আর্য ঘোষের বাড়িতে তৈরি হ্যাম রেডিও স্টেশন। —নিজস্ব চিত্র।
রাতঘুমের রেশ কাটার আগেই এক শীত-ভোরে হুড়মুড়িয়ে নড়ে উঠেছিল শহরটা। ২০০১-এর জানুয়ারিতে গুজরাতের ভুজে ভয়াবহ ভূমিকম্পে মাটিতে মিশে গিয়েছিল অসংখ্য বাড়ি। ধসে গিয়েছিল সারা শহরের টেলি-যোগাযোগ ব্যবস্থাও।
১০০ ওয়াটের ট্রান্সমিটার আর ১২ ভোল্টের ব্যাটারির সাহায্যে ভূজে মাত্র পনেরো মিনিটে একটি বেতারকেন্দ্র চালু করে দেন একদল মানুষ। আর সেই মাধ্যমেই গোটা বিশ্ব জেনেছিল বিপর্যয়ের খবর। সে দিন যাঁরা এ ভাবে যোগাযোগের নতুন মাত্রা তৈরি করেছিলেন, তাঁরা শখের রেডিও অপারেটর। দুনিয়া জুড়ে যাঁদের পরিচিতি ‘রেডিও হ্যাম’ নামে।
ফোন, ই-মেল, সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটের দাপটে এখনও বেশ পিছিয়েই এই মাধ্যম। প্রচারে, ব্যাপ্তিতে। কিন্তু উপযোগিতায় নয়। বরং আপৎকালীন অবস্থায় যখন সব যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়, তখন বন্ধু হয় এই ব্রাত্য মাধ্যম— ‘হ্যাম রেডিও অপারেটিং সিস্টেম’। ভয়েসকল ও লিখিত বার্তা তো আগেই পাঠানো যেত হ্যাম রেডিওর মাধ্যমে। বলা হচ্ছে, এ বার সংরক্ষণও করা যাবে সেই বার্তা। সৌজন্যে, ইসরোর কৃত্রিম উপগ্রহ ‘স্বয়ম’। পুণের এঞ্জিনিয়ারিং কলেজের গবেষকদল তৈরি করেছেন উপগ্রহটি।
আমেরিকান রেডিও রিলে লিগের অন্যতম সদস্য, এবং শহরের অন্যতম হ্যাম অপারেটর আর্য ঘোষ জানান, সম্প্রতি যে ২০টি কৃত্রিম উপগ্রহ মহাকাশে পাঠিয়েছে ইসরো, তারই একটি ‘স্বয়ম’। বিশেষ করে হ্যাম রেডিও যোগাযোগ ব্যবস্থাকে উন্নত করতেই পাঠানো হয়েছে স্বয়মকে, যা বিশ্বের হ্যাম-ইতিহাসে এই প্রথম।
কী ভাবে কাজ করে হ্যাম রেডিও? ‘স্বয়ম’-ই বা কী ভাবে সাহায্য করবে সেই কাজে?
একটি বেতারযন্ত্রের মাধ্যমে অন্য বেতারযন্ত্রে কথা বলা বা তথ্য নেওয়া-দেওয়াই হ্যাম রেডিও অপারেটরদের কাজ। বার্তা বিনিময় হয় ত়ড়িৎ চুম্বকীয় তরঙ্গের মাধ্যমে। এই অপারেটররা পাহাড়চুড়ো হোক, বা নিজের বাড়িতে বসে হোক, চাইলে মহাকাশযানের নভোচারীদের সঙ্গেও যোগাযোগ করতে পারেন। কারণ, নভোচারীদের সবাই হ্যাম অপারেটর।
বেতার স্টেশন তৈরির জন্য চাই একটি ওয়্যারলেস সেট (ওয়াকিটকিও হতে পারে), কিছুটা তার, একটি অ্যান্টেনা এবং বিদ্যুৎ সংযোগ (ডিসি পাওয়ার সাপ্লাই যন্ত্র)। এই দিয়েই তৈরি করে ফেলা যায় এই যোগাযোগ ব্যবস্থা। নেটওয়ার্কের প্রয়োজন নেই। প্রয়োজন নেই ইন্টারনেট সংযোগের। তাই দায় নেই বিল চোকানোরও।
এত দিন যে হ্যাম-ব্যবস্থা ছিল, তাতে বার্তা পাঠানোর সময় গ্রাহকের যন্ত্র চালু না থাকলে সেই বার্তা পরে তাঁর কাছে পৌঁছনোর উপায় ছিল না। এ বার সেটাই সম্ভব হবে ‘স্বয়ম’-এর মাধ্যমে। তড়িৎ চুম্বকীয় তরঙ্গের মাধ্যমে প্রবাহিত বার্তাকে জমিয়ে রাখবে স্বয়ম। পরে তা অবিকৃত অবস্থায় পৌঁছে যাবে গ্রাহকের কাছে।
এমন উপগ্রহ বানানো হল কেন?
পুণে থেকে গবেষক দলের তরফে আব্দুল হোসেন সঙ্গেরওয়ালা বললেন, ‘‘নতুন কিছু করতে হবে, এটাই প্রথম মাথায় ছিল। আলোচনায় ঠিক হয়, হ্যাম রেডিও যোগাযোগ ব্যবস্থাকে নতুন মাত্রা দেওয়া যেতে পারে এই ভাবে।’’ তথ্য বলছে, আমাদের দেশে এই মুহূর্তে শখের হ্যাম অপারেটর আছেন প্রায় তিরিশ হাজার জন। অমিতাভ বচ্চন, প্রিয়ঙ্কা গাঁধী, সনিয়া গাঁধী, কমল হাসন রয়েছেন তালিকায়। রাজীব গাঁধী অন্যতম হ্যাম অপারেটর ছিলেন। এ দেশে হ্যাম পরিষেবাকে জনপ্রিয় ও কার্যকরী করতে বিশেষ উৎসাহী ছিলেন তিনি।
তবে নেশা বা শখের বাইরে এই ব্যবস্থাকে যে জরুরি পরিষেবায় লাগানো যায়, তা নিয়ে আশাবাদী আর্য। জানালেন, পেশায় তিনি তথ্যপ্রযুক্তি কর্মী। কিন্তু ১৯৯৯ সালে ওড়িশায় সুপার সাইক্লোনের সময় স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে এগিয়ে ছিলেন হ্যাম পরিষেবা নিয়ে। একটি নিখোঁজ জাহাজের খোঁজ মিলেছিল তাঁর চেষ্টায়। ২০০৯-এ আয়লা ঝড়ে বিধ্বস্ত বঙ্গোপসাগর উপকূলীয় অঞ্চলে বহু দুর্গত মানুষও উদ্ধার হয়েছিলেন এই পরিষেবাকে কাজে লাগিয়ে।
কিন্তু এই বিপদকালীন হ্যাম পরিষেবাকে স্বেচ্ছাশ্রম হিসেবেই কাজে লাগানো উচিত বলে জানালেন আর্য। কারণ হ্যাম রেডিও ব্যবহারের জন্য কেন্দ্রীয় যোগাযোগ মন্ত্রকের যে ছাড়পত্র লাগে, তাতেই উল্লেখ রয়েছে যে বাণিজ্যিক স্বার্থে এই পরিষেবা ব্যবহার করা বেআইনি এবং দণ্ডনীয় অপরাধ। তবে হ্যাম রেডিও কোর্সকে সরকারি ভাবে দুর্যোগ মোকাবিলা ব্যবস্থার অন্তর্গত করা গেলে তা অনেক ভাল কাজে লাগাতে পারে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy