বাগবাজারে নন্দলালের বাড়ি
একবার ক্লাসে জন্তু-জানোয়ার বিষয়ে ছবি আঁকতে হবে। ভাবতে গিয়ে বুঝলাম, গরুই আমার কাছে সবচেয়ে সহজ বিষয়। বিকেলের দিকে মাস্টারমশাইয়ের কাছে গিয়ে বললাম, গরুকে বিষয় করে পট গড়ব। মাস্টারমশাই সব শুনে বললেন, ‘একটি গরু আঁকো।’ খুব যত্ন করে আঁকলাম। সেটি মাস্টারমশাই নিজের কাছে রেখে বললেন, ‘যাও, ভাল করে গরু দেখে এসো।’ পাশের সাঁওতাল পাড়ায় গিয়ে খুব ভাল করে গরু দেখলাম ও আঁকলাম। তার পরে আমার স্কেচ সামনে নিয়ে বললেন, ‘দেখো তো, তোমার আগের আঁকা গরুটি কী রকম হয়েছে?’ আগের ড্রয়িংটি দেখে বিশ্বাসই করতে পারছিলাম না, গরু সম্পর্কে আমার এমন ধারণা ছিল!
একবার তাঁর ব্যবহার করা পোস্টকার্ড, পেনসিল রাখার চামড়ার ব্যাগ জীর্ণ হয়ে যাওয়ায় নতুন একটা ব্যাগ তৈরি করে দিয়েছিলাম। তিনি সেটি উল্টে-পাল্টে দেখে বললেন, ‘বেশ হয়েছে। তবে এটা তোমার কাছেই থাক।’ মন তো খারাপ হলই, কিন্তু কিছু বলতে পারলাম না। একদিন মাস্টারমশাই তাঁর পুরনো পোস্টকার্ড, পেনসিল ইত্যাদি রাখার ব্যাগ আমার হাতে তুলে দিয়ে বললেন, একটু গুছিয়ে দিতে। অতি আনন্দে যত্ন সহকারে গুছিয়ে দেওয়ার সময়ে দেখলাম, ব্যাগের মাথার কাছে সামান্য কাটা। যার মাঝ দিয়ে আঙুল ঢোকাতেই একটা শক্ত কাগজের টুকরো আছে বলে মনে হওয়ায় সেটি টেনে বার করে দেখি, শ্রীরামকৃষ্ণ, সারদা মা আর স্বামীজির ছবি। বুঝলাম, এই কারণেই আমার তৈরি করা নতুন ব্যাগটি তিনি নেননি। বেলুড় মঠ থেকে শান্তিনিকেতন আশ্রমে কার্যকারণে রবীন্দ্রনাথের কাছে কেউ এলে, তিনি সন্ন্যাসীদের দেখাশোনার ভার সব সময়ে নন্দলালের উপরে দিতেন। মাস্টারমশাইয়ের ঘরে খাটের কাছে একটি কুলুঙ্গিতে মা-ঠাকুর ও স্বামীজির ছবি থাকত। সেখানে তিনি নিত্য ফুল দিতেন। তাঁর কাছে ছবি আঁকাটাও ছিল পুজোর মতো। সব গোছানো থাকত। পাত্রের জলে একটা ফুল দিতেন। ধূপ জ্বালতেন। তার পরে শুরু হত আঁকা।
অবনীন্দ্রনাথের সঙ্গে আলাপ যেন মণিকাঞ্চন যোগ
মাস্টারমশাইয়ের বাল্যকাল কেটেছিল খড়্গপুরে। তাঁর প্রাথমিক শিক্ষা সেখানেই। কলকাতায় এসে সেন্ট্রাল কলেজিয়েট স্কুলে ভর্তি হন। প্রথাগত শিক্ষা কোনও দিনই ভাল লাগত না। ছোট থেকেই শিল্পের প্রতি অনুরক্ত। খড়্গপুরে শিল্পীদের প্রতিমা নির্মাণ বুঁদ হয়ে দেখতেন। তার পরে কাদামাটি দিয়ে দেবদেবীর মূর্তি গড়তেন। কলকাতায় এসেই নন্দলালের সঙ্গে প্রথম পরিচয় অবনীন্দ্রনাথের ছবির এবং সেই ছাপানো ছবি দেখে মুগ্ধ হন। যেন সন্ধান পেলেন জীবনের লক্ষ্যপথের।
পরের অধ্যায় কলকাতা সরকারি আর্ট স্কুল, সেখানে ভর্তি হওয়া এবং অবনীন্দ্রনাথের সঙ্গে নন্দলালের আলাপ। মণি-কাঞ্চন যোগ। তাঁদের সম্পর্ক কোনও দিনই শুধু শিক্ষক-ছাত্রের ছিল না। বলা ভাল, গুরু-শিষ্যের সম্পর্ক। অবনীন্দ্রনাথের সঙ্গ তিনি সব সময় পেতেন। আত্মীয়ের মতো, বন্ধুর মতো। নন্দলালদের মৌলিক ছবি আঁকায় উৎসাহ দিতেন অবনীন্দ্রনাথ। ক্লাসে বসে মজার গল্প বলতেন, যেন আড্ডা। আসলে তিনি যে শেখাচ্ছেন, তা যেন ছাত্ররা ধরতে না পারে।
অবনীন্দ্রনাথের সূত্রেই ভগিনী নিবেদিতার সঙ্গে পরিচয় নন্দলালের। তার পরে আর মাত্র পাঁচ বছর বেঁচেছিলেন নিবেদিতা। কিন্তু ওই অল্প সময়ের সান্নিধ্যই নন্দলালের শিল্পচেতনাকে সমৃদ্ধ করেছিল প্রভূত ভাবে। তাঁর যে অজন্তা যাত্রা, তা কিন্তু অবনীন্দ্রনাথ আর নিবেদিতার জোরাজুরিতেই। ১৯০৯-এ ভারতে আসেন লেডি হ্যারিংহাম, অজন্তা গুহার ভিত্তিচিত্রের অনুলিপি তৈরির জন্য। নন্দলাল, অসিতকুমার হালদার, সমরেন্দ্র গুপ্ত প্রমুখ হ্যারিংহামের সঙ্গে অজন্তায় যান। সেখানে তাঁরা তিন মাস ছিলেন। নন্দলালের আঁকা ছবিগুলির মধ্যে সপ্তদশ গুহার ‘মাদার অ্যান্ড চাইল্ড অ্যাডোরিং দি বুদ্ধ’ সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য। ক্লাসিক্যাল চিত্রকলার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা ও পরীক্ষানিরীক্ষার যে প্রথম সুযোগ নন্দলাল প্রমুখ শিল্পীরা পান, তার মূলে কিন্তু নিবেদিতা। পরবর্তী সময়ে বাগগুহাও গিয়েছিলেন তিনি এবং এই সূত্রেই অজন্তা আর বাগের ধ্রুপদী রীতির সঙ্গে একাত্ম হওয়ার সুযোগ হয় নন্দলালের। নিজের হাতে গড়া এই অসামান্য শিল্পী ও তাঁর সতীর্থদের চিত্রকলায় ধ্রুপদী ওই দ্যোতনা দেখে অবনীন্দ্রনাথ বলেছিলেন (স্মৃতিচিত্র: প্রতিমা দেবী), ‘‘ওরা নিল অজন্তার দিক, আমি রইলুম পার্সিয়ানে।’’