Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

দূরবিনে ব্ল্যাক হোলের ফোটো, গল্প হল সত্যি

ব্ল্যাক হোলটির ওজন সূর্যের ৬০০ কোটি গুণ, দূরত্ব পৃথিবী থেকে ৫ কোটি ৩০ লক্ষ আলোকবর্ষ। ‘এম৮৭’ গ্যালাক্সির কেন্দ্রে ওই ব্ল্যাক হোলের ছবি তুলেছে ইভেন্ট হরাইজ়ন টেলিস্কোপ (ইএইচটি), আসলে যা পৃথিবীর আটটি প্রত্যন্ত জায়গায় বেতার দূরবীন।

এই প্রথম ইভেন্ট হরাইজ়ন টেলিস্কোপে ধরা পড়ল ব্ল্যাক হোলের ছবি। (ইনসেটে) বিজ্ঞানী দলের নেতা শেপার্ড ডোয়েলম্যান।

এই প্রথম ইভেন্ট হরাইজ়ন টেলিস্কোপে ধরা পড়ল ব্ল্যাক হোলের ছবি। (ইনসেটে) বিজ্ঞানী দলের নেতা শেপার্ড ডোয়েলম্যান।

পথিক গুহ
শেষ আপডেট: ১১ এপ্রিল ২০১৯ ০১:৫৫
Share: Save:

জ্যোতির্বিজ্ঞানে এক রেড লেটার ডে। বুধবার বিজ্ঞানীরা প্রকাশ করলেন মহাশূন্যের দত্যি-দানো ব্ল্যাক হোলের ছবি। এতদিন যা ছিল কল্পনায়, কল্পবিজ্ঞান কাহিনিতে শিল্পীর তুলিতে আঁকা, তার বাস্তব ফোটো। এক অন্ধকার গোলক ঘিরে কমলা রঙের আলোর ছটা।

ব্ল্যাক হোলটির ওজন সূর্যের ৬০০ কোটি গুণ, দূরত্ব পৃথিবী থেকে ৫ কোটি ৩০ লক্ষ আলোকবর্ষ। ‘এম৮৭’ গ্যালাক্সির কেন্দ্রে ওই ব্ল্যাক হোলের ছবি তুলেছে ইভেন্ট হরাইজ়ন টেলিস্কোপ (ইএইচটি), আসলে যা পৃথিবীর আটটি প্রত্যন্ত জায়গায় বেতার দূরবীন।

ব্ল্যাক হোলের ছবি দেখিয়ে ইএইচটি-র প্রধান বিজ্ঞানী হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক শেপার্ড ডোয়েলম্যান ওয়াশিংটনে এক সাংবাদিক সম্মেলনে বললেন, ‘‘যাকে দেখা যায় না বলে আমরা এতদিন জেনে এসেছি, তা দেখলাম। একটা ব্ল্যাক হোলের ছবি দেখলাম এবং তা তুলে ফেললাম। ওঁর পাশে বসে কানাডায় ওয়াটারলু বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক অ্যাভেরি ব্রডেরিক বললেন, ‘‘সায়েন্স ফিকশন হ্যাজ বিকাম সায়েন্স ফ্যাক্ট।’’

ডোয়েলম্যান, ব্রডেরিক এবং আরও ২০০ জ্যোতির্বিজ্ঞানীর (যাঁরা বিশ্বের ষাটটি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত) সংগৃহীত ব্ল্যাক হোলের ছবি এব‌ং সে-সম্পর্কিত লেখা আজ প্রকাশিত হল ‘অ্যাস্ট্রোফিজিকাল জার্নাল লেটারস’-এ। ছবি এবং লেখা প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গেই আন্তর্জাতিক বিজ্ঞানী মহলে শুরু হল কানাঘুষো। কীসের? কীসের আবার, নোবেল প্রাইজের। বলাবলি শুরু হল এই যে, এমন সাফল্য পৃথিবীর সেরা শিরোপা পাচ্ছেই। ঠিক যেমন পেয়েছিল তিন বছর আগের ঘোষিত মহাকর্ষীয় তরঙ্গ আবিষ্কারের খবর। ২০১৫ সালে তরঙ্গ আবিষ্কারের খবর দেওয়া হয়েছিল পরের বছর ফেব্রুয়ারি মাসে। দু’বছরের মাথায় নোবেল প্রাইজের ভূষিত হয়েছিল সেই সাফল্য।

কবে তোলা হল ব্ল্যাক হোলের ফোটো? সাংবাদিক সম্মেলনে বিজ্ঞানীরা জানালেন, ২০১৭ সালের এপ্রিলে তোলা ফোটোর বিচার-বিশ্লেষণ করতে অনেক মাস, তার পরে তা জার্নালে ছাপতে দেওয়া। জার্নালে ছাপানো টাটকা খবর জানাতে আজ সাংবাদিক সম্মেলন।

কী ভাবে তোলা হল ব্ল্যাক হোলের ছবি? নাহ্, ব্ল্যাক হোল জিনিসটার নিজের ছবি তোলা যায় না। রেডিয়ো টেলিস্কোপ শনাক্ত করে মানুষের-চোখে-অদৃশ্য বেতার তরঙ্গ। আর ব্ল্যাক হোলের খিদে এমন আগ্রাসী যে, তা গিলে খায় সব কিছু, রেহাই দেয় না কোনও রকমের তরঙ্গকেও। সে জন্যই তার নামে ‘ব্ল্যাক’। বাংলায় ‘অন্ধকূপ’।

তা হলে ছবি? হ্যা, ব্ল্যাক হোলের চারপাশে যে চৌহদ্দি, যার মধ্যে এক বার গিয়ে পড়লে রেহাই নেই কোনও কিছুরই, তখন কেবলই পতন, সেই চৌহদ্দির নাম ‘ইভেন্ট হরাইজ়ন’। সেই চৌহদ্দির দিকে ধাবমান বস্তুপিণ্ড ঘুরতে থাকে ভীমবেগে। ধাবমান সেই বস্তু থেকে বেরোয় নানা রকমের ছটা। আট দূরবীনের সমষ্টি ইভেন্ট হরাইজ়ন টেলিস্কোপ ছবি তুলেছে সেই ছটার। মাঝখানে? নিকষ কালো অন্ধকার।

আট বছর ধরে চেষ্টা চালিয়ে গিয়েছেন ডোয়েলম্যান এবং তাঁর সহযোগীরা। ঘুরে ঘুরে বেরিয়েছেন আটটি টেলিস্কোপে, যার কোনওটা পাহাড়চুড়োয় অথবা কুমেরু প্রদেশে, সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ২৫ মিটার উঁচু বরফের পাশে। যে তরঙ্গে এসেছে ব্ল্যাক হোলের খবর, সে তরঙ্গ প্রসারে বিঘ্ন ঘটায় জলীয় বাষ্প। তাই খুঁজতে হয়েছে এমন জায়গার দূরবীন, যেখানে জলীয় বাষ্প প্রায় অনুপস্থিত।

প্রযুক্তির ঝক্কিই কি কম? ৫ কোটি ৩০ লক্ষ আলোকবর্ষ দূর থেকে আসছে তরঙ্গ, তা শনাক্ত হবে রেডিয়ো টেলিস্কোপে। কাজটা কেমন কঠিন? সাংবাদিকদের ব্যাখ্যা করে শেপার্ড বললেন, ‘‘খালি চোখে চাঁদের বুকে একটা আপেল শনাক্ত করার মতো।’’ পৃথিবীর আট জায়গায় আট দূরবীন কাজ করবে একসঙ্গে, এক মূহুর্তে। সময়ের একচুল এদিক-ওদিক না-করে। এ জন্য দরকার সূক্ষ্ম ঘড়ির। এমন ঘড়ি, যা লক্ষ লক্ষ বছরে স্লো বা ফাস্ট হবে এক সেকেন্ড। আট দূরবীন যেন আট টুকরো, যারা একসঙ্গে হলে দৈর্ঘ্যে দাঁড়াবে পৃথিবীর পরিধির অর্ধেকটা।

ওয়াশিংনের প্রেস কনফারেন্সে ডোয়েলম্যান এবং তাঁর সহযোগীদের উদ্দেশে প্রশ্ন উড়ে আসছিল ঝাঁকে ঝাঁকে। এক সহযোগী যেই বললেন, ‘‘আরও একবার অভ্রান্ত প্রমাণিত হলেন অ্যালবার্ট আইনস্টাইন’’, অমনি তাঁর দিকে প্রশ্ন ধেয়ে এল, ‘‘আপনাদের বিস্ময় জাগে না একশো বছর আগেও একটা মানুষ কী করে এত সব ভেবেছিলেন!’’ ‘‘অবশ্যই জাগে,’’ বললেন ডোয়েলম্যানের পাশে-বসা হাওয়াইতে ইস্ট এশিয়ান অবজারভেটরির জ্যোতির্বিজ্ঞানী জেসিকা ডেম্পসি।

সত্যিই ব্ল্যাক হোল বড় বিচিত্র। এত অভিনব তাঁর চরিত্র যে এক সময়ে স্বয়ং আইনস্টাইনই পর্যন্ত বিশ্বাস করতে চাইছিলেন না এর অস্থিত্ব। ব্ল্যাক হোল মানে নক্ষত্রের মৃতদেহ। যে কোনও তারায় চলে দুই বিপরীত ক্রিয়া। প্রচণ্ড পরিমাণ পদার্থের নিষ্পেষণে তারা স‌ংকুচিত হতে চায়। ওদিকে আবার হাইড্রোজেন থেকে হিলিয়াম (হাইড্রোজেন বোমায় যা ঘটে) উৎপাদনের আগুনে তারা লুচির মতো ফুলতে চায়। জ্বালানী ফুরোতে আগুনও শেষ। তখন শুধুই নিষ্পেষণ। নক্ষত্রের মরণকাল। এর পর? অন্তিম দশা নির্ভর করে তারার শবদেহের ওজনের উপরে। যদি শবদেহ খুব

ভারী হয়, তবে তা এগোয় ব্ল্যাক হোলের দিকে।

এই খানেই এসে পড়ে ভারতীয় বিজ্ঞানীদের কথা। ব্ল্যাক হোল নাম? তাও তো এসেছে কলকাতার ‘অন্ধকূপ হত্যা’ থেকেই। কোথায় থাকত ব্ল্যাক হোলের আইডিয়া, যদি সত্যেন্দ্রনাথ বসু এবং আইনস্টাইন মিলে না লিখতেন ‘বসু-আইনস্টাইন সংখ্যায়ণ’? কোথায় থাকত ব্ল্যাক হোল, যদি না সুব্রহ্মণ্যম চন্দ্রশেখর বাঘা বাঘা বিজ্ঞানীদের আপত্তি উপেক্ষা করেও দেখিয়ে দিতেন মৃত নক্ষত্র কোন পথে ব্ল্যাক হোল পরিণতির দিকে ধায়?

ডোয়েলম্যানদের সাফল্যকে ‘‘রোমহর্ষক’’ আখ্যা দিলেন পুনেতে ইন্টার-ইউনিভার্সিটি সেন্টার ফর অ্যাস্ট্রোনমি অ্যান্ড অ্যাস্ট্রোফিজিক্স (আইয়ুকা)-র অধিকর্তা সোমক রায়চৌধুরী। ‘‘সংবেদনশীলতার যে মাত্রায় এই সাফল্য অর্জন করা গেল, তা ভেবে আমি বিস্মিত,’’ বললেন সোমক। ব্ল্যাক হোল গবেষণায় ভারতীয় বিজ্ঞানীদের দীর্ঘ ধারার কথা জানিয়ে তিনি বললেন, ‘‘আমরা যেন ভুলে না যাই, ডোয়েলম্যানদের সাফল্য কিন্তু সম্ভব হয়েছে মাইক্রোওয়েভ বা ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র মাপের তরঙ্গ শনাক্ত করে। সে শনাক্তের পুরোধা পুরুষ কে? আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু। জ্যোতির্পদার্থবিজ্ঞানী হিসেবে আমার গর্ব হচ্ছে এই ভেবে যে, পরাধীন ভারতে কলকাতা শহরে বসে এক বিজ্ঞানী যে প্রযুক্তি আবিষ্কার করেছিলেন, তা আজ সন্ধান দিচ্ছে ব্ল্যাক হোলের মতো বিচিত্র মহাজাগতিক বস্তুরও।’’

সোমক যা বললেন না, তা হল: ভারতে একটাও মাইক্রোওয়েভ শনাক্তকারী দূরবীন নেই। থাকলে, পৃথিবীর ষাটটি দেশের মতো ভারতীয় বিজ্ঞানীরাও ব্ল্যাক হোলের ফোটো তোলায় শামিল হতে পারতেন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Event Horizon Telescope m-87 Black Hole
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE