ফাইল চিত্র
আর সিঙ্গল বা ডাব্ল চেম্বার পেসমেকার বসাতে হবে না? করাতে হবে না অ্যাঞ্জিওপ্ল্যাস্টি? প্রয়োজন কি অনেকটাই কমে যাবে সুজটিল কার্ডিও-থোরাসিক সার্জারিরও?
হাজারো গবেষণা করে বিশ্বের ডাকসাইটে ডাক্তার, সার্জেনদের পক্ষে যা সম্ভব হয়নি এত দিন, সেটা যে সত্যি-সত্যিই সম্ভব হতে পারে, তা জানা গেল এক ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র জলজ প্রাণীর দৌলতে। যার নাম- ‘জেব্রাফিশ’। সেই জেব্রাফিশই জানিয়ে দিল, এমনটাও হতে পারে।
আর সেই সম্ভাবনাটা বেশ জোরালো ভাবেই উস্কে দিয়েছে একেবারে হালের একটি সাড়াজাগানো গবেষণার ফলাফল। ওই গবেষণা জানাচ্ছে, আমাদের মতো স্তন্যপায়ীদের হার্ট বা হৃদযন্ত্র হয়তো এক দিন তার নষ্ট হয়ে বা পচন ধরে যাওয়া কোষ, কলাগুলিকে নিজেই ‘বাতিল’ করে দেবে। তাদের জায়গায় বানিয়ে ফেলবে নতুন নতুন তরতাজা কোষ, কলা। যাকে জীববিজ্ঞানের পরিভাষায় বলে, ‘রিজেনারেশন’।
ওই ‘রিজেনারেশন’ পদ্ধতিতে আমাদের মতো স্তন্যপায়ীদের হার্ট এক দিন শরীরের ভেতরেই পুরনো নষ্ট হয়ে বা পচন ধরে যাওয়া কোষ, কলাগুলিকে ‘বাতিল’ করে দিয়ে তাদের জায়গায় নতুন নতুন কোষ, কলাগুলিকে একেবারে স্বাভাবিক নিয়মেই গায়ে-গতরে বাড়িয়ে তুলতে পারবে। একেবারে স্বাভাবিক নিয়মেই সেই কোষ, কলাগুলিকে হার্টে ছড়িয়ে দিতে পারবে। তাদের সুস্থ, সবল রাখার জন্য যা যা করণীয়, সেই সব কিছুই করতে পারবে। নিজেকে বাঁচিয়ে রাখা, সচল, সবল, সুস্থ রাখার জন্য হার্ট যদি প্রয়োজনীয় কাজগুলি আপনাআপনিই করে ফেলতে পারে, তা হলে আর তাকে ঠিকঠাক ভাবে চালিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য বাইরে থেকে পেসমেকার বসাতে হবে কেন? কেনই-বা অ্যাঞ্জিওপ্ল্যাস্টির মতো হার্টে করতে হবে হরেক রকমের সুজটিল অস্ত্রোপচার? কেনই-বা প্রয়োজন হবে কার্ডিও-থোরাসিক সার্জারির?
জেব্রাফিশের হার্টের ‘ইসিএম’ (সবুজ)
গবেষণাপত্রটি একেবারে হালে প্রকাশিত হয়েছে আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান-জার্নাল ‘সায়েন্স অ্যাডভান্সেস’-এ। যার শিরোনাম- ‘ডিসেল্যুলারাইজ্ড জেব্রাফিশ কার্ডিয়াক একস্ট্রা-সেল্যুলার ম্যাট্রিক্স ইনডিউসেস ম্যামালিয়ান হার্ট রিজেনারেশন’। মূল গবেষক পিট্সবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের সোয়ানসন স্কুল অফ ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের বায়ো-ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ‘উইলিয়াম কেপলার হোয়াইটফোর্ড চেয়ার’ প্রফেসর ইয়াদং ওয়াঙ। যে গবেষকদলে রয়েছেন অনাবাসী ভারতীয় বায়ো-ইঞ্জিনিয়ার বাপু হরিশ সালভেও, অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায়।
‘পশ্চাতে রেখেছো যারে, সে তোমারে পশ্চাতে টানিছে’!
আমাদের মতো স্তন্যপায়ীদের অনেক ‘পশ্চাতে’ বা পিছনের সারিতে রয়েছে জেব্রাফিশ। ঘটনা হল, স্তন্যপায়ীদের চেয়ে ‘জীবনের জটিলতা’য় অনেক অনেক পিছিয়ে থাকা এই জেব্রাফিশের মতো আরও অনেক প্রাণীই জীবনের এই মহা-মন্ত্রটা জানে। মানে, ‘রিজেনারেশন’টা করতে পারে, জানে। নষ্ট হয়ে যাওয়া বা পচন ধরে যাওয়া কোষগুলিকে বাতিল করে দিয়ে শরীরের ভেতরে তারা একেবারে প্রাকৃতিক নিয়মে আপনাআপনিই তৈরি করে নিতে পারে নতুন নতুন তরতাজা কোষ, কলা। বানিয়ে নিতে পারে নতুন নতুন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ। এটাই তাদের ‘রিজেনারেশন’ পদ্ধতি। ফলে তাদের শরীরে বাইরে থেকে কোনও সার্জারি, অপারেশনের প্রয়োজন হয় না। তাদের কোনও বিকল বা দুর্বল অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ কেটে বাদ দিতে হয় না। কোনও অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ প্রতিস্থাপনের দরকারও হয় না তাদের। আর এ ব্যাপারে আমরা মানুষ একেবারেই হতভাগ্য! ভাবুন, ঈশ্বর আমাদের এত কিছু দিয়েও কত কিছু, কত বড় একটা জিনিস আমাদের দেননি! শুধু মানুষই নয়, হতভাগ্য গোটা স্তন্যপায়ী কূল! তাদের কারও হাতেই নেই শত্রু-বধের এই অমোঘ অস্ত্র!
নতুন ভাবে তৈরি হওয়া ইঁদুরের হার্ট
কোথায় চমক ভারতীয় সহ অন্য গবেষকদের?
একটা বাড়ি রং করতে গেলে বা তা সারাতে বা তার তলা বা়ড়াতে গেলে রং-এর মিস্ত্রি, রাজমিস্ত্রিরা যেমন বাড়ির দেওয়াল বা তার পাঁচিল ধরে যেমন বাঁশের বা কোনও ধাতব কাঠামো বানিয়ে নেন প্রথমে, যাকে ‘ভারা বাঁধা’ বলা হয়, জেব্রাফিশকে দিয়ে সেই ‘ভারা বাঁধা’র মতো চমকে দেওয়া কাজটাই করে দেখিয়েছেন ইঁদুরের হার্টে। পরে, প্রাথমিক ভাবে মানুষের হার্টেও পরীক্ষা করে দেখেছেন। সফলও হয়েছেন! গবেষণাপত্রে মূল গবেষক অধ্যাপক ইয়াদং ওয়াঙ লিখেছেন, ‘‘এই মূহুর্তে বিশ্বে পুরুষ ও নারীর মৃত্যুর জন্য সবচেয়ে বেশি দায়ী যে হৃদরোগ বা হার্ট ডিজিজ্, তার অনেকটাই অনেক বেশি সহজে, অনেক তাড়াতাড়ি সারিয়ে ফেলার পথ দেখিয়েছে এই গবেষণা।
কোষ, কলার রিজেনারেশনের পথগুলি...
জেব্রাফিশের হার্টের কোষ, কলার রিজেনারেশনের ধাপগুলি
ইঁদুরের হার্টের কোষ, কলার রিজেনারেশনের ধাপগুলি
সহযোগী গবেষক অনাবাসী ভারতীয় পিটস্বার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়ো-ইঞ্জিনিয়ার বাপু হরিশ সালভে ই-মেলে পাঠানো প্রশ্নের জবাবে আনন্দবাজারকে লিখেছেন, ‘‘রং বা বাড়ি-সারাইয়ের সময় আমরা যাকে ‘ভারা বাঁধা’ বলি, বায়ো-ইঞ্জিনিয়ারিং-এর পরিভাষায়, সেটাকেই বলা হয় ‘সেল্যুলার স্ক্যাফোল্ডিং’। আমরা কাজটা করেছি জেব্রাফিশের হার্টের ‘ইসিএম’ বা ‘একস্ট্রা-সেল্যুলার ম্যাট্রিসেস’ নিয়ে। জেব্রাফিশের হার্টের ক্ষয়ে যাওয়া বা পচন ধরে যাওয়া কোষগুলিকে বাতিল করে তার জায়গায় নতুন নতুন তরতাজা কোষ, কলা, অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ আপনাআপনিই বানিয়ে ফেলার জন্য এই ‘ইসিএম’ শুধুই বাড়ির ‘ভারা বাঁধা’র কাজটাই করে না, আরও অনেক কিছু করে। ওই ‘ইসিএমে’র ওপর ভর করে জেব্রাফিশের হার্টের নতুন নতুন কোষ, কলা, অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলি তো গড়ে ও বেড়ে ওঠেই স্বাভাবিক নিয়মে, এমনকী হার্টের অন্যান্য অংশে তাদের ছড়িয়ে পড়তেও সাহায্য করে। এ ছাড়াও তারা সাহায্য করে কোনও নতুন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের জন্ম, বৃদ্ধি, পুনর্জন্মের ক্ষেত্রেও। তাতে দেখেছি, ওই ‘ইসিএম’ যেমন জেব্রাফিশের হার্টে নতুন নতুন কোষ, কলা, অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলিকে গড়ে ও বাড়িয়ে তুলতে পারে, ঠিক একই ভাবে সেটা নতুন নতুন কোষ, কলা, অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ গড়ে ও বাড়িয়ে তুলতে পারে ইঁদুরের হার্টেও। ভয়াবহ হৃদরোগ ‘মায়োকার্ডিয়াল ইনফারকেশন’-এর পরেও ইঁদুরের হার্টে নতুন নতুন কোষ, কলা, অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ গড়ে ও বাড়িয়ে তুলতে পারে জেব্রাফিশের এই ‘ইসিএম’। এমনকী, মানুষের হার্টেও এই ‘ইসিএম’ অনেক বৈপ্লবিক ঘটনা ঘটিয়ে দিতে পারে। আমার অবাক হয়ে দেখেছি, তার পরেও ইঁদুরের হার্ট কতটা স্বাভাবিক আচরণ করেছে। যেন কিছুই হয়নি! আমাদের আরও অবাক করেছে জেব্রাফিশের ‘ইসিএমে’র আচার-আচরণ। দেখেছি, জেব্রাফিশের এই ‘ইসিএম’ মানুষের হার্টের ‘মায়োসাইট্স’গুলিকেও (সেই কোষগুলি যা হার্টের পেশিগুলিকে বানায়। এই পেশিগুলিই তো অত্যন্ত চাপ বা আঘাত থেকে বাঁচায় আমাদের হার্টকে) বাঁচিয়ে দিতে পারে। ক্ষয়ে গেলে বা তাতে পচন ধরে গেলে হার্টেই আপনাআপনি ‘রিজেনারেশন’ পদ্ধতির সুইচটা ‘অন’ করে দিতে পারে জেব্রাফিশের ‘ইসিএম’।’’
ইঁদুরের হার্টের কোষ, কলার রিজেনারেশনের ধাপগুলি
সেই জেব্রাফিশ
প্রাণীজগতে সর্বোৎকৃষ্ট মানুষের সীমাবদ্ধতাটা কোথায়?
কলকাতার বিশিষ্ট হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ, এসএসকেএম হাসপাতালের কার্ডিওলজি বিভাগের অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর অচ্যুত সরকার বলছেন, ‘‘শিশুর জন্মের পর পরই খুব অল্প দিনের মধ্যে মানুষ ‘রিজেনারেশন’-এর ক্ষমতাটা হারিয়ে ফেলে। কিন্তু জেব্রাফিশের মতো নীচের স্তরের প্রাণীদের (মাছ) ক্ষেত্রে হার্টের এই ‘রিজেনারেশন’-এর ক্ষমতাটা থাকে আজীবনই। আর তা জেব্রাফিশের হার্টের অন্তত ৫০ শতাংশ অসুখবিসুখ আপনাআপনিই সারিয়ে তুলতে পারে। আর এই স্বাভাবিক ‘চিকিৎসা পদ্ধতি’ জেব্রাফিশের হার্টকে একেবারে আগের মতোই সুস্থ, সবল করে তুলতে পারে মাত্র সপ্তাহ খানেকের মধ্যে। কোনও কোনও ক্ষেত্রে মাত্র দু’-তিন দিনেই।
রিজেনারেশনের ধাপ (জেব্রাফিশ, ইঁদুর, মানুষ)
কিন্তু হঠাৎ করে একটা ‘বহিরাগত’কে কেনই-বা মেনে নেবে আমাদের হার্ট? স্তন্যপায়ীদের হার্ট?
গবেষণাপত্রে মূল গবেষক পিট্সবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের সোয়ানসন স্কুল অফ ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের বায়ো-ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ‘উইলিয়াম কেপলার হোয়াইটফোর্ড চেয়ার’ প্রফেসর ইয়াদং ওয়াঙ লিখেছেন, ‘‘নীচের স্তরের প্রাণীর দেহ থেকে আসা ‘বহিরাগত’ কোষকে সাধারণত কিছুতেই মেনে নিতে চায় না স্তন্যপায়ীদের কোষ, কলাগুলি। তাদের ‘বিদেশি’ বলে চিনে নিতে দেরিও করে না আমাদের মতো স্তন্যপায়ীদের দেহের স্বাভাবিক কোষ, কলাগুলি। আর সঙ্গে সঙ্গেই তারা ‘বিদেশি’, ‘বহিরাগত’ কোষগুলিকে হটিয়ে দেওয়ার ‘চক্রান্ত’ শুরু করে দেয়। কিন্তু আমারা দেখেছি, জেব্রাফিশের ‘ইসিএম’ শরীরে ঢোকালে কোনও আপত্তি তোলে না স্তন্যপায়ীদের দেহের স্বাভাবিক কোষ, কলাগুলি।’’
হার্টের কোথায় কোথায় কার্যকরী হবে জেব্রাফিশের ‘ইসিএম’
কেন ‘বহিরাগত’ জেব্রাফিশের ‘ইসিএম’কে স্বাগত জানাতে দ্বিধা করে না আমাদের মতো স্তন্যপায়ীদের দেহের স্বাভাবিক কোষ, কলাগুলি?
সহযোগী গবেষক অনাবাসী ভারতীয় বায়ো-ইঞ্জিনিয়ার বাপু হরিশ সালভে তাঁর ই-মেল জবাবে লিখেছেন, ‘‘জেব্রাফিশের ‘ইসিএম’টাও গড়ে ওঠে কোলাজেন, ইলাস্টিন আর কার্বোহাইড্রেট দিয়ে। আর তার বাইরের স্তরেও এমন কিছু সংকেত থাকে না, যা দিয়ে স্তন্যপায়ীদের কোষ, কলাগুলি বুঝতে পারে, এটা ‘বহিরাগত’! সেখানেই কেল্লা ফতে!’’
ছবি সৌজন্য: পিট্সবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়
আরও পড়ুন- কৃত্রিম ধমনীও বানিয়ে ফেললেন বিজ্ঞানীরা, বাড়বে শরীরের সঙ্গেই!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy