বাচ্চাদের শাসন প্রয়োজন ঠিকই, কিন্তু সঙ্গে মাপ মতো স্নেহও দরকার।
এক সাম্প্রতিক গবেষণা দেখিয়েছে, যে সব বাবা-মা খুব বেশি কড়া, সারাক্ষণ নিয়ন্ত্রণ করতে চান সন্তানদের, তাঁদের সন্তানরাই সবচেয়ে তাড়াতাড়ি ইন্টারনেেট আসক্ত হয়ে পড়ে। তাদের বেশির ভাগ মিশতে শেখে না, খেলতে শেখে না, এমনকি চোখ তুলে কথা অবধি বলতে শেখে না। বাচ্চা যদি সহজে মা-বাবার নাগাল না পায়, দিনের শেষে অকৃত্রিম স্নেহের বদলে তর্জনি তোলা শাসনে কুঁকড়ে যেতে থাকে, তা হলে সে অন্য জগৎ খুঁজে নেবেই স্বস্তির জন্য।
এর জন্য অনেক সময়েই দায়ী মা-বাবার আচরণ। তাঁদের এই চাপিয়ে দেওয়ার প্রবণতাটা সবচেয়ে বেশি চোখে পড়ে সন্তানের পড়াশোনা এবং কেরিয়ারের ক্ষেত্রে। অনেক মা-বাবাই সন্তান ছোট থাকতেই ঠিক করে ফেলেন, সে ভবিষ্যতে কী হবে। ‘আমার মেয়ে ডাক্তার হবে’ বা ‘ছেলেকে আমি বিদেশে পাঠাব হায়ার স্টাডিজ়ের জন্য’— এই ধরনের কথাগুলোর মধ্যে সন্তানের ইচ্ছের কোনও জায়গাই থাকে না। সবটাই মা-বাবার সাধ পূরণের গল্প। হতেই পারে সে হয়তো ডাক্তার হওয়ার বদলে সাহিত্য নিয়ে পড়তে চাইছে অথবা বিদেশে নয়, এ দেশেই কোনও সমাজসেবামূলক কাজ করতে ইচ্ছুক। আপনার সাধ পূরণের ইচ্ছে আর জেদ কিন্তু ওর নিজের স্বপ্নটাকে ভেঙে ফেলবে।
তাই ছোট থেকে ওর সামনে জীবনের লক্ষ্য বেঁধে দেবেন না। বড় হয়ে কী হতে চাও— এই প্রশ্নের উত্তরটা ওকেই দিতে দিন। নিজেরা শিখিয়ে দেবেন না। প্রথমে উত্তরগুলো আপনার কাছে অদ্ভুত লাগতে পারে। কোনও বাচ্চা বলতেই পারে সে বড় হয়ে ট্রাক চালাতে চায়। এ নিয়ে হাসাহাসি করবেন না। বরং ওকে বোঝান, ও যা-ই করুক, সেটা যেন মন দিয়ে করে। এতে দুটো জিনিস হবে। ও জানবে কোনও কাজই ছোট নয়। মন দিয়ে করা প্রত্যেক কাজই গুরুত্বপূর্ণ। এবং ওর স্বাধীন ভাবে চিন্তার ক্ষমতা তৈরি হবে, যা পরে তাকে নিজের পায়ে দাঁড়াতে সাহায্য করবে।
এক নজরে
• বাচ্চাকে ‘বাচ্চা’ হিসেবে নয়, এক জন ‘ইনডিভিজুয়াল’ হিসেবে দেখুন। বিভিন্ন ব্যাপারে ওর মতটাও জানার চেষ্টা করুন।
• সন্তানের প্রতি কড়া হোন। কিন্তু সেটা প্রয়োজনে। অপ্রয়োজনে কড়া হলে ওর সঙ্গে দূরত্ব তৈরি হতে পারে।
• জোরদার বকুনি দেওয়ার পরে ওকে আদর করে বুঝিয়ে বলতে হবে কেন ও বকুনি খেয়েছে।
• সব সময় নিজের মত আর পছন্দ ওর উপরে চাপিয়ে দেবেন না। তা হলে বড় হয়ে ও নিজে সিদ্ধান্ত নিতে পারবে না।
• ধৈর্য ধরে ওর কথা শুনুন। প্রথমেই ধমকে থামিয়ে দেবেন না।
একটা কথা অনেকেই খুব বলেন, গোড়া থেকে কড়া হাতে রাশ টেনে ধরতে হয়। কথাটা বোধহয় পুরোপুরি ঠিক নয়। বাচ্চাদের শাসন প্রয়োজন ঠিকই, কিন্তু সঙ্গে মাপ মতো স্নেহও দরকার। আর দরকার ছোট থেকেই তার ইচ্ছে, মতামতগুলোকে গুরুত্ব দেওয়া। মা-বাবার ইচ্ছেটাই শেষ কথা, এমনটা সম্পূর্ণ ভুল ধারণা। তার ইচ্ছেগুলো উড়িয়ে দিতে থাকলে একটা সময়ে জেদ জন্মাতে পারে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সে তখন ঠিক সেই কাজটাই করবে, যেটা মা-বাবার ঘোর অপছন্দের। তার ফলও ভাল হবে না। আশঙ্কা আরও আছে। বারবার অভিভাবকের মতটাই নিজের মত বলে মেনে নিতে থাকলে একটা সময়ে আত্মবিশ্বাস পাকাপাকি ভাবে মুছে যাবে তার জীবন থেকে। হয়তো দেখা যাবে তিরিশের কোঠায় পৌঁছেও রেস্তরাঁর মেনু থেকে হনিমুন ডেস্টিনেশন অবধি সব কিছুতে অন্যদের মত নিতে হচ্ছে। সারা জীবন সিদ্ধান্তহীনতার সমস্যা তার পিছু ছাড়বে না। তাই ওর কথাটাও শুনতে হবে। সব সিদ্ধান্ত নিজেদের হাতে তুলে নেবেন না। কিছু জায়গা ওর জন্যও রাখতে হবে, যেখানে ও নিজের মতো করে শ্বাস নিতে পারবে, বাঁচতে পারবে। আপনি ওর পড়ার সময়টা বেঁধে দিতে পারেন। কিন্তু সেই সময়ের মধ্যে কখন ও কোন বিষয়টা আগে পড়বে, সেই সিদ্ধান্তটা ওর উপরে ছাড়ুন। হয়তো কোনও একটা সময়ে ওর অঙ্ক করতে ভাল লাগছে না, আঁকতে চাইছে। সেটা ওকে করতে দিন। জোর করে ওই সময়ে ওকে অঙ্ক করতে বসালে বিষয়টায় ওর মন বসবে না। পড়াও ভাল ভাবে তৈরি হবে না।
ছোটখাটো বিষয়ে ওর মতামত নিন, ওর পছন্দকে গুরুত্ব দিন। যেমন বার্থডে কেক কেমন হবে, কোন বন্ধুদের সে ডাকতে চায় জন্মদিনে? জামাকাপড় কেনার প্রাথমিক পছন্দ আপনি নিজে করে ওকে বলুন একটা বেছে নিতে। নিজেরা রেস্তরাঁয় গেলে ওকে তো সঙ্গে করে নিয়েই যান, কখনও আবার সম্পূর্ণ ওর পছন্দের খাবার খেতেও বেরোন। আইসক্রিম খেতে চাইলে ওকে আইসক্রিম পার্লারে নিয়ে গিয়ে একটা ট্রিট দিন। সব কিছু ওর পছন্দে করা নয়, দরকার আপনাদের সাধ্য আর ওর পছন্দের একটা সুন্দর মিলমিশ। তা হলে সমস্যা অনেক কমে যাবে।
বেড়াতে যাওয়ার সময়ে ওকেও একটা ছোট্ট ব্যাগ দিন। বলুন এতে ওর পছন্দের জিনিসগুলো ইচ্ছে মতো গুছিয়ে নিতে। দরকারি-অদরকারি জিনিসের মধ্যে পার্থক্য করতে শিখবে।
মনে রাখতে হবে, এখন বাবা-মা দু’জনেই পেশার তাগিদে দিনের অনেকটা সময় বাইরে কাটান। তাই রাতে ফিরে এসেই সারা দিনের ক্লান্তি আর বিরক্তিটা ওর উপরে উগরে দেবেন না। বর্তমান সময়ে বাচ্চাদের একাকিত্ব আমাদের কল্পনার বাইরে। নিজেরা দায়িত্ব নিয়ে সেটাকে আরও কিছুটা না-ই বা বাড়ালেন!
ছবি: দেবর্ষি সরকার, মডেল: আরিয়ানা, শ্রীলগ্না
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy