সুনীলদার যুক্তি ছিল, শেক্সপিয়রের পঙ্ক্তির যুক্তি মেনে নিয়েই জীবনের বাজে অভিজ্ঞতাগুলো বাদ দিয়ে মনে রাখার মতো কথাগুলো লিখতে চেয়েছেন। কিন্তু যেটা ওঁর বলার অপেক্ষায় ছিল না, তা হল ওঁর বিপুল সংখ্যক উপন্যাস ও অধিকাংশ কবিতা এবং অজস্র রম্যরচনায় উনি ওঁর জীবনটাই ধরে রেখেছেন। ‘অর্ধেক জীবন’ ওঁর জীবনের কতটা বলতে পেরেছে জানি না, তবে উপন্যাস-গল্পে নিজের জীবনের কথা চেলে চেলে আত্মজীবনীর এক বিকল্প উনি অনেক আগেই রচনা করে ফেলেছিলেন। কিন্তু সেখানেও কি জীবনের সব ‘রট্ন’ (শেক্সপিয়রের ভাষায়) বা ‘বাজে’ (সুনীলদার ভাষায়) বৃত্তান্ত ছুঁয়ে যেতে পেরেছেন?
সুনীলদা লেখক শ্রীপান্থর কাছে কবুল করেছিলেন, না পারেননি। বলেছিলেন, এত প্রেমের দৃশ্য এঁকেছি, কিন্তু শরীরের সম্পর্ক দেখাতে গেলে কলম আটকে যায়। কেন? না, নিজের শরীরটাই কীরকম অস্থির হয়ে ওঠে। ওটা সাহেবরাই পারে।
এ প্রসঙ্গে একবার বলেছিলেন, “ভাবি, যেটা আড়ালের দিক সেটা আড়ালে রাখাটাই তো ভাল।”
খুবই প্রিয় ছিল বার্ট্রান্ড রাসেলের ‘অটোবায়োগ্রফি’, কিন্তু স্বীকার করতেন, জীবনের সব ভাললাগা, মন্দলাগা, জয়-পরাজয়, প্রেম-ঘৃণা, উচ্চতা-নীচতা, দোষগুণ, মহত্ত্ব-ক্ষুদ্রতা, ওভাবে বলা অসম্ভব কঠিন, প্রায় অসম্ভব। তাছাড়া বললেন একদিন, গাড়িতে যেতে যেতে, কখনও কি ভেবেছিলাম নিজের কথা এ ভাবে কখনও ঢেলে বলতে হবে? আমার স্মৃতি খারাপ না, তা বলে সাল, তারিখ, চিঠিপত্র, দলিল দস্তাবেজ দিয়ে নিজেকে নিয়ে লেখার কথা মাথাতেই আনতে পারি না।
আসলে সুনীলদার চরিত্রের মাধুর্যই হল একটা আলগা ছন্দ, সরল মেজাজ, নিজেকে সারাক্ষণ একটা কেউকেটা, গুরুত্বপূর্ণ মনে না-করা প্রকৃতি। তা বলে ওঁর কি ইগো ছিল না? ভয়ঙ্কর ছিল। প্রায় সত্যজিৎ রায়ের মতোই, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়র মতো। যে-অহং নিজেকে দেখানো বা অন্যকে দাবানোর জন্য নয়, বুকপকেটের সোনার ঘড়ির মতো ঘন ঘন বার করে লোক দেখানোর জন্য নয়। এ-অহং নিজের মতো রীতি ও স্বভাবকে অটুট রাখার জন্য, নিজের স্তর ও ক্ষমতাকে বেঁধে রাখার জন্য এবং স্ববিরোধ শোনালেও খুবই সত্যি, নিজের নির্জনতা, লাজুকতা ও দুর্বলতার প্রতিরক্ষার জন্য।
সুনীলদার স্বাভাবিক জীবনটাই একটা সময় থেকে অস্বাভাবিক হয়ে পড়েছিল। দুনিয়ার সবাইকে নিজের সময় বেটে দেওয়াটা কর্ণের দান হয়নি— যা নিয়ে ‘কর্ণকুন্তী সম্বাদ’ লেখা যায়— গৌরী সেনের দান হয়েছিল। একে অক্লান্ত লেখা, সন্ধেকালে মাথা ছড়ানোর পান-আড্ডা, তার ওপর যে-চায় তাকেই সময় নয়তো লেখা দেওয়া। একটা সময় ওঁর আগের নিকট-বন্ধুরা অনেকটাই দূরে চলে গিয়েছিল, সে নিঃসঙ্গতা সুনীলদা’ ভরিয়েছিলেন নতুন, নতুন বন্ধু সমাগমে। যাদের কাছে সুনীলদা এক প্রতিষ্ঠান বিশেষ, সব ত্রুটির উর্ধ্বে, কোনও স্তুতিই যাঁর পক্ষে যথেষ্ট নয়। চিরকাল যে-সুনীলদাকে দেখেছিলাম খুব ন্যায্য প্রশংসাতেও বিব্রত হন, তিনি এসব সহ্য করে নিচ্ছেন। সময়ের দাসত্ব করবেন না বলে যিনি কোনও দিন ঘড়িই পরলেন না (বিয়ের সায়মা ঘড়িটা এক মদের আসরে খোয়া গিয়েছিল, পরে পুলিশে রিপোর্ট করতে গিয়ে নেশার ঘোরে ঘড়ির নাম বলেছিলেন কখনও পার্কার, কখনও শেফার্স, কখনও পাইলট!), তিনিই ডাক পেলে বঙ্গ সাহিত্য ও সংস্কৃতির যে-কোনও সমিতির সভাপতি, কমিটির চেয়ারম্যান বা আসরের মধ্যমণি হওয়া ধরলেন। শেষে সাহিত্য একাদেমির সভাপতি হয়ে অজস্র সময় খোয়ালেন হিল্লিদিল্লি করায়। যখন এসব করছেন, তখনও ওঁর ভেতরে কালান্তক রোগটা বাসা বেঁধে আছে, কিন্তু সুনীলদা তাতে ডরাননি, কাউকে জানতেও দেননি, এতটাই বীরত্ব ও সহ্যশক্তি ধারণ করতেন। তা বলে সময়টা যে বাঁধা পড়ছে, এই ভয়ভাবনা থাকাটা কি ভাল ছিল না?
সে-ভয় থাকলে (শুনেছি রোগটা নাকি প্রথম ধরা পড়ে আমেরিকায় ওঁর মৃত্যুর সতেরো বছর আগে, ঠিক যখন আমি সানন্দার সাক্ষাৎকারে মৃত্যু প্রসঙ্গে জিজ্ঞেস করছি) উনি মহাভারত অনুবাদে কী ‘রোমিও-জুলিয়েট’ শেষ করায় হাত দিতেন কি না জানি না, অন্তত পায়ের তলার শর্ষে একটু ছাড়তেন, বা রাত্রি শাসন করা মজলিশে কিছুটা বেড়ি পরাতেন, আট দশ-গ্লাস পাটিয়ালা পেগ হুইস্কির রেশন কমালেও কমাতেন এবং — এটাই বড় লাভ হত— হয়তো ওঁর নিজস্ব ‘পুতুলনাচের ইতিকথা’য় হাত দিতেন।
সুনীলদার সময় ও ক্ষমতার অপচয় নিয়ে সাতকাহন গাওয়াটা মূর্খামি, কারণ এক জীবনে ভদ্রলোক যে-বিচিত্র সাহিত্যভাণ্ডার সৃষ্টি করে গেলেন তা অকল্পনীয়। ওঁকে পড়তে এত ভাল লাগেই বলে ওঁর সৃজনগুরুত্ব অনেক সময়ই চোখ এড়িয়ে যায়। সমস্যাটা ওঁর দিক থেকে দেখলেও মন্দ হয় না।
সুনীলদা তখন সেই সময়’ ধারাবাহিক ভাবে লিখছেন ‘দেশ’-এ। আনন্দবাজারে একটা ঘরে ওঁর সঙ্গে বসে কাজ করি। একদিন ‘দেশ’ থেকে একজন এসে খুব বিনীতভাবে বললেন, “এবারের কিস্তিটা কি কাল পাওয়া যাবে? একটু চাপ আছে।” সুনীলদা অমায়িক হেসে বললেন, “দেখি। আসলে লেখাটাও তো হতে হবে।”
সেই সন্ধ্যায় ওঁর সঙ্গে অটোমোবিল ক্লাবে যাচ্ছিলাম। গাড়িতে কথা হচ্ছিল রবার্ট গ্রেভস-এর ঐতিহাসিক উপন্যাস ‘আই ক্লডিয়াস’ নিয়ে। তখনও শেষ করতে কিছুটা বাকি ওঁর। সুয়েটোনিয়া-এর ‘টুয়েলভ্ সিজার্স’ কিংবা প্লুটার্কের ‘লাইভজ্ অফ দ্য গ্রেট রোমানাজ্’ কী ভাবে ভেসে বেড়াচ্ছে উপন্যাসে এই সব কথা হচ্ছিল। সুনীলদা হঠাৎ বললেন, “আমি কিন্তু কোনও আপস করছি না। কারণ বেঙ্গল রেনেসাঁটা কতখানি কী সেটা বাজিয়ে দেখার আছে।”
সেদিন ক্লাব থেকে বেরুনোর মুখে ইউরিনালে আমি আর সুনীলদা পাশাপাশি দাঁড়িয়ে। দেখি ঘুমে ক্লান্তিতে চোখ বুজে আসছে ওঁর। কেন জানি না, জিজ্ঞেস করে ফেলেছিলাম, বাড়ি গিয়ে কি ‘আই ক্লডিয়াস’ ধরবেন? সুনীলদার ঠোঁটে সিগারেট, চোখ বোজা, বললেন, “কী করে হবে বলো? কাল সকালে তো কিস্তি লিখতে হবে!”
আরেকবার পুরীর সমুদ্রে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে স্নান করছি। তখন ওখানে ওঁকে নিয়ে একটা তথ্যচিত্র তোলা হচ্ছে। তার চিত্রনাট্য লিখেছিলাম বলে তার অনেক কিছুই বাজিয়ে নিতাম নির্জন সৈকতে স্নান করতে করতে। ঢেউয়ের ওপর লাফিয়ে লাফিয়ে এরকমই একটা প্রশ্ন ছিল: ‘সেই সময়’, ‘প্রথম আলো’ আর পূর্ব-পশ্চিম’-এর পর কি মনে হচ্ছে উপন্যাসের কাজ অন্তত শেষ?”
সুনীলদা দেখলাম লাফিয়েই যাচ্ছেন ঢেউয়ের পর ঢেউয়ের পর ঢেউয়ের ওপর, সমুদ্রের দিকে মুখ করে। শেষে জল থেকে উঠে আসার সময় আমার পাশে এসে দাঁড়িয়ে নামানো স্বরে বললেন, “তোমার ওই প্রশ্নের উত্তরে বলতে হচ্ছে— না, হয়নি। তা হলে তো উপন্যাস লেখাই বন্ধ করতে হবে।
বললাম, “ইচ্ছে করে না, জীবনের শেষ বড় কাজ বলে একটাই উপন্যাস ধরে পড়ে থাকতে?
ওরকম বরাত কি কেউ দেবে?
অন্যের বরাতে কেন? নিজেই নিজেকে বরাত দিয়ে। শেষ হলে ছাপতে দেবেন।
পারব না। তুমি তো জানো, কিস্তির চাপ না থাকলে খুব বড় লেখা আমার হবার না। পুজো সংখ্যার লেখাই তো চাপে চাপে শেষ করি।
আমার মনে পড়ল, অনেক দিন আগে সুনীলদা একবার লিখেছিলেন, লিখি টাকার জন্য। আর লেখা চাওয়া হলে।
টাকার সেই টান সুনীলদার বহু দিন হল চলে গিয়েছিল। টাকা ছাড়াই যে কী অজস্র লেখা উনি দান করে গেছেন, তার সীমা-পরিসীমা নেই। তবে না চাইলে গদ্য লিখতে পারাটা থেকে গিয়েছিল। কিন্তু কবিতা লিখতেন রক্তের টানে, স্মৃতির টানে, ভালবাসার টানে। শেষ দিকে বন্ধু শক্তির অত্যাগমনেও এক অপূর্ব কবিতা লিখলেন।
বালির ওপর দিয়ে ফিরতে ফিরতে জিজ্ঞেস করলাম, “তার মানে দরজা-জানলা বন্ধ করে, মানুষজন থেকে সরে বছরের পর বছর ধরে মার্সেল প্রুস্তের মতো তেরো খণ্ড ‘রিমেমব্রন্স অফ থিংগজ পাস্ট’ উপন্যাস গোছের কিছু আপনার কাছে অকল্পনীয়? ওই মহত্ত্বর কথায় বলছি না, ওই ধরন ও বহরের।”
সঙ্গে সঙ্গে সুনীলদার ভেতরকার সেই পড়ুয়া, অনুরাগী ও শিল্পীটি বেরিয়ে এল—“বলো কী! ও-ও তো মহাভারত লেখার মতো ব্যাপার। শুধু পাতা দিয়ে দেখলেই তো হবে না। কমলদা (মজুমদার) ছাড়া আমাদের এখানে পুরো কেউ তেরো খণ্ড পড়েছে বলেও তো শুনিনি। যদি জোগাড় করে দাও তো কয়েক খণ্ড পড়ার আকাঙ্ক্ষা আছে।”
তাহলে বলি, এহেন নানা অনাবিল আকাঙ্ক্ষার মতো সুনীলদার যে কিছু উচ্চাঙ্ক্ষাও ছিল না তাও না। ক্ষমতার আকাঙ্ক্ষার মতো উচ্চাকাঙ্ক্ষা ওঁর ছিল। সেই প্রথম যৌবন থেকেই ‘কৃত্তিবাস’ করা, মধ্যবয়েসে নতুন করে ‘কৃত্তিবাস’ করা, প্রৌঢ়ত্বে এসে ‘বুধসন্ধ্যা’, বার্ধক্যে উন্নীত হয়ে ‘ভাষা দিবস’, বঙ্গ সংস্কৃতি উৎসব গঠন এবং সাহিত্য অকাদেমির সভাপতি হওয়ার আকাঙ্ক্ষা ও উচ্চাকাঙ্ক্ষায় দ্রব। একবার আমায় বলেছিলেন,“কবিতার পাতা দেখার মধ্যে হ্যাপা অনেক। কত যে হাবিজাবি অনুরোধ আসে আর হিজিবিজি পড়তে হয়। আর তার মধ্যে একটা যথার্থ কবিতার স্বর আবিষ্কার করতে পারলে সব ক্লেশ কেটে যায়।”