দুই মহারথী
বাংলার আর এক গায়ক রাঘব চট্টোপাধ্যায় কী বলছেন শুনে নেওয়া যাক। “কিশোরকুমার শুধু গায়ক নন। তিনি নায়ক-গায়ক-সুরকার সব। তাঁর বহুমুখী এবং বিস্ময়কর প্রতিভা। কিন্তু মহম্মদ রফি আউট অ্যান্ড আউট একজন গায়ক। রাগাশ্রয়ী গানে তিনি অনবদ্য। তাঁকে আমি গায়কের গায়ক বলব। কিশোরের গান জেনারেল। রফি তালিম নেওয়া একজন গায়ক। ফলে তাঁর গাওয়া গানের জন্য যে সুর, তাল, ছন্দের দরকার হয়, সেটা রীতিমতো চর্চা না করলে গাওয়া সম্ভব নয়, ” মন্তব্য রাঘবের।
মুম্বইবাসী আর এক বাঙালি গায়ক, অভিজিৎ কী বলছেন? ছোটবেলায় তিনি ভাবতেন রেডিয়ো মধ্যে রফিসাব বসে আছেন। আর ওখান থেকেই গান গাইছেন। “তখনও কিশোরদার গান শুনিনি। রফিসাবের গান না শুনলে আমি কিশোরদার ফটোকপি হতাম। কিশোরদার ‘স্যাডনেস’ আর রফিসাবের ‘সফটনেস’, কিশোরদার ঘরানা, রফিসাবের টাচ— সব মিলিয়েই আমি গাইতে চেষ্টা করি। আমার উপরে রফিসাবের ইনফ্লুয়েন্স আছে। আজকেও যত বার ভাল গান শুনি, তত বারই মনে হয়, মিউজিক মানেই রেডিও, মিউজিক মানেই মহম্মদ রফি।”
৩১ জুলাই সকাল থেকে টেলিভিশনের নানা চ্যানেলে এখনও বাজে রফির গান। তাঁর সেই রাজকীয়, অনন্য কণ্ঠস্বরের অবিরাম মণিমুক্তো বর্ষণেও চাপা থাকে না কত শ্রোতার হৃদয় ফুঁড়ে উঠে-আসা মাত্র ৫৪ বছর বয়েসে অকালে তাঁকে হারানোর বেদনার হাহাকার।
মিউজিক হোক কিংবা নিউজ চ্যানেল— তাঁর প্রয়াণদিবসে সকাল থেকে মধ্য রাত পর্যন্ত মহম্মদ রফির জাদুকণ্ঠের স্বর্ণালি গানের সম্ভার একটিই কি বার্তা বয়ে আনে না তাঁর শ্রোতাদের কাছে? চলে যাওয়ার ৩৫ বছরেও একদা বলিউডের ভরসা মহম্মদ রফি কী ভাবে ডটকম শাসিত এই একুশ শতকেও জীবন্ত থাকেন তাঁর শ্রোতাদের মননে, স্মৃতিতে, ফেলে আসা দিনে?মস্তি চ্যানেলের ‘গোল্ডেন এরা উইথ অন্নু কপূর’-এর অনুষ্ঠান হোক কিংবা ‘লভ কাল আজ ঔর কাল’ অনুষ্ঠান। অথবা মিউজিক ইন্ডিয়া বা সোনি মিক্সের মতো চ্যানেলে ঘুরে ফিরে প্রতিদিনই নিয়ম করে নানা সিনেমার দৃশ্যে শোনানো হয় রফির গান।
আজও যে-কোনও রিয়্যালিটি শো-এ তাঁর গান ঘুরেফিরে উঠে আসে ।
প্রতিযোগীদের কণ্ঠে। জি টিভি-র ‘সা-রে-গা-মা-পা’র মহামঞ্চে এই সে-দিন বাংলার অনীক ধরকে জড়িয়ে ধরেছিলেন সুরকার হিমেশ রেশমিয়া। দর্শকাসনে তখনও চলছে হাততালির ঝড়। সবে অনীক শেষ করেছেন ‘কেয়া হুয়া তেরা বাদা’ গানটি। “মেরা ভি ফেভারিট গানা হ্যায় ইয়ে”, দর্শকদের দিকে তাকিয়ে এই মন্তব্য করার সময় হিমেশের মুখেচোখে কেবলই মুগ্ধতা। এই গানটির জন্যই ১৯৭৭-এ জাতীয় পুরস্কার পেয়েছিলেন মহম্মদ রফি। সঙ্গে আরও একটি সর্বভারতীয় শিরোপা।
কত বড় গায়ক ছিলেন মহম্মদ রফি?
স্টুডিওয় তৈরি করা সিমলা শহর। রাতবিরেতে যৌবনের দূত সুদর্শন দেব আনন্দ খুঁজে বেড়াচ্ছেন তাঁর প্রেমিকার বাড়ি। দেবের ঠোঁটে গান। ‘তু কহাঁ ইয়ে বাতা, ইস নসিলি রাত মে’।
নেপথ্য গায়কের সুরেলা এবং দরদী কণ্ঠের মর্মস্পর্শী আকুলতায় পর্দা জুড়ে উপচে পড়ছে নায়কের বিরহ। গানের প্রতিটি শব্দের সঙ্গে সঙ্গে।
“‘তেরে ঘর কে সামনে’ ছবির দৃশ্যটি মনে আছে তো? সুুপারহিট ছবির সুপারহিট সব গান! বিশেষ করে ভৈরবী রাগে ‘শুনলে তু দিল কে সদা’। বার বার শুনলেও যেন মন ভরে না। যেমন যোগ্য গায়ক, তেমনই যোগ্য সুরকার।” মত ছিল সঙ্গীত-বিশেষজ্ঞ রাজু ভারতনের।
অথচ হিন্দি সিনেমায় সেরা গায়কের বিতর্কে রফি বনাম কিশোরকুমারকে নিয়ে চায়ের কাপে তুফান তুলে দেবে বাঙালি। রফির তুলনায় কিশোরের কণ্ঠ অনেক গমগমে, অনেক তাজা। ‘ফ্ল্যামবয়ান্ট’ গায়ককে নিয়ে বেশির ভাগ বাঙালি গর্বিত। যদিও তাঁর জন্ম খান্ডোয়ায়, বাংলা লিখতে পড়তে জানতেন না। কিন্তু তিনি তো ভাত-মাছ-রসগোল্লা খাওয়া বাঙালি। হিন্দি সিনেমার গানে তাঁর শ্রেষ্ঠত্ব এবং দক্ষতা নিয়ে কোনও চ্যালেঞ্জের মুখেই পড়তে চায় না এই জাতি। কিশোরকুমারের সঙ্গে তুলনায় রফি? এক কথায় খারিজ হয়ে যাবেন। রফি বাঙালির চোখে বহু যোজন দূরে।
বাবুল সুপ্রিয়র মতে, “বলিউডে এক নম্বর গায়কের নাম কিশোরকুমার। তবে কিশোরকুমার আর রফির মধ্যে তুলনা করতে হলে আমি বলব, সন্দেশ আর রসগোল্লার মধ্যে কি তুলনা হয়? যাঁরা গান করেন, তাঁদের বলব, দু’জনের গান থেকেই আনন্দ নিন।”
সবাই জানেন বলিউডের স্বর্ণযুগে মুকেশ ছিলেন রাজ কপূরের প্রিয় গায়ক। মনোজকুমারের প্রথম পছন্দের গায়কও তিনি। তার পরে মহেন্দ্র কপূর। দেব আনন্দের যেমন কিশোর। কিন্তু ১৯৪৮-৬৮, এই কুড়ি বছরে রফি ছিলেন বাকি নায়কদের সাফল্যের টেক্কা। রাজু ভারতনের মতো হিন্দি সিনেমার গানের বিশেষজ্ঞের মতে, রফি ছিলেন ‘মোস্ট কমপ্লিট সিঙ্গার’। রাগাশ্রয়ী থেকে ভজন, রোম্যান্টিক থেকে গজল, হিপহপ থেকে রক-অ্যান্ড-রোল থেকে কাওয়ালি বা ডিস্কো। এবং আরও অনেক কিছু।
মুম্বই আসার পরে শুরু হয়েছিল তাঁর অগ্নিপরীক্ষা। বান্দ্রার ভেন্ডি বাজার থেকে রোজ সকালে হেঁটে চলে আসতেন দাদারে। তার পরে এক দিন কারদার স্টুডিয়োয় প্রবাদপ্রতিম সুরকার নৌশাদের দেখা পেলেন।
লম্বা রেসের ঘোড়াটিকে চিনতে ভুল হয়নি কিংবদন্তি সুরকারের। ‘পহলে আপ’ ছবিতে ‘হিন্দুস্তান কে হম হ্যায়’ গান দিয়ে তাঁর কদম কদম চলা শুরু হয়েছিল স্বপ্ননগরীতে। ‘আনমোল ঘড়ি’ ছবিতে রফির গাওয়া ‘তেরা খিলোনা টুটা বালক’ তাঁকে জায়গা করে দিয়েছিল বলিউডে।