বল পিন্টু চৌধুরীর পায়ে
কিন্তু তার পিছনে আমাকে যে কত হিসেব কষে চলতে হয়েছে! কত বার যে এক তারকা ফুটবলারের সঙ্গে অন্য তারকা ফুটবলারের ইগো-সমস্যা সামলাতে হয়েছে! মেগাটিমের টিপিক্যাল জমিদারি মনোভাবাপন্ন ‘স্টেজে গিয়ে মেরে দেব’ মার্কা আত্মতুষ্ট মেজাজকে বাস্তবের রুক্ষ জমিতে এনে জাগিয়ে তুলতে হয়েছে! সে সব একমাত্র আমিই জানি।
সাতাত্তরে লিগের বড় ম্যাচ হারার পর মোহনবাগানে অস্থির অবস্থা! প্র্যাকটিসে সমর্থকদের গালাগালের বন্যা বইছে। ফুটবলাররা টেনশনে! কর্তারা ক্ষুব্ধ। সব কিছুকে মাথা ঠান্ডা রেখে সামলেছি। কারণ আমি যে কোচ দলের! মানে আমিই সংসারের অভিভাবক, আমিই পরিবারের ডাক্তার, আমিই বাড়ির পাহারাদার!
একবার তো ম্যাচ চলাকালীন রেফারিকে অনুনয়-বিনয় করে খেলা থামিয়ে মাঠের মধ্যিখানে গিয়ে দাঁড়িয়ে মোহনবাগান সমর্থকদের হাতজোড় করে অনুরোধ করেছিলাম— প্লিজ, দয়া করে একটু ধৈর্য ধরুন। আমাদের একটু সময় দিন। আপনাদের প্রিয় এই দলই এ বছর অনেক ট্রফি জিতবে। একটা লিগ পাইনি ঠিকই, কিন্তু এখনও প্রায় গোটা মরসুম পড়ে আছে। আপনাদের সুসময় ফিরবেই। আমরাই ফেরাব।
বললাম বটে, কিন্তু সেটা করে দেখাতে হলে তো তেমনই প্রস্তুতি দরকার! সকালে টিম প্র্যকটিস ছাড়াও বিকেলে কয়েক জন বিশেষ ফুটবলারকে নিয়ে আলাদা প্র্যাকটিস চালু করেছিলাম মরসুমের মধ্যে। যেটা সচরাচর প্রি-সিজন প্র্যাকটিসে হয়টয়।
হাবিব বড় ম্যাচে সিটার নষ্ট করে মুষড়ে ছিল অনেক দিন। ওর মতো ডাকাবুকো ছেলেরও সেই সময় ফর্ম সামান্য পড়তির দিকে। টিমের অন্য সব সতীর্থের পিছনে ফোড়ন কাটার অভ্যেস থাকা আমার এক তারকা স্টপার হাবিবকে তখন টার্গেট করেছে!
আমি গোটা ব্যাপারটা ক্লাবকর্তা, মিডিয়ার তীক্ষ্ম চোখ এড়িয়ে সামলেছিলাম। হাবিবকে গোপনে নিজের বাড়িতে এনে বুঝিয়েছিলাম, “তুমি দলের কতটা অপরিহার্য শক্তি।”
আবার সেই ফোড়ন কাটা স্বভাবের প্লেয়ারকে আলাদা ডেকে বলে দিয়েছিলাম, “ফুটবল খেলাটা টিমগেম। একটাই সুতোয় এগারোজন বাঁধা। সুতোয় টান পড়লে সবাই হুড়মুড়িয়ে মাটিতে পড়বে। তুমি একা রক্ষা পাবে, ভেবো না। অতএব...!”
বিশ্বাস করুন, তার পর কসমস ম্যাচ থেকে বাকি মরসুমটাই সেই তারকা স্টপার আর হাবিব, মূলত ওরা দু’জনই মোহনবাগানকে মাঠে লিড করেছে। যে কোনও চাপের সময়, যে কোনও উঠে দাঁড়াবার মুহূর্তে! ড্রেসিংরুমে পর্যন্ত দু’জনের মধ্যে কী চমৎকার বোঝাপড়া তৈরি হয়েছিল!
টেনিসের ডাবলসে যেমন জুটির একে অন্যকে সম্মান করার মধ্যেই কোর্টে তাদের সাফল্যের আসল রসায়ন লুকিয়ে থাকে— তেমনই সাতাত্তরের লিগোত্তর মরসুম জুড়ে মোহনবাগানে সেই তারকা স্টপার আর হাবিবের পার্টনারশিপটা ছিল।
পঁচাশিতে আবার মনোরঞ্জন প্রথমে শ্রীলঙ্কা ট্যুরে গেল না। কোনও যুক্তিগ্রাহ্য কারণ ছাড়াই। আমি ওখানে পৌঁছে যখন তরুণ দে-র পাশে বলাই মুখোপাধ্যায়কে আনকোরা স্টপার পজিশনে প্রায় ফিট করে ফেলেছি, আচমকা মনা কলম্বোয় এসে হাজির। কিন্তু আমাকে তখন অনড় দেখে মনোরঞ্জন আবার যেমন আচমকা ওখানে গিয়েছিল, তেমনই টুর্নামেন্টের মধ্যেই ফের কলকাতা ফিরে গেল। সব মিলিয়ে সে এক যাচ্ছেতাই অবস্থা ইস্টবেঙ্গল ড্রেসিংরুমের!
অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে, অনেক ফুটবলার, অনেক ক্লাবকর্তাকে বুঝিয়েসুঝিয়ে বিতর্কিত পরিস্থিতিটা সামলেছিলাম। ফুটবল সচিব সুপ্রকাশ গড়গড়ি ওই সময় আমাকে প্রচুর সাহায্য করেছিল। বিদেশে তো আর ইস্টবেঙ্গল শুধু একটা ভারতীয় ক্লাব নয়, গোটা দেশের প্রতিনিধিত্ব করছে তখন। গড়গড়িও যেটা ওখানে বুঝেছিল। শ্রীলঙ্কায় যা ঘটাবে আমার অত বড় তারকাখচিত দল, সেটা গোটা ভারতের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে। সেটাই দুনিয়ার খেলাধুলোয় নিয়ম।
কিন্তু আমার প্রাণপাত চেষ্টাই বলুন, বা বরাবর আমার ঈশ্বরভক্তির কারণেই বলুন— সে যাত্রাও ভাল ভাবে উতরে যেতে পেরেছিলাম। পুরোশক্তির ডিফেন্স না থাকা সত্ত্বেও কলম্বো থেকে আমার ইস্টবেঙ্গল ট্রফি নিয়ে ফিরেছিল।
সাতাত্তরের লিগোত্তর মোহনবাগানের মতোই পঁচাশিতে শ্রীলঙ্কায় ইস্টবেঙ্গল ড্রেসিংরুমেও আমি যদি নীলকন্ঠ হয়ে উঠে টিমের সব বিষপান করে তার শরীরটাকে সুস্থ রাখতে না পারতাম, তা হলে ত্রিমুকুট জেতার রেকর্ড বা বিদেশ থেকে ট্রফি আনার গৌরব পেত কি মোহন-ইস্ট? অত বড় তারকাখচিত দল গড়েও?
তা হলে তো বার্সা, রিয়াল, ম্যান ইউয়ে কোচেরই দরকার পড়ত না! ইস্ট-মোহনেও নয়!
স্টারস্টাডেড দলকে যেমন স্ট্র্যাটেজি, ট্যাকটিক্স বোঝানো তুলনায় সহজ। যেমন মাঠে সেটা করে দেখাতে তুলনায় কম সময় লাগে হয়তো, তেমনই মহাতারকায় ভরা টিমে প্লেয়ারদের আলাদা-আলাদা ইগোকে সামাল দেওয়া, সব নায়কের মন জোগানোর মতো একটা সার্বিক পরিবেশ তৈরি করা ততটাই কঠিন কোচের পক্ষে।
তাই বোধহয় মেগাটিমের কোচ মনে মনে ভাবতেই পারে সেই বিখ্যাত লাইনটা— পথ ভাবে আমি দেব, রথ ভাবে আমি, মূর্তি ভাবে আমি দেব, হাসে অন্তর্যামী!
(চলবে)
সংশোধনী
জীবনের শেষ মামলায় সন্তোষ দত্ত সরকারের পক্ষে দাঁড়িয়েছিলেন। রায়ে অভিযুক্তদের যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের সাজা হয়। ৬ ডিসেম্বর-এর ‘পত্রিকা’-য় ‘কোনও প্রশ্ন নয়’ শিরোনামের লেখায় ভুলবশত ‘সাজা’র জায়গায় ‘খালাস’ লেখা হয়েছিল।