Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪
Science

‘বাঁচার রসদ’ খুঁজতে গিয়ে আজ থেকে ‘ঘাতকে’র সন্ধানে নামছে নাসা

পাঠানো হয়েছে তাকে ‘বাঁচার রসদ’ জোগাড় করতে! কিন্তু ২০১৭-য় পা দিতেই বিজ্ঞানীদের যা ‘ত্রাহি ত্রাহি’ অবস্থা, তাতে তার ঘাড়ে দায়িত্ব চাপিয়ে দিতেই হয়েছে খুব তড়িঘড়ি ‘ঘাতক’ খুঁজে বের করার! কে আমাদের নৃশংসতম ‘আততায়ী’, তাকে খুঁজে বের করার দশ দিনের কাজটা শুরু হয়ে যাবে আজ, রবিবার ৫ ফেব্রুয়ারি থেকেই।‘আগে তো প্রাণে বাঁচি! তার পর তো আরও ভাল ভাবে থাকার কথা ভাবা যাবে!’ সব ছেড়েছুড়ে দিয়ে আপাতত সেই মন্ত্রই জপছে নাসা।

সুজয় চক্রবর্তী
শেষ আপডেট: ০৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৭ ১০:০০
Share: Save:

পাঠানো হয়েছে তাকে ‘বাঁচার রসদ’ জোগাড় করতে!

কিন্তু ২০১৭-য় পা দিতেই বিজ্ঞানীদের যা ‘ত্রাহি ত্রাহি’ অবস্থা, তাতে তার ঘাড়ে দায়িত্ব চাপিয়ে দিতেই হয়েছে খুব তড়িঘড়ি ‘ঘাতক’ খুঁজে বের করার! কে আমাদের নৃশংসতম ‘আততায়ী’, তাকে খুঁজে বের করার দশ দিনের কাজটা শুরু হয়ে যাবে আজ, রবিবার ৫ ফেব্রুয়ারি থেকেই।

‘আগে তো প্রাণে বাঁচি! তার পর তো আরও ভাল ভাবে থাকার কথা ভাবা যাবে!’ সব ছেড়েছুড়ে দিয়ে আপাতত সেই মন্ত্রই জপছে নাসা।


যেখানে ‘ট্রোজান’দের খুঁজবে ‘ওসিরিস-রেক্স’

এই সেই নাসার মহাকাশযান- ‘ওসিরিস-রেক্স’

আরও পড়ুন- মহাকাশে একটা ফুটবল গড়াল ৫১৬ কিলোমিটার! দেখুন ভিডিও

বাঁচার রসদ জোগাড় করতে তাকে পাঠানো হয়েছে মাস পাঁচেক আগে, সেপ্টেম্বরে। মহাকাশে। টার্গেট তার ‘বেন্নু’। মঙ্গল আর বৃহস্পতির মাঝামাঝি জায়গায় থাকা গ্রহাণুপুঞ্জ বা অ্যাস্টারয়েড বেল্টের অন্যতম সদস্য ‘বেন্নু’কে আমাদের খুব প্রয়োজন। ‘খনিজের ভাণ্ডার’ গ্রহাণু- ‘বেন্নু’তে তার পৌঁছনোর কথা আর বছরদেড়েকের মধ্যেই, ২০১৮-র শেষাশেষি। এক দিন পৃথিবীর খনিজের ভাণ্ডার ফুরিয়ে গেলে যাতে ওই ‘বেন্নু’র কাছ থেকে আমরা ধার করে আনতে পারি আরও আরও নতুন ও পরিচিত খনিজ পদার্থ, সেই লক্ষ্যেই চিচিং ফাঁক মন্ত্রে ‘রত্নভাণ্ডারের গোপন কুঠুরি’র দরজা খুলতে ‘বেন্নু’র উদ্দেশে পাঠানো হয়েছে মহাকাশযান ‘ওসিরিস-রেক্স’। ১.৬ থেকে ০.৮ অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল ইউনিট (এইউ) দূরত্বে থেকে (পৃথিবী থেকে সূর্যের দূরত্বকে বলা হয় এক অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল ইউনিট) সূর্যকে পাক মারে ওই গ্রহাণু ‘বেন্নু’।

ওসিরিক্স-রেক্সের অভিযান: দেখুন ভিডিও


ওসিরিক্স-রেক্সের অভিযান: দেখুন ভিডিও

কিন্তু হঠাৎ করেই ২০১৭-য় পা দেওয়ার পর নাসা বুঝতে পেরেছে, তাদের এত দিনের হিসেবে বেশ বড় রকমের গণ্ডগোল হয়ে গিয়েছে। ওলটপালট হয়ে গিয়েছে নাসা ও ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সির (ইএসএ বা ‘এসা’) যাবতীয় হিসেবনিকেশ।

কেন নাসার এই বিলম্বে বোধোদয়?

আমেরিকার জন্স হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রহাণু বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক চন্দ্র ভাস্কর রেড্ডি আনন্দবাজারের পাঠানো প্রশ্নের জবাবে ই-মেলে লিখেছেন, ‘‘গ্রহাণুপুঞ্জের বাইরেও গ্রহাণু রয়েছে, যেমন রয়েছে এই সৌরমণ্ডলের বৃহত্তম গ্রহ বৃহস্পতির সুদূর কোনও কক্ষপথে। তেমনই হয়তো পৃথিবীর কোনও কোনও কক্ষপথের কোথাও কোথাও (যার নাম- ‘ল্যাগর‌্যাঞ্জে পয়েন্টস’) লুকিয়ে রয়েছে প্রচুর ছোট-বড় ‘ট্রোজান হানাদার’। ট্রোজান ঘোড়ার মতোই! যাদের ‘ডেরা’ আমরা এখনও খুঁজে বের করতে পারিনি। কিন্তু সেই ‘ডেরা’ থেকে আচমকা, হঠাৎ হঠাৎ বেরিয়ে এসে কোনও এক ‘ট্রোজান হানাদার’- সুবিশাল কোনও গ্রহাণু আমাদের ওপর আছড়ে পড়তে পারে, আমাদের ফুঁড়ে দিতে পারে চরম আক্রোশে। আর তাতে কার্যত ধ্বংস হয়ে যেতে পারে আমাদের এই বাসযোগ্য গ্রহের সুবিস্তীর্ণ কোনও এলাকা, এমনকী, কোনও মহাদেশও! গ্রহাণুপুঞ্জ থেকে আমাদের দিকে ধেয়ে আসা গ্রহাণুদের সম্পর্কে আমাদের মোটামুটি একটা ধারণা রয়েছে। তাদের নাম-ধাম আমরা কম-বেশি জানি। তাদের কক্ষপথ-টথ আমরা মোটামুটি চিনি। সেই নিরিখে কবে, কোনটা পৃথিবীর খুব কাছে আসছে বা এসে পড়তে পারে খুব তড়িঘড়ি করে, তার ঠিকুজি-কোষ্ঠিও আমাদের কাছে খুব একটা অপরিচিত, অজ্ঞাত নয়।’’

গ্রহাণু আছড়ে পড়লে কতটা ভযঙ্কর? দেখুন কম্পিউটার সিম্যুলেশন

‘ট্রোজান হানাদার’দের নিয়ে কেন এত উদ্বিগ্ন নাসা?

আমেরিকার কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্যোতির্বিজ্ঞানের অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর ধ্রুবজ্যোতি মুখোপাধ্যায় বলছেন, ‘‘মহাকাশে এদের বাসস্থান আমরা জানি না, চিনি না বলে। আমরা এত দিন জানতাম, বৃহস্পতির একেবারে বাইরের দিকের কক্ষপথের ধারে-কাছে এমন বেশ কয়েকটি ছোট-বড় চেহারার গ্রহাণু রয়েছে। তারা অতীতে বেশ কয়েক বার আছড়ে পড়েছে বৃহস্পতির বুকে, ‘গুরু গ্রহে’র অসম্ভব জোরালো অভিকর্ষের টানে। লন্ডভন্ড করে দিয়েছে বৃহস্পতির অন্তরে-অন্দরে। নাসার ‘ওয়াইজ’ মহাকাশযান হালে অবশ্য ইঙ্গিত দিয়েছিল, পৃথিবীরও এমন ‘ট্রোজান গ্রহাণু’ রয়েছে প্রচুর। আর তারা রয়েছে সম্ভবত পৃথিবী আর সূর্যের মাঝখানে থাকা পৃথিবীরই সুদূরতম কক্ষপথ ‘ল্যাগরাঞ্জে পয়েন্টস’-এ।’’


ধেয়ে আসছে গ্রহাণু (শিল্পীর কল্পনায়)

কাকে বলে ‘ল্যাগরাঞ্জে পয়েন্টস’?

অধ্যাপক চন্দ্র ভাস্কর রেড্ডি তাঁর ই-মেল জবাবে লিখেছেন, ‘‘সুর্যের চার পাশ দিয়ে ঘোরে পৃথিবী, অন্য গ্রহগুলির মতোই। সূর্যের জোরালো অভিকর্ষ বল বা ক্ষেত্র (গ্র্যাভিটেশনাল ফিল্ড) রয়েছে। রয়েছে পৃথিবীরও। মহাকাশে কয়েকটা এলাকা বা জায়গায় (মহাকাশের আকার-আয়তনের বিচারে তা ‘বিন্দু’!) সূর্য আর পৃথিবীর অভিকর্ষ ক্ষেত্রগুলি একে অন্যকে কার্যত, শূন্য বা ‘ক্ষমতাহীন’ (ব্যালান্স) করে দেয়। যেখানে সূর্য বা পৃথিবী, কারও অভিকর্ষ ক্ষেত্রেরই কোনও জারিজুরি খাটে না। অনেকটা সীমান্তের লাগোয়া ‘ফ্রি-ম্যান্‌স জোন’-এর মতো। বা, ‘কাশ্মীরের নিয়ন্ত্রণরেখা’র মতো। দু’দেশেরই নজর আছে। আবার, সরকারি ভাবে তেমন নেইও! নেই কারও দখলদারি বা কর্তৃত্বের প্রশ্নও। ওই ‘বিন্দু’গুলিকেই বলা হয়- ‘ল্যাগরাঞ্জে পয়েন্টস’।’’

২০১৭-য় সম্ভাব্য গ্রহাণু-হানাদারি: ভিডিও

‘ল্যাগরাঞ্জে পয়েন্টস’ রয়েছে বহু। কোনগুলি টার্গেট ‘ওসিরিস-রেক্স’-এর?

কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্যোতির্বিজ্ঞানের অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর ধ্রুবজ্যোতি মুখোপাধ্যায় বলছেন, ‘‘এল-৪’ আর ‘এল-৫’, এই দু’টি ‘ল্যাগরাঞ্জে পয়েন্ট’ই আপাতত টার্গেটে রয়েছে গ্রহাণু ‘বেন্নু’কে লক্ষ্য করে ছুটে চলা নাসার মহাকাশযান ‘ওসিরিস-রেক্স’-এর। ওই দু’টি ‘ল্যাগরাঞ্জে পয়েন্ট’ অনেক অনেক বেশি স্থায়ী অন্যগুলির চেয়ে। তাই সেই মুলুকে ওই সব অচেনা, অজানা ‘ট্রোজান গ্রহাণু’ বা গুপ্ত ‘ঘাতক’রা বেশ নিরাপদেই, অনায়াসে থাকতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। সূর্যের চার পাশ দিয়ে যে উপবৃত্তাকার (এলিপটিক্যাল) কক্ষপথে ঘোরে পৃথিবী, ওই দু’টি ‘ল্যাগরাঞ্জে পয়েন্ট’ যথাক্রমে আমাদের সেই গ্রহের ৬০ ডিগ্রি সামনে ও পিছনে রয়েছে। মনে হচ্ছে, এই সৌরমণ্ডলের জন্মের পর প্রায় ৪৫০/৫০০ কোটি বছর আগে যখন পৃথিবী, শুক্র, বুধ, মঙ্গলের মতো গ্রহগুলি তৈরি হচ্ছিল, তখনই এই ‘ট্রোজান গ্রহাণু’গুলির জন্ম হয়েছিল। যে ঘন গ্যাসের মেঘ থেকে পৃথিবী তৈরি হয়েছিল, তারই পড়ে থাকা অংশ থেকে জন্ম নিয়েছিল ওই ‘ট্রোজান গ্রহাণু’গুলি। যেগুলি আটকে পড়েছিল ওই ‘ল্যাগরাঞ্জে পয়েন্টসে’।’’

আরও পড়ুন- বয়স সত্যিই কমে! এঁর বয়স কমল এই ভাবে?

‘ওসিরিস-রেক্স’-এর জন্য বার্তা রইল, ‘সাবধানে যেও, বাছা’!

ছবি ও ভিডিও সৌজন্য: নাসা ও ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সি

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

NASA Asteroid Osiris-Rex
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE