Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪

সাংবাদিক, লেখকের পাশাপাশি ছিলেন এক জন অসাধারণ শিক্ষকও

তিনি সুবিখ্যাত সাংবাদিক, লেখক... কিন্তু এইটুকুই তাঁর পরিচয় নয়। মেজাজি এই মানুষটি একজন অসাধারণ শিক্ষকও। সন্তোষকুমার ঘোষ! তাঁর সঙ্গে কাজ করার অবিস্মরণীয় অভিজ্ঞতার কথা শোনালেন দেবাশিস ভট্টাচার্য তিনি সুবিখ্যাত সাংবাদিক, লেখক... কিন্তু এইটুকুই তাঁর পরিচয় নয়। মেজাজি এই মানুষটি একজন অসাধারণ শিক্ষকও। সন্তোষকুমার ঘোষ! তাঁর সঙ্গে কাজ করার অবিস্মরণীয় অভিজ্ঞতার কথা শোনালেন দেবাশিস ভট্টাচার্য

সন্তোষকুমার ঘোষ

সন্তোষকুমার ঘোষ

দেবাশিস ভট্টাচার্য
শেষ আপডেট: ৩০ জুলাই ২০১৭ ১০:৫০
Share: Save:

তিনি লিখেছিলেন, ভোরবেলা কোনও সময় নয়। একটি ঘটনা। টুপ করে আসে, টুপ করে মিলিয়ে যায়। আমার কাছে তিনিও ঘটনার মতো, টুপ করে এসে টুপ করে মিলিয়ে যাওয়া। মাত্র পাঁচ বছর। তাও খুব নিত্য-নিয়মিত নয়। সেইটুকুতেই জাগায় দখিন হাওয়া! আনন্দবাজার পত্রিকায় আমার চাকরির শৈশবে পাওয়া তাঁর সান্নিধ্য এখন এই শেষবেলাতেও এক উষ্ণ অনুভূতি।

এখনকার মতো তখনও শিক্ষানবিশ সাংবাদিক নিয়োগের লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলে মুখোমুখি অর্থাৎ ইন্টারভিউতে ডাকা হত। সেই ইন্টারভিউ বোর্ডে প্রথম সন্তোষকুমার ঘোষকে চাক্ষুষ করলাম। বড় ঘরে টেব্‌লের ও পারে সারিবদ্ধ বসে অভীক সরকার, সন্তোষবাবু, গৌরকিশোর ঘোষ, বরুণ সেনগুপ্ত, নিখিল সরকার, অরুণ বাগচী প্রমুখ। এ পারে একটি চেয়ারে চাকরিপ্রার্থী। তার দিন কয়েক আগে আকাশবাণীর সংবাদ সমীক্ষায় আমার লেখা একটি নিবন্ধ প্রচারিত হয়েছিল। সন্তোষবাবু জানতে চাইলেন, ‘‘আপনি কি সেই জন?’’ উনি রেডিয়ো শুনে নিতান্ত পরিচয়হীন এক লেখকের নামটি পর্যন্ত মনে রেখেছেন! আমার তো বিস্ময়ে হতবাক অবস্থা।

রংমহল থিয়েটারে সুভাষ মুখোপাধ্যায়, সন্তোষকুমার ঘোষ ও সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় (বাঁ দিক থেকে)

রিপোর্টার হয়ে কাজ শুরু করার সপ্তাহ দুয়েক পরে প্রথম সন্তোষদার কাছাকাছি যাওয়ার সুযোগ হল। তিনি তখন যুগ্ম সম্পাদক। ঘর ছিল নিউজ রুমের লাগোয়া। মাঝে কাঠের পার্টিশন। আসা-যাওয়ার পথে হয়তো দেখতে পেতাম তাঁকে, ঢুকছেন বা বেরোচ্ছেন। ঘরে ডাক পড়ল এক স্মরণীয় দিনে। ১৯৮০-র ১৬ ফেব্রুয়ারি। পূর্ণগ্রাস সূর্যগ্রহণ। রটনা হয়েছিল, পৃথিবী নাকি ধ্বংস হয়ে যাবে! সে এক বিচিত্র পরিস্থিতি। ধ্বংসের ‘প্রতীক্ষায়’ গোটা কলকাতা সেদিন ঘরবন্দি। রাস্তাঘাটের হাল দেখে মনে হবে যেন কার্ফু চলছে। ‘ধ্বংসের’ আগে ভরদুপুরে ঘরে সপরিবার বসে টিভি-তে সিনেমা দেখার ব্যবস্থা করে দিয়েছে দূরদর্শন। বাঙালিকে পায় কে! দুপুরবেলায় সত্যিই রাতের মতো ঘন আঁধার নেমে এল। কেমন যেন থমথমে আতঙ্ক। স্বাভাবিক ভাবেই সে দিন এটা সবচেয়ে বড় খবর। আমার উপর দায়িত্ব পড়ল বিশিষ্ট কয়েক জনের সঙ্গে কথা বলে তাঁদের প্রতিক্রিয়া নেওয়ার। জ্যোতি বসু, সত্যজিৎ রায় থেকে শুরু করে অনেকের সঙ্গেই কথা বলে একটি রিপোর্ট লিখলাম। সিনিয়ররা বিভিন্ন ধরনের আরও অনেক রিপোর্ট লিখলেন। সন্ধেবেলা আমাদের চিফ অফ ব্যুরো সুনীল বসু ডেকে বললেন, ‘আজ গ্রহণের সব রিপোর্ট সন্তোষ নিজে দেখবে। যে কোনও সময় ডাকতে পারে।’

দিল্লিতে ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের হাত থেকে আকাদেমি অ্যাওয়ার্ড নিচ্ছেন

ডাকলেন। সিনিয়রদের কাছে শুনেছিলাম, উনি খুব মেজাজি। লেখা ভুলভাল হলে রক্ষা নেই! মারতেও পারেন। ভয়ে ভয়ে ঘরে ঢুকতেই সন্তোষদা চোখ সরু করে আপাদমস্তক মাপলেন। তার পর প্রশ্ন, ‘‘তুমি কি কমিউনিস্ট?’’ কোনও দিন ছাত্র রাজনীতিও করিনি। হঠাৎ এমন একটি প্রশ্নে কী উত্তর দেব! কোনও রকমে ঘাড় নেড়ে ‘না’ বলতেই তিনি বললেন, ‘‘তা হলে ‘অবাক পৃথিবী’, ‘সেলাম’ এ সব লিখেছ কেন?’’ রিপোর্টে ‘অবাক পৃথিবী সেলাম জানাচ্ছে’ গোছের একটা বাক্য লিখেছি ঠিকই, কিন্তু তার জন্য আমাকে কমিউনিস্ট হতে হবে কেন, সেটা তখনও বুঝতে পারছি না। দাঁড়িয়ে ঘামছি। সন্তোষদা নিজেই উদ্ধার করলেন। হেসে বললেন, ‘‘ওই যে সুকান্তের লাইন লিখেছ, তাতেই ভাবলাম হয়তো কমিউনিস্ট! এখনকার কলেজ-ইউনিভার্সিটিতে পড়েছ তো তাই...’’ এবং বললেন, ‘‘আমি কিন্তু লাইনটা কাটছি না। বেশ লিখেছ। শুধু একটু মজা করলাম তোমার সঙ্গে।’’ নিজেই কপির উপরে হেডিং লিখে দিলেন, ‘গ্রহণকে গ্রহণ, নানা চোখে’। বললেন, ‘‘যাও, জমা করে দাও। পরে তোমার সঙ্গে কাজ আছে। অন্য দিন।’’এর পর থেকে তাঁর ডিকটেশন নিতে প্রায়ই আমার ডাক পড়ত। কারণ তখন তাঁর হাত কাঁপে। তিনি বলে যেতেন, আমি লিখতাম। কখনও কাগজের সম্পাদকীয়, কখনও গল্প-উপন্যাস। ফলে সাংবাদিক ও সাহিত্যিক দুই সন্তোষ ঘোষেরই কিছু সৃষ্টির আমি সাক্ষী।

যেটুকু দেখেছি, লেখার শুরুটা নিয়ে বড় খুঁতখুঁতুনি ছিল তাঁর। প্রথম বাক্য বা প্রথম অনুচ্ছেদ লিখতে বেশ কিছুটা সময় যেত। এমন বহু বার হয়েছে, দু’-একটি বাক্য বলার পর পছন্দ হয়নি। টেব্‌লের বিপরীত দিক থেকে হাত বাড়িয়ে আমার সামনে রাখা লেখার প্যাডের পাতা নিজেই ছিঁড়ে দিয়েছেন। চোখমুখ কুঁচকে বলেছেন, ‘‘হচ্ছে না এটা। আবার লেখো।’’ সেই সময় তাঁর হাতের পাশে কাচের গ্লাসে তরল থাকত। মাঝে মাঝে পেনবাম জাতীয় কিছু আঙুলে তুলে কপালে লাগাতে দেখতাম। সব মিলিয়ে একটা অদ্ভুত গন্ধবলয় তৈরি হত ছোট ঘরটিতে। লেখার ফাঁকে ছোট ছোট মজাও ছিল। একবার পুজো সংখ্যার জন্য লিখছেন। উনি বলে যাচ্ছেন, টুকে নিচ্ছি। হঠাৎ থেমে গিয়ে বললেন, ‘‘নাহ! কিছুই মনে পড়ছে না। এই ছেলেটার একটা নাম দিতে হবে তো? কী নাম দেব? আচ্ছা, তোমার নামটাই লিখে দাও। আর তুমি যে জামাটা পরে আছ, সেই জামাটাই ওকে পরিয়ে দাও! ’’

সাহিত্য রচনা এবং খবরের কাগজের দৈনন্দিন লেখা দুয়ের চলনে যে তফাত, সন্তোষবাবুর লেখনী তার স্মরণীয় উদাহরণ। মূলত গদ্য লিখেছেন তিনি। কবিতা খুব কম। যদিও ছাপার অক্ষরে তাঁর প্রথম লেখাটি কবিতা। নাম ‘পৃথিবী’। প্রকাশিত হয় প্রেমেন্দ্র মিত্র সম্পাদিত ‘নবশক্তি’ পত্রিকায়। ১৯৩৭। সন্তোষকুমার তখন ১৭। ‘কবিতার প্রায়’ নামে একটিই কাব্যগ্রন্থ আছে তাঁর। আর আছে দুটি নাটক ‘অজাতক’, ‘অপার্থিব’।

আনন্দ পুরস্কারের অনুষ্ঠানে সুচিত্রা মিত্রের সঙ্গে

১৯৫১-তে আনন্দবাজার প্রতিষ্ঠানের ইংরেজি দৈনিক হিন্দুস্থান স্ট্যান্ডার্ডে যোগ দিয়ে তিনি দিল্লি চলে যান। বয়স ৩১। তার আগেই তিনি লিখে ফেলেছেন প্রথম উপন্যাস ‘কিনু গোয়ালার গলি’। প্রত্যহ, মর্নিং নিউজ, দ্য নেশন, যুগান্তর ও স্টেটসম্যান-এ চাকরি করাও হয়ে গিয়েছে তাঁর। দিল্লি থেকে আনন্দবাজার পত্রিকায় বদলি হয়ে কলকাতায় আসেন ১৯৫৮ –তে। বাংলা সাংবাদিকতায় তার পর থেকে এক নতুন ধারার জন্ম হল বললে ভুল হবে না। আনন্দবাজার পত্রিকার প্রথিতযশা সাংবাদিকদের অনেকেই সন্তোষবাবুর প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে কাজ করে উঠে এসেছেন। সাংবাদিকতায় সাধুভাষার বদলে চলিত ভাষা চালু করাতেও সন্তোষবাবুর অবদান অনস্বীকার্য। সাংবাদিকতার কাজ করতে করতেই লিখলেন ‘রেণু তোমার মন’, ‘মুখের রেখা’, ‘নানারঙের দিন’, ‘স্বয়ং নায়ক’, ‘জল দাও’ ইত্যাদি উপন্যাস এবং সর্বোপরি ‘শেষ নমস্কার: শ্রীচরণেষু মাকে’। সাহিত্যিক সন্তোষকুমার একাধিক বার আনন্দ পুরস্কারে সম্মানিত। পেয়েছেন আকাদেমি পুরস্কারও।

ভাষা ব্যবহারের ক্ষেত্রে তাঁর বাছবিচার ছিল খুব। কোনও লঘু বা চটুল শব্দ চট করে লিখতেন না। একবার আনন্দবাজারে একটি খবরের শিরোনামে ‘হাড্ডাহাড্ডি’ লেখা হয়েছিল। যত দূর মনে পড়ে, সেই সময় নিউজ ডেস্কে কর্মরত এক বিশিষ্ট লেখক ওই শব্দটি লিখেছিলেন। সন্তোষদা সারা দিন খোঁজ করেছেন, ওই লেখক কখন আসবেন। তার পর রাতের ডিউটিতে তিনি আসার পর তাঁকে ডেকে নিয়ে বলেছেন, ‘হাড্ডাহাড্ডি’ শব্দটা লেখা ঠিক হয়নি। অন্য কিছু লেখা উচিত ছিল।

সন্তোষদা’র অসন্তোষ নাকি বিষম বস্তু! চাকরিতে ঢুকে সিনিয়রদের কাছে এমনটাই শুনতাম। আমি অবশ্য তাঁর রাগের ভাগ পাইনি। তবে একবার একটি নিতান্ত মামুলি ঘটনায় তাঁর বিরক্তির যে প্রকাশ দেখেছিলাম, তা অনবদ্য। ছবিটা মনে গেঁথে আছে। অফিসে তখনও লিফটম্যানেরা লিফ্‌ট চালাতেন। প্রবীণ মানিকবাবু ছিলেন তাঁদের একজন। তেল চকচকে টাক, গোলগাল ভারিক্কি চেহারা। একবার চারতলায় উঠলে একতলায় নামতে তাঁর বিস্তর সময় লাগত। কারণ মাঝপথে অনেক কিছু করার ও বলার থাকত তাঁর। আমরা বলতাম, মানিকবাবুর লেকচার-ট্যুর। তেমনই একদিন লিফটের সামনে দাঁড়িয়ে ঈষৎ অসংলগ্ন সন্তোষবাবু। উপর থেকে লিফ্‌ট নামছে না। ততক্ষণে তাঁর পিছনে আরও কয়েক জন দাঁড়িয়ে। সেই লাইনে আমিও। লিফ্‌ট নামল যখন, সন্তোষদা তখন রেগে আগুন। মানিকবাবুকে বললেন, ‘‘তোমার কাজ মানুষকে উপরে তোলা। কিন্তু তুমি অতি হীন। আমি তোমার পিতাকে অসম্মান করব না। তবে তোমার ছেলেমেয়েরা যে ...র বাচ্চা তাতে কোনও সন্দেহ নেই।’’ সব শুনে এ বার মানিকবাবু বললেন, ‘‘আপনার বলা হয়ে গিয়েছে? তা হলে উঠুন। পিছনে অনেক লোক জমে গিয়েছে।’’ সন্তোষবাবুও ছাড়ার পাত্র নন। বললেন, ‘‘আমার ক্ষমতা থাকলে হেঁটে উঠতাম। তোমার সঙ্গে যেতাম না। কিন্তু আমি তা পারব না। তাই প্রতিবাদ করে উঠছি।’’ নির্বিকার মানিকবাবু চারতলায় লিফ্‌ট থামালেন। বললেন, ‘‘ঘর পর্যন্ত এগিয়ে দেব?’’ পরম মমতায় তাঁর কাঁধে হাত রেখে সন্তোষ ঘোষ লিফট থেকে নামলেন। হেসে মানিকবাবু বললেন, ‘‘এত রাগ করেন কেন?’’ দু’হাতে তাঁকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন সন্তোষদা।

সন্তোষকুমারের রবীন্দ্র-প্রজ্ঞা ও রবীন্দ্র-প্রীতি অনেকেরই জানা। সন্তানদের মধ্যেও সেই ভাবনা জারিত করেছেন তিনি। পিতৃস্মৃতি রোমন্থনে তিন কন্যার কনিষ্ঠা কাকলি বললেন, ‘‘আমরা কে কোন ক্লাসে পড়তাম, সেটা বাবা সঠিক বলতে পারতেন না। তিনি বিভোর থাকতেন তাঁর নিজস্ব কাজের জগতে। কিন্তু আমাদের সাহিত্যপাঠে বরাবর উৎসাহ জুগিয়েছেন। নিজের সংগ্রহে থাকা বিপুল ভাণ্ডার থেকে বই বের করে দিয়েছেন পড়ার জন্য। কোন বয়সে আমরা কে কোন গান গাইব, তা-ও ঠিক করে দিতেন বাবা। বড়দি কথাকলি যখন ‘এসো নীপবনে’ গাইবেন, মেজ কৃষ্ণকলির জন্য তখন ‘মধ্যদিনে যবে গান’, আমার ভাগে ‘চাঁদের হাসি বাঁধ ভেঙেছে’। ’’ তাঁদের বাড়িতে শুধু রবীন্দ্রসঙ্গীতই শোনা হত। সুচিত্রা-কণিকা-হেমন্ত তাঁদের ভবানীপুরের বাড়িতে এসে গান শোনাচ্ছেন, শম্ভু মিত্র বসে আবৃত্তি করছেন এমন স্মৃতিও আছে কাকলির। এমনকী দেবব্রত বিশ্বাসকেও ভবানীপুরের বাড়িতে গান গাইতে দেখেছেন কাকলি। তখনও অবশ্য সন্তোষ ও দেবব্রতের মধ্যে ব্রাত্যজন-বিতর্ক তৈরি হয়নি।

পড়া ধরাও ছিল তাঁর শেখানোর আর এক প্রক্রিয়া। বাড়ির সকলকে নিয়ে মাঝে মাঝেই লং ড্রাইভে বেরিয়ে পড়তেন সন্তোষবাবু। রাঁচি, হাজারিবাগ, পুরী গাড়ি নিয়ে ঘুরে আসা। কাকলি বলছিলেন, ‘‘গাড়িতে যেতে যেতে বাবা নানা বিষয়ে প্রশ্ন করতেন। বলতে না পারলেই বকুনি।’’ সেটা এড়াতে তাই জানার পরিধিটা বাড়িয়ে নিতেই হত।

সাংসারিক বিষয়ে চরম উদাসীন সন্তোষবাবুর স্ত্রী নীহারিকা দেবী সংসারের যাবতীয় দায়িত্ব সামলাতেন। সন্তোষ-তনয়ার কথায়, ‘‘বাবাকে জীবনে বাজার করতেও দেখিনি।’’ অথচ বাড়িতে অবিরাম লোকজন আসা লেগেই থাকত। অনেকে হয়তো সকালে এসে দুপুরে সন্তোষবাবুর সঙ্গেই খেয়েদেয়ে তাঁর গাড়িতে অফিস চলে যেতেন। কাকলি বলেছেন, ‘‘মা তো আগে আন্দাজ করতেই পারতেন না, আজ কত জন খাবেন। ফলে সেই ভাবে তাঁকে ব্যবস্থা রাখতে হত।’’ মেয়ে জানিয়েছেন, সন্তোষবাবুর নিজের খাওয়াদাওয়া ছিল সাদামাঠা। তবে বেশি পছন্দের ছিল ময়দার লুচি।

পোশাকআসাকের ক্ষেত্রে অবশ্য তেমন ঢিলেঢালা ছিলেন না তিনি। ভাল সুগন্ধিরও চর্চা ছিল। একবার কাকলির জন্মদিনের সন্ধেয় বাড়িতে বন্ধুদের ডাকা হয়েছে। সে দিন মেরুন একটি শার্ট পরে অফিসে বেরোচ্ছেন সন্তোষবাবু। মেয়ে বললেন, ‘‘আজ আমরা বন্ধুরা আসবে, আর তুমি এমন রঙের জামা পরলে!’’ সন্তোষবাবু তবু জামা বদল করতে রাজি নন। সন্ধেয় বাবা যখন ফিরলেন, মেয়ে দেখলেন মেরুন জামার বদলে তাঁর পরনে অফ হোয়াইট শার্ট! প্রশ্রয়? অপার স্নেহ? না কি স্টাইল স্টেটমেন্ট? হয়তো সব কিছুর এমনই এক নীরব প্রকাশ।

ডিকটেশন নেওয়ার সুবাদে সন্তোষবাবুর ঘরে যাতায়াত তখন কিছুটা বেড়েছে। একদিন রাতের ডিউটিতে অফিসে ঢুকেই তাঁর ডাক পেয়েছি। গিয়ে দেখি, একটু টলমলে অবস্থা। তাঁর ঘরের সহকারী গুণধরদা ফিসফিস করে বললেন, ‘‘কথা শুনছেন না। সেই থেকে...’’ সামনে যেতেই ধমক, ‘‘কী করো! কোথায় ছিলে?’’ জানালাম নাইট ডিউটি। তিনি আরও রেগে বললেন, ‘‘তুমি কি জানো, তুমি মূর্খ? তোমরা সবাই মূর্খ। আমি তোমাদের শেখাতে পারি। কিন্তু শেখাব না।’’ সাহস করে বলে ফেললাম, কেন শেখাবেন না? রাগ গলে জল! শিশুর সারল্যে সন্তোষদা নাগাড়ে বলে চললেন,‘‘তা হলে এই ঘরে আসবে। বসবে। শিখে নেবে। রবীন্দ্রনাথ পড়েছ? বলো তো, তৃপ্তি কখন অতৃপ্তি হয়? মুক্তি কখন বন্ধনডোর হয়? বিয়ে তো করোনি। নারীসম্পর্ক? কী করে বুঝবে প্রেম, পূজা, প্রভু, প্রিয় সব একাকার! ’’

লেখায় মগ্ন সাংবাদিক সন্তোষকুমার

আরও এক রাতে তাঁর লেখা লিখছি। হঠাৎ কারও ফোন এল। তিনি প্রায় আর্তনাদ করে উঠলেন, ‘‘সে কী! কখন? আমাকে কেউ বলেনি!’’ তার পর ফোন নামিয়েই পাগলের মতো বলতে লাগলেন, ‘‘হেমন্তর কী হয়েছে? ও কেমন আছে? আমাকে এখুনি বলো।’’ নিউজরুমে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় সম্পর্কে কোনও দুঃসংবাদ আসেনি। সে কথা সন্তোষদাকে বোঝাবে কে? তাঁর ধারণা হল, তাঁর ছোটবেলার বন্ধু হেমন্ত সম্পর্কে খারাপ খবর তাঁকে জানানো হচ্ছে না। অতএব একের পর এক ফোন ঘোরাতে লাগলেন সুচিত্রা মিত্র, বাণী ঠাকুর, দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়দের। অবশেষে নিশ্চিন্ত হয়ে লেখায় ফেরার আগে অবাক করে বললেন, ‘‘কে আমাকে ফোন করেছিল, বলো তো? তার নামটাই তো জানা হল না! তার মানে নিশ্চয়ই কেউ দুষ্টুমি করেছে। আসলে সুভাষ (মুখোপাধ্যায়), হেমন্ত, আমি খুব বন্ধু যে! ’’ কার ফোন ছিল, তা জানার কোনও উপায় আর নেই। তবে সন্তোষ ঘোষের কোমল মনের সেই ছবিটি ভোলার নয়।

এই হেমন্তকেই নিজের মেয়ের বিয়ের নিমন্ত্রণ করতে অবশ্য ‘ভুলে’ গিয়েছিলেন সন্তোষদা। তখন তিনি থাকেন ভবানীপুরে পূর্ণ সিনেমার কাছে আশুতোষ মুখার্জি রোডে। বড় মেয়ের বিয়ে হল। বাড়িতে প্যান্ডেল বেঁধে ঘটা করে লোকজন, বন্ধুবান্ধব নিয়ে খাওয়াদাওয়া হল। বউভাতের দিন সকালে যখন মেয়ের বাড়ির প্যান্ডেল খোলা হচ্ছে, তখন স্বয়ং হেমন্ত মুখোপাধ্যায় হাজির! সন্তোষবাবুর মেয়ে কাকলি বলেন, ‘‘সে এক অস্বস্তিকর পরিস্থিতি। সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে হেমন্তবাবু বলছেন, কী ব্যাপার? কীসের প্যান্ডেল? আমি তো কিছু জানতেই পারলাম না! ’’ ঘরের ভিতরে সন্তোষবাবু রীতিমত অপ্রস্তুত। হেমন্ত এসেছিলেন তাঁর ছেলের বিয়ের আমন্ত্রণ জানাতে।

রসিকতার ছলে এক বিশিষ্ট ব্যক্তিকে আবার নিদারুণ বিপাকে ফেলে দিয়েছিলেন সন্তোষবাবু। সে ঘটনা গৌরকিশোর ঘোষের কাছে শোনা। অফিসের কাজ সেরে গভীর রাতে সন্তোষবাবু যখন বেরোতেন, তাঁর সঙ্গে গৌরদা, বরুণদা, অমিতাভ চৌধুরীরা কয়েক জন থাকতেন। একটিই গাড়ি ঘুরতে ঘুরতে এক-এক দিকে এক-এক জনকে নামাত। সারা পথ জুড়ে চলত নানা রকম আড্ডা, খুনসুটি। একবার তেমনই এক রাতে গৌরকিশোরকে সঙ্গে নিয়ে সন্তোষবাবু পৌঁছলেন পাইকপাড়ায় লেখক নরেন্দ্রনাথ মিত্রের দরজায়। শীতের রাত। দুয়ার এঁটে গোটা পাড়া ঘুমিয়ে। নরেনবাবুর দরজায় ধাক্কা দিয়ে সন্তোষবাবু হিন্দি টানে জানালেন, তাঁরা থানা থেকে আসছেন। কোনও বইতে নরেনবাবু ‘অশ্লীল’ কিছু লিখেছেন। তাই তাঁর নামে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হয়েছে। দরজা খুলবেন কী, রাত দেড়টা-দুটোয় এমন ‘পুলিশি’ তলবে সুভদ্র নরেন মিত্রের তখন প্রায় হার্ট অ্যাটাকের দশা! শেষ পর্যন্ত গৌরদা পরিচয় দিয়ে বললেন, ‘‘ভয় পাবেন না। আমরা এসেছি।’’ তার পর লুচি-বেগুনভাজায় সমাপয়েৎ। ওই রাতে সন্তোষবাবুর আবদারে নরেনবাবুর স্ত্রী লুচি ভাজতে বসেন।

বাংলা প্রিন্টিং ও পাবলিশিংয়ের ২০০ বছর উপলক্ষে এক অনুষ্ঠানে সুকুমার সেন, সত্যজিৎ রায়, সাগরময় ঘোষ প্রমুখের সঙ্গে সন্তোষকুমার

জীবনবোধ কতটা গভীর ও নিখাদ হলে এমন করা যায়, তা বোঝা খুব কঠিন নয়। এমন অনেক ছেলেমানুষি মজার রসদ যাঁর ভাঁড়ারে, তিনিই একদিন লেখার ডিকটেশন দিতে দিতে হঠাৎ থেমে বলেছিলেন, ‘‘অশান্তি, অশান্তি... অশান্তি যে আঘাত করে, তাই তো বীণা বাজে।’’

প্রশ্ন করার ঔদ্ধত্য ছিল না। কেন বলেছিলেন, তাও জানি না। মাত্র ৬৫ বছর বয়সে ১৯৮৫-র ২৬ ফেব্রুয়ারি মারা যান তিনি। তার ঠিক দু’দিন আগে ২৪ ফেব্রুয়ারি নার্সিংহোম থেকে বেরিয়ে পা রেখেছিলেন উল্টোডাঙার বিধান নিবাসে নতুন ফ্ল্যাটে। তখন আর ভাল করে কথাও বলতে পারছেন না। নার্সিংহোমে শুয়ে কেবিনের বাইরে ‘নো ভিজিটর’ বোর্ড ঝুলিয়ে তারই মধ্যে শেষ লেখা। ঠোঁটের অস্ফুট নড়াচড়া পড়তে পারতেন ছোট মেয়ে। তিনিই সেই লেখা তৈরি করে দিয়েছিলেন। বড় অমোঘ তার শিরোনাম, ‘যাত্রাভঙ্গ’!

তথ্য সহায়তা: কাকলি চক্রবর্তী

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

journalist Santosh Kumar Ghosh
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE