিক ভাবেই ওঁর আলোচনায় এল কনসাশনেস বা চেতনা। এবং সেই সূত্রে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স বা কৃত্রিম বুদ্ধি। চেতনা গবেষণা এখন, যাকে বলা যায়, হট টপিক। ইজ়রায়েলের স্নায়ু গবেষক হেনরি মারক্রাম ২০১৩ সালে ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে ১৩০ কোটি ডলার আদায় করেছিলেন এই বলে যে, তিনি যন্ত্রে আস্ত একখানি মানব মস্তিষ্ক তৈরি করবেন। ছ’বছর হয়ে গেল, এখনও সে মেশিনের নামগন্ধ নেই। আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স দিয়ে এখন অনেক মানুষের পক্ষে ক্লান্তিকর কিংবা কঠিন কাজ করা হচ্ছে। এ সব দেখে অনেকে ভাবতে শুরু করেছেন মানুষের করার মতো কাজ আর কিছুই বাকি থাকবে না। কাক মন্তব্য করলেন, ‘‘আমি অবশ্য তেমন মনে করি না। যন্ত্র কোনওদিনই চেতনা সম্পন্ন হবে না। চেতনাকে অনেক বিজ্ঞানী ভৌত- রাসায়নিক বিক্রিয়া হিসেবে দেখাতে চেষ্টা করছেন। কেউ কেউ আবার পদার্থবিদ্যার বিশেষ শাখা কোয়ান্টাম মেকানিক্সকেও এর মধ্যে টেনে আনছেন। যেমন ব্রিটিশ পদার্থ বিজ্ঞানী রজার পেনরোজ এবং অ্যারিজোনা স্টেট ইউনিভার্সিটির স্টুয়ার্ট হ্যামেরফ। আমি মনে করি, ওঁরা সম্পূর্ণ ভুল পথে চলেছেন।’’

কম্পিউটার বা যন্ত্র যে কোনওদিনই ‘মানুষ’ হবে না, সেই দাবি সমর্থনে কাক বেদান্ত দর্শনে মন কি বস্তু, সে প্রসঙ্গে চলে গেলেন। বললেন, কোয়ান্টাম মেকানিক্সের পুরোধা পুরুষ নিলস বোর, ভার্নার হাইজ়েনবার্গ এবং আরউইন শ্রয়ডিঙ্গারও বিশ্বাস করতেন যে বেদান্ত দর্শন এ সম্পর্কে যা বলেছে, তা ঠিক। কী বলেছে বেদান্ত দর্শন? বলেছে, চেতনা একক এবং স্বয়ংসম্পূর্ণ। তাকে আর কোনও কিছু দিয়ে ব্যাখা করা যায় না। চেতনা কি গাণিতিক? ধাপে ধাপে এগোয়? এ প্রশ্নের উত্তরে কাক টানলেন

ভারতীয় গণিতজ্ঞ শ্রীনিবাস রামানুজনের দাবি। কেমব্রিজে একদা রামানুজনের মেন্টর গডফ্রে হ্যারল্ড হার্ডি যখন ওঁকে জিজ্ঞাসা করতেন, ওঁর আবিষ্কৃত ফর্মুলাগুলো উনি কোথা থেকে পেতেন, উত্তরে রামানুজন জানাতেন, ‘স্বপ্নে তাঁকে ইষ্টদেবতা দিয়েছেন।’ কাক-এর দাবি, অভিনব আবিষ্কারের কোনও গতিপথ হয় না। তা আপনাআপনিই এসে যায় (উল্লেখ্য, ‘কারেন্ট সায়েন্স’ জার্নালে প্রকাশিত এবম্বিধ দাবিটি সমালোচিত হয়েছে)।

সত্যজিৎ রায়ের ‘আগন্তুক’ ছবিতে এক রহস্যের কথা বলা আছে। পৃথিবী থেকে দেখলে সূর্য এবং চাঁদ দুই-ই সমান আকারের। এ কারণেই পূর্ণ গ্রাস গ্রহণ হয়। ফিল্মের নাম না করেই কাক আলোচনা করলেন রহস্যটি। বললেন, পৃথিবী থেকে দেখলে সূর্য এবং চাঁদের ব্যাস একটা মাপের ১০৮ গুণ। এই তথ্য প্রাচীন ভারতীয়দের অজানা ছিল না। কাক-এর দাবি, ওই তথ্য থেকেই এসেছে ভারতীয় দেবদেবীদের অষ্টোত্তর শতনাম, ভারতীয় নৃত্যের ১০৮ মুদ্রা এবং যপমালায় ১০৮টি পুঁতি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Subhash Kak Vedanta Philosophy
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE