Advertisement
১৬ এপ্রিল ২০২৪

শেষ সম্রাট

বাহাদুর শাহ জাফর। সিংহাসন নেই, নেই সাম্রাজ্য। তখন তিনি কয়েদি মাত্র! সম্রাটের সমাধি খুঁজে পাওয়ার পঁচিশ বছরে মায়ানমারে তাঁর স্মৃতিসড়কে হাঁটলেন গৌতম চক্রবর্তীইয়াঙ্গন শহরের এই নির্জন একটেরে গলিতে লুকিয়ে আছে ভারতের ইতিহাস? সাদামাঠা এই দরগায়? রাস্তাটার নাম জি ওয়াকাওয়া স্ট্রিট। গাড়িঘোড়া, পথচারীর সে রকম ভিড় নেই। দরগার সামনে এক চিলতে ফাঁকা মাঠ। তার পাশ দিয়ে কয়েক মিনিট ড্রাইভ করে গেলেই ইয়াঙ্গন শহরের অন্যতম গৌরব: শোয়ে ডাগন প্যাগোডা। সোনায় তৈরি তার রত্নখচিত চুড়ো রাতের আকাশে ঝলমল করে।

শেষ আপডেট: ১৫ অগস্ট ২০১৫ ০০:০৩
Share: Save:

ইয়াঙ্গন শহরের এই নির্জন একটেরে গলিতে লুকিয়ে আছে ভারতের ইতিহাস? সাদামাঠা এই দরগায়?
রাস্তাটার নাম জি ওয়াকাওয়া স্ট্রিট। গাড়িঘোড়া, পথচারীর সে রকম ভিড় নেই। দরগার সামনে এক চিলতে ফাঁকা মাঠ। তার পাশ দিয়ে কয়েক মিনিট ড্রাইভ করে গেলেই ইয়াঙ্গন শহরের অন্যতম গৌরব: শোয়ে ডাগন প্যাগোডা। সোনায় তৈরি তার রত্নখচিত চুড়ো রাতের আকাশে ঝলমল করে।
এই দরগায় সেই ধনাঢ্য আভিজাত্য নেই। এক পাশে কেয়ারটেকারের বিবর্ণ সবুজ ঘর। মূল দরজা পেরিয়ে শ্বেতপাথরে তৈরি কয়েকটা সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে গেলেই মাজার। পাশাপাশি দুটি কবরে চাদর চড়ানো। একটি কবর তাঁর, সেই সুফি সাধকের। পাশেরটি তাঁর স্ত্রী জিনাতমহলের। দেওয়ালে দু’ জনের সাদা কালো ছবি। পাশাপাশি ফ্রেমে উর্দু ভাষায় বাঁধিয়ে রাখা সুফি কবির কয়েকটি শায়রি, নীচে ইংরেজি অনুবাদ। ‘কিতনা হ্যায় বদনসিব জাফর/ দফনকে লিয়ে দো গজ জমিনভি মিল নহি সকি।’ জাফর, তুমি এতই দুর্ভাগা, ভালবাসার দেশে তোমার কবরের জন্য দু’গজ মাটিও জুটল না। লাল, সবুজ সাইকোডেলিক আলোর নীচে ব্লো-আপ করা ফ্রেমবন্দি ছবি থেকে তখনও কবির চোখ দুটো আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে। পাশে ইংরেজি ও উর্দু ভাষায় তাঁর পরিচিতি: হজরত মহম্মদ সিরাজুদ্দিন বাহাদুর শাহ জাফর (১৭৭২-১৮৬২ খ্রিস্টাব্দ)। দিল্লির লালকেল্লা থেকে বহু দূরে, এখানেই মারা যান শেষ মুঘল সম্রাট।
কিন্তু এটি আসল কবর নয়। সিঁড়ি বেয়ে দরগার বেসমেন্টে নেমে যেতে হবে। সামনে রেলিং-ঘেরা সবুজ চাদর বিছানো আর একটি সমাধি। ১৯৯১ সালে এই সমাধিচত্বরের নালা খোঁড়াখুঁড়ির সময় বার্মিজ শ্রমিকরা মাটির নীচে একটি ইটের কবরখানা দেখে। কফিনের ভেতরে কঙ্কালও আছে। অচিরেই জানা যায়, এই কবর ও কফিন কার! এ বারই সেই আবিষ্কারের ২৫ বছর পূর্তি।

ওপরে-নীচে এ ভাবে দুই সমাধির কারণ? ইংরেজ প্রথম থেকেই জানাতে চায়নি, কোথায় তাঁকে গোর দেওয়া হল। ৮৭ বছরের বৃদ্ধ বাহাদুর শাহ তাদের কাছে শেষ মুঘল সম্রাট নন, বিদ্রোহী সিপাহিদের প্রেরণা।

১৮৬২ সালের ৭ নভেম্বর ভোর পাঁচটায় তাই এই বৃদ্ধ মারা যাওয়ার পরই ব্রিটিশ সাম্রাজ্য বিন্দুমাত্র সময় নষ্ট করেনি। দু’ দিন আগে থেকেই কিছু খেতে পারছিলেন না, চামচ করে স্যুপ গেলানো হচ্ছিল। মৃত্যু তখন শুধু সময়ের অপেক্ষামাত্র!

বিকেল ৪টে নাগাদ প্রহরীদের ডেরার পিছন দিকে গর্ত খুঁড়ে তাঁকে কবর দেওয়া হল। একটু দূরে বানানো হল বেতের বেড়া। জেলার নেলসন ডেভিস লন্ডনে জানালেন, ‘কয়েদির মৃত্যু নিয়ে এখানে কেউ ভাবিত নয়। মেরেকেটে শ’খানেক লোক, বেশির ভাগই রেসকোর্সে বাজি ধরতে যাচ্ছিল। বেড়া আস্তে আস্তে পচে যাবে, নতুন ঘাস গজাবে, কয়েদিকে কোথায় কবর দেওয়া হল কেউ জানতেও পারবে না।’ সারা চিঠি জুড়ে কয়েদি বা প্রিজনার শব্দের ছড়াছড়ি।

বছর দুয়েক আগে ডেভিস কলকাতায় তাঁর কর্তাদের কাছে একটা চিঠি লিখেছিলেন। প্রাক্তন সম্রাটের দুই ছেলে মির্জা জওয়ান বখ্ত ও শাহ আব্বাস ইংরেজি শিখতে চান। বাহাদুর শাহ ও বেগম জিনাতমহলও এ বিষয়ে আগ্রহী। কর্তারা উচ্চবাচ্য করলেন না, উপরন্তু গভর্নর জেনারেল লর্ড ক্যানিং জানালেন, ‘ভবিষ্যতে এই সব প্রাক্তন সম্রাট, মুঘল রাজা গোছের শব্দ ব্যবহার করবেন না। স্টেট প্রিজনার লিখবেন।’ তাঁর সম্বন্ধে সম্রাট শব্দটা বারংবার মুছে ফেলতে চেয়েছে ইংরেজ।

পরিকল্পনা কাজে দিয়েছিল। স্বামীর মৃত্যুর ২০ বছর বাদে জিনাতমহল যখন ইয়াঙ্গনের এক চিলতে ঘরে হতদরিদ্র অবস্থায় আফিং-এর নেশা করতে করতে মারা গেলেন, তাঁকে কবর দেওয়া হল কাছাকাছি এক জায়গায়। তাঁর স্বামীর কবর ঠিক কোথায়, তত দিনে লোকের স্মৃতি থেকে বেরিয়ে গিয়েছে। ইংরেজরা অওধের শেষ নবাব ওয়াজেদ আলি শাহকে মেটিয়াবুরুজে নির্বাসন দিয়েছিল, সেন্ট হেলেনায় নির্বাসিত নেপোলিয়নকে স্লো পয়জনিং করেছিল। কিন্তু প্রশাসনিক মেশিনারি কাজে লাগিয়ে এ রকম কবর-পলিটিক্স কোথাও নয়!

পরের শতকেই অবশ্য অবস্থার পরিবর্তন হল। সারা ভারত জুড়ে জাতীয়তাবাদী আন্দোলন, ইয়াঙ্গন বা তৎকালীন রেঙ্গুনও তার বাইরে নয়। ১৯০৭ সালে তাই ছোট্ট এক পাথরের ফলক বসল, ‘দিল্লির প্রাক্তন রাজা বাহাদুর শাহ এখানে মারা গিয়েছিলেন, সন্নিকটে তাঁর সমাধি।’ পরে সেই পাথুরে ফলকের কাছেই তৈরি হল টিনের চালার ছোট্ট মাজার। এই শ্বেতমর্মর শোভিত সমাধির পূর্বপুরুষ।

‘এই বাগানে শীত যায়, বসন্ত আসে/তবু প্রতিটি সকাল এক লাগে/খাঁচা ভিতরে কে-ই বা বোঝে শীত, বসন্ত আসে?’ দেওয়ালের গায়ে শায়রি দেখাচ্ছিলেন কেয়ারটেকার কামালউদ্দিন। রেঙ্গুনেই জন্ম, পিতামহ থাকতেন চেন্নাইয়ে। তিনিই মাজারের প্রথম কেয়ারটেকার। ‘‘এই জায়গাটায় ভারত-পাকিস্তান বিরোধ নেই। আপনাদের রাজীব গাঁধী, মনমোহন সিংহ এসেছেন, বেনজির ভুট্টোও,’’ বলছিলেন কামাল। শোনা গেল, স্থানীয় মুসলমানেরাও আসেন নমাজ পড়তে, কাওয়ালি গাইতে। এই বাহাদুর শাহ জাফর নিছক সম্রাট নন, সুফিসাধক।

সম্রাট থেকে সাধকে উত্তরণ তাঁর জীবনে নতুন নয়। ৬২ বছরে সিংহাসনে বসলেন জাফর, তাঁকে ঘিরে থাকে সুফি পীর ও হিন্দু জ্যোতিষীদের দল। সন্ধ্যাবেলায় লালকেল্লায় মির্জা গালিব, জক-এর মতো কবিদের ডেকে শায়রি শোনেন, কখনও রামলীলা দেখেন। হিন্দু ও মুসলিম প্রজার মধ্যে ভেদাভেদ করেন না। এক ঈদের দিন দুশো মুসলমান তাঁর কাছে কেল্লায় গরু জবাইয়ের অনুমতি চায়। সেখানে হিন্দু কর্মচারীও প্রচুর। জাফর সাফ বলে দিলেন, ‘সে কী! গরু কাটার ওপর আজকাল মুসলিম ধর্ম নির্ভর করে না কি?’ তত দিনে বাংলা-বিহার-ওড়িশা থেকে পঞ্জাব, মহীশূর সব ইংরেজের দখলে, মুঘল সাম্রাজ্য বলতে স্রেফ দিল্লির যমুনাপাড়। ওই এক চিলতে জায়গাতেও বাহাদুর শাহ তাঁর পূর্বসূরি আকবরের হিন্দু-মুসলমান সম্প্রীতির নীতি থেকে এক বিন্দু সরেননি।

ট্রাজেডির শুরু ১৮৫৮ সালের ১১ মে। মেরঠ, কানপুর থেকে আসা সিপাহি বিদ্রোহের সৈনিকেরা ততক্ষণে দিল্লি শহরে ঢুকে লুঠপাট শুরু করে দিয়েছে, সবাইকে কচুকাটা করছে। জাফরের প্রহরীরাও ভয়ে পালিয়ে গিয়েছে। বিকেল তিনটে নাগাদ লালকেল্লায় বিদ্রোহী সিপাহিরা ঢুকে চেঁচামেচি শুরু করে, ‘আমাদের কার্তুজ ও অস্ত্রশস্ত্র লাগবে। সম্রাট আমাদের আশীর্বাদ করুন।’ জাফর নারাজ, ‘আপনারা ওপরওয়ালা অফিসারদের খুন করে পালিয়ে এসেছেন।’ কিন্তু সিপাহিরা তাঁকে ঘিরে ধরে, যেতে দেয় না। এক সভাসদকে বিষণ্ণ স্বরে সম্রাট সে দিন বলেছিলেন, ‘বৃদ্ধ বয়সে এটাই আমার প্রাপ্য?’ প্রায় বাধ্য হয়ে তিনি সিংহাসনে বসলেন, সকলে এসে তাঁকে সালাম করে আশীর্বাদ চাইল।

এই ঘটনাটাই পরবর্তী কালে তাঁকে বিচারের মুখোমুখি দাঁড় করায়। দিল্লিকে তখন কেউ ছাড়েনি। এক দিকে বিদ্রোহী সিপাহি ও গুজ্জর ডাকাতদের লুঠপাট। অন্য দিকে ইংরেজরাও পরে যুদ্ধে জিতে নৃশংস প্রতিশোধ নিতে আরম্ভ করে। এক ‘কুচা চালান’ এলাকায় শিশুবৃদ্ধ নির্বিশেষে হাজার জনকে কোতল করা হয়। বিচার না করেই রাস্তায় ফাঁসিকাঠ তৈরি করে ঝুলিয়ে দেওয়া হয় মানুষকে। ধ্বংস করা হয় মসজিদ থেকে মুঘল বাগিচা অনেক কিছু। ব্রিটিশ পরিকল্পনা, মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিতে হবে দিল্লি শহরকে। এতটুকু অস্তিত্ব যেন না থাকে তার!

এই পরিস্থিতিতে ১৭ সেপ্টেম্বর ভোরে লালকেল্লা ছেড়ে জাফর আশ্রয় নিলেন নিজামুদ্দিনের দরগায়। পীরের কাছে দুঃখ করলেন, ‘বিদ্রোহীরা যে দুর্ভাগ্য বয়ে আনবে, জানতাম। মুঘল প্রদীপের আলো আর কয়েক ঘণ্টা পরেই শেষ হয়ে যাবে।’ তার পর আর কেল্লায় ফিরলেন না, চলে গেলেন পূর্বপুরুষ হুমায়ুনের কবরে। কয়েক ঘন্টা পরে সেখানে এলেন বেগম জিনাতমহলও। লালকেল্লায় ততক্ষণে আছড়ে পড়ছে ইংরেজ সৈন্যদের কামানের গোলা। জয় সমাপ্ত। শাহজাহানের দিওয়ান-ই-খাসে এ বার বিজয়ী সৈন্যদের ডিনার, হুইস্কির গ্লাসে সম্রাজ্ঞী ভিক্টোরিয়ার স্বাস্থ্যপান, ‘গড সেভ দ্য কুইন’।

হুমায়ুনের কবরে লুকিয়ে থাকা সম্রাটকে এই দৃশ্য দেখতে হয়নি। তার দু দিন বাদে ২০ তারিখ ইংরেজ সেনাপতি হডসন তাঁকে ধরে নিয়ে এলেন লালকেল্লায়। প্রহরায় কেন্ডাল কোগিল নামে এক ইংরেজ সেনা। ‘‘হিন্দুস্থানের রাজা এখন আমার বন্দি। সেন্ট্রিদের বলেছি, জানোয়ারটা মুখ তুলে তাকালেই গুলিতে ঝাঁজরা করে দিতে,’’ বাড়িতে চিঠি লিখছেন কোগিল। ততক্ষণে সম্রাটের দুই ছেলেকে নিরাপত্তার আশ্বাস দিয়ে হুমায়ুনের কবর থেকে বের করে এনেছেন হডসন, এবং মাঝরাস্তায় তাদের ন্যাংটো করে গুলি। খবর পেয়ে জাফর স্তম্ভিত, অনেকক্ষণ কথা বলতে পারেননি।

আজ তিনি আর সম্রাট নন। পূর্বপুরুষের তৈরি কেল্লার দুটো ছোট্ট খুপরিতে বন্দি, খাটিয়ায় শতচ্ছিন্ন রজাই। রোজকার খাওয়াদাওয়ার জন্য বরাদ্দ দু’আনা। আগে অনুমতি ছাড়া উজির থেকে আমির কেউ আসতে পারতেন না তাঁর সামনে। আর এখন তিনি উঠতে বসতে ইংরেজ প্রহরীদের সালাম ঠোকেন। ধোবি, ক্ষৌরকার থেকে হাকিম কাউকে আসতে দেওয়া হয় না তাঁর কাছে। ‘রাজপরিবারের কেউ বিন্দুমাত্র সুবিধে পাওয়ার যোগ্য নয়। সামান্য সমবেদনা জানানোও ভুল,’ নির্দেশ দিচ্ছেন ব্রিটিশ সেনাধ্যক্ষ স্যার জন লরেন্স।

১৮৫৮ সালের জানুয়ারিতে শুরু হল রাজদ্রোহের অভিযোগে তাঁর বিচার। শীতের সকাল, অশক্ত বৃদ্ধ মাঝে মাঝে দিওয়ান-ই-খাসের বিচারালয়ে ঘুমিয়ে পড়েন, কিছু না বুঝে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকেন। তাঁর পূর্বপুরুষ সম্রাট জাহাঙ্গির এক দিন এই ইংরেজ বণিকদের এ দেশে ব্যবসার অধিকার দিয়েছিলেন। তারাই আজ বিচারক!

মার্চ মাসে সাজা ঘোষণা হল: নির্বাসন। আন্দামান, দক্ষিণ আফ্রিকার কেপ কলোনি...গভর্নর জেনারেল যেখানে ভাল বুঝবেন!

কিন্তু মুঘল সম্রাটকে কোথায় পাঠানো যায়? লোক জানাজানি হলে ফের প্রজাবিদ্রোহ! ৭ অক্টোবর ভোর তিনটেয় জেলার ওমনি সাহেব বৃদ্ধকে ডেকে তুললেন, ‘চলুন, যেতে হবে।’ বউ, দুই ছেলে, ভৃত্য সবসুদ্ধু ৩১ জনকে সঙ্গে নিয়ে দিল্লির রাস্তা ধরে এগিয়ে গেল পাল্কি ও মোষের গাড়ি। পাহারায় কোম্পানির ৯ নম্বর ল্যান্সারবাহিনী। একদা পানিপথের যুদ্ধে জিতে তাঁর পূর্বপুরুষ বাবর তৈরি করেছিলেন মুঘল সাম্রাজ্য। ৩৩২ বছর পরে সেই ইতিহাস ছেড়ে ভোর হওয়ার আগেই বেরিয়ে যেতে হল তাঁকে।

ইলাহাবাদে পৌঁছানোর পর ওমনিকে বড়লাট ক্যানিং জানালেন, বন্দিদের নিয়ে যেতে হবে রেঙ্গুন! পুরো ব্যাপারে গোপনীয়তা এতটাই! তত দিনে দিল্লি থেকে বেরোনো ৩১ জনের অনেকে খসে পড়েছে, ইলাহাবাদ থেকে ‘টেম্স’ নামের স্টিমারে উঠলেন বাদশাহ-সহ ১৫ জন। ৪ ডিসেম্বর স্টিমার পৌঁছাল কলকাতার কাছে... ডায়মন্ড হারবার।

২৫ বছর আগে খুঁজে পাওয়া সেই কবর এ ভাবেই আজ সুসজ্জিত।

স্টিমার বদলে বন্দিদের তোলা হল ‘এইচ এম এস মগারা’ জাহাজে। সঙ্গী দুই শাহজাদা জওয়ান বখ্ত ও শাহ আব্বাস জাহাজের ডেকে উঠেই চুরুট চাইলেন, সম্রাট চলে গেলেন নীচে। সেখানে তাঁর বিছানা, তাকিয়া পেতে দেওয়া হল। জানালা দিয়ে নদীতে তাকিয়ে তিনি। দিল্লি থেকে আসার পথে কানপুরে প্রথম রেলগাড়ি দেখেছেন। জেলার ওমনি সাহেবকে সে দিন বলেছিলেন, ‘আচ্ছা, সমুদ্রে জাহাজ কী ভাবে যায়? আমার খুব জাহাজে চড়তে ইচ্ছে করে।’

জাহাজেই এ বার রেঙ্গুন। ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় ছোট ছোট ৪টি ঘর। একটায় সম্রাট, অন্যটিতে বেগম জিনাত মহল, আর বাকি দুটোয় সস্ত্রীক দুই ছেলে। দিনের বেলায় মাস্কেট হাতে দু জন পাহারাদার, রাতে তিন জন। জাফরকে কাগজ-কলম দেওয়াও নিষিদ্ধ। তাঁর বড় ছেলে জওয়ান বখ্ত মাতাল, মদের টাকার জন্য মাকেও মাঝে মাঝে মারধোর করেন। বিষণ্ণ বৃদ্ধ গড়গড়ার নল মুখে দিয়ে শুয়ে থাকেন, রেঙ্গুন নদী বেয়ে ছুটে আসে হাওয়া।

কামালউদ্দিন জানালেন, নদী এখন মাজার থেকে দেখা যায় না। সামনে অনেক বহুতল, নতুন রাস্তা। সবই কি কফিনবন্দি শরীরের মতো এক দিন ধুলোয় মিশে যাবে? বন্দি দশাতেই তো লিখেছিলেন তিনি, ‘এই জীবনে আর আলোর রেখা নেই/ কারও হৃদয়ে শান্তি হয়ে ঝরব না/ ধুলো থেকে এ বার ফের মিশে যাব ধুলোয়।’

সবই ধুলো? মাজার থেকে বেরিয়ে ছবিগুলি মেল করেছিলাম উইলিয়াম ডালরিম্পলকে। বাহাদুর শাহের শেষ জীবন, কবর-রহস্য অনেক কিছুই তিনি জানিয়েছিলেন তাঁর ‘দ্য লাস্ট মুঘল’ বইয়ে। কিন্তু একুশ শতকের শুরুতে তিনি যখন এসেছিলেন, মাজার ছিল না সাজানোগোছানো। কয়েক ঘণ্টা পরেই সাইবারস্পেসে পৌঁছে গেল তাঁর স্মাইলি: ‘চমৎকার সাজিয়েছে! তবে জন্মসালটা ভুল লিখেছে। ১৭৭৫ হবে। ভাল লাগল জাফরের ছবি। আমার বইয়ের প্রচ্ছদ ওটাই ছিল যে!’

ধুলো শোয়ে ডাগন প্যাগোডার রাস্তায়, মাজারের সামনের মাঠেও। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে মায়ানমার যখন জাপানি সেনার অধিকারে, ওই মাঠেই তাঁবু ফেলেছিল আজাদ হিন্দ ফৌজের মেয়েদের ‘ঝাঁসির রানি’ ব্রিগেড।

এত কিছু নিয়ে তাঁর সমাধি আজ অটুট। ধুলো থেকে ধুলোয় মিশে যাননি, প্রতিবেশী দেশে শেষ মুঘল সম্রাট আজ সুফি সাধকে রূপান্তরিত।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE