Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

আমার সেরা ভারতীয় দলে নিজের মাত্র একজন ছাত্রই সিওর ঢুকবে

মহাকাব্যিক পঁচিশ বছর। কখনও লাল-হলুদ, কখনও সবুজ-মেরুন। কখনও নীল জার্সির ভারত। পুরনো সেই সাম্রাজ্য বিস্তার আর তার ভাঙাগড়ার রুদ্ধশ্বাস কাহিনি নিয়ে দীর্ঘ এত বছর বাদে অকপট স্বয়ং প্রদীপকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়। আজ চতুর্দশ কিস্তি। নিজের খেলোয়াড়জীবন থেকে কোচিং কেরিয়ার— বিগত পঞ্চাশ বছরের ভারতীয় ফুটবলারদের খোলাখুলি তুলনা করে বাছলেন তাঁর সেরা ভারতীয় একাদশ। একই সঙ্গে সেরা বাংলা দলওআমার বন্ধুবর। ভারতের সর্বকালের গ্রেটেস্ট ইনসাইড ফরোয়ার্ড। যে নিজেকে স্ট্রাইকিং ফরোয়ার্ড ভাবতে ভালবাসে। খেলার চরিত্রটাও তাই ছিল। যেমন দুর্দান্ত খেলা তৈরি করত, তেমনি নিজেও গোল করত। চুনী গোস্বামী, মানে আমার বন্ধুবর গোসাঁইকে নিয়ে বলতে গিয়ে এত কথার অবতারণার কারণ, ঠিক আমাদের আগের জেনারেশনে তিন জন এমন ইনসাইড ফরোয়ার্ড দাপিয়ে খেলে গিয়েছিল, যারা গেমমেকিংয়ে দুর্ধর্ষ পারদর্শী ছিল। কিন্তু নিজেরা গোল করার ব্যাপারে কোথায় যেন একটা ঔদাসীন্য ছিল! আপ্পারাও। আমেদ খান। সাত্তার।

আমরা তিন মূর্তি

আমরা তিন মূর্তি

অনুলিখন: সুপ্রিয় মুখোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ২০ ডিসেম্বর ২০১৪ ০০:০৫
Share: Save:

আমার বন্ধুবর। ভারতের সর্বকালের গ্রেটেস্ট ইনসাইড ফরোয়ার্ড। যে নিজেকে স্ট্রাইকিং ফরোয়ার্ড ভাবতে ভালবাসে। খেলার চরিত্রটাও তাই ছিল। যেমন দুর্দান্ত খেলা তৈরি করত, তেমনি নিজেও গোল করত।

চুনী গোস্বামী, মানে আমার বন্ধুবর গোসাঁইকে নিয়ে বলতে গিয়ে এত কথার অবতারণার কারণ, ঠিক আমাদের আগের জেনারেশনে তিন জন এমন ইনসাইড ফরোয়ার্ড দাপিয়ে খেলে গিয়েছিল, যারা গেমমেকিংয়ে দুর্ধর্ষ পারদর্শী ছিল। কিন্তু নিজেরা গোল করার ব্যাপারে কোথায় যেন একটা ঔদাসীন্য ছিল! আপ্পারাও। আমেদ খান। সাত্তার।

তবে আমার বন্ধুবরের তুলনায়, সে কিট্টু হোক, যে কিনা আমেদ খানকেও বসিয়ে এখানে খেলেছে। কিংবা পুরণবাহাদুর হোক, যে উনিশশো চুয়ান্ন কোয়াড্রাঙ্গুলারে অসাধারণ শু্যটিং পাওয়ার, স্কোরিং দক্ষতায় সবার চোখ ঝলসে দিয়েছিল, হয়তো খুব সামান্যই পিছিয়ে। কিন্তু চুনী-বলরামকে আমি অন্য সব ভারতীয় অ্যাটাকারদের চেয়ে একটু এগিয়ে রাখি বরাবর।

গোসাঁইয়ের বল নিয়ে কারিকুরি আর পায়ের ছোঁয়া এতই মধুর ছিল, ওর সতীর্থ হিসেবে মাঠে সেসব দেখতে দেখতে আমার প্রায়শই আপ্পারাও, সাত্তারের নাম মনে ভেসে উঠত। কিন্তু দিনের শেষে, যাকে এন্ড প্রোডাক্ট বলি আমরা, সেখানে বন্ধুবর গোসাঁই কোথায় যেন সবার চেয়ে আলাদা! অন্য জাতের ইনসাইড ফরোয়ার্ড। যে কোনও অবস্থায় বাকি সবার চেয়ে চুনীকে ঊর্ধ্বে রাখব। আমার বাবা-কাকা-দাদু সম্পর্কের সিনিয়ররা আমাকে মার্জনা করবেন। তবে আমি সৎ থাকার চেষ্টা করেছি।

এ দেশে খালি পায়ে ফুটবলের যুগে আপ্পারাও-সাত্তার-আমেদ খানরা যে নয়নাভিরাম ডজ করত, বুট এসে পড়ার পর সেই সব ডজের তীক্ষ্মতা প্রায় অর্ধেক হয়ে গিয়েছিল। বুট পায়ে চুনী-বলরাম কিংবা আমি প্রচণ্ড গতিতে আউটসাইড-ইনসাইড, দু’টো ডজই করেছি একই দক্ষতায়।

আমাদের মধ্যে আবার বলরাম যেমন সাপ নাচানো ড্রিবল করত ওর অদৃশ্য বিনের তালে-তালে, তেমনি মডার্ন ফুটবলের দুরন্ত আউটসাইড-ইনসাইড ডজও করতে পারত। দু’পায়েই। সঙ্গে সেই অনবদ্য বল কন্ট্রোল! নিঃশব্দে একাই মাঠের অর্ধেকটা জুড়ে খেলত। যেখানে বল, যেখানে টিমমেটের সাপোর্ট দরকার, মাঠের সবাই—এমনকী অপোনেন্টও অবাক চোখে আবিষ্কার করত, বলরাম সেই পজিশনে ঠিক পৌঁছে গিয়েছে! পরের দিকে আমার কোচিং কেরিয়ারে এই ব্যাপারটা দেখেছি হাবিবের খেলায়। তবে বলরামের মতো সূক্ষ্মতা ছিল না হাবিবের পায়ে।

আর বলরামের পাস তো ছিল ঠিক যেন সরস্বতী পুজোয় অঞ্জলি দেওয়া! ঠিক অঞ্জলি দেওয়ার মতোই অব্যর্থ লক্ষ্যে টিমমেটদের পায়ে ফুল পড়ার মতো বলটা এসে পড়ত।

চুনীর ছিল আবার ডান পায়ের অসাধারণ ড্রিবল— দু’মুখো তরোয়ালের মতো যা আসতে কাটত, যেতেও কাটত! ফালাফালা করে দিত বিপক্ষ ডিফেন্স। গোসাঁই বা আমার অন্য সতীর্থদের হয়তো কিট্টুর মতো ডেড-লিফ লব ছিল না। তবে এটাও ঠিক যে, আমরা খুব একটা লবটব করে খেলতামও না। তিন জনই দুরন্ত স্পিডে এগিয়ে অপোনেন্টকে তছনছ করে দিতাম।

আইএফএ শিল্ড ফাইনালে মোহনবাগান বনাম ইস্টবেঙ্গলের খেলায় সুব্রতর ট্যাকল এড়াচ্ছেন শ্যাম

আমাদের যৌবনে আগের জেনারেশনের মতো গায়ের ভেতরে ঢুকে থাকা বল নিয়ে খেলতে পছন্দ করতাম না। বরঞ্চ আমরা ‘আউট অফ রিচ’ বল-এ আক্রমণ তৈরি করতে ভালবাসতাম। ও রকম বল-এ লম্বা-লম্বা স্ট্রাইডে স্পিড তোলাটা আরও ভাল ভাবে সম্ভব।

এই লেখাটায় তুলনামূলক আলোচনায় কুমারবাবু (উমাপতিকুমার), অমল মজুমদার, করুণা ভট্টাচার্য এমনকী মান্নাদাকেও (শৈলেন মান্না) আনছি না। কারণ, এঁদের খেলা আমি হয় দেখিইনি, কিংবা খুব অল্প দেখেছি। যা দিয়ে বিচার সম্ভব নয়।

আমার কাছে বহু মানুষ জানতে চেয়েছেন—ভারতের সর্বকালের সেরা ডিফেন্ডার কে? কেরলের আব্দুল রহমান? পঞ্জাবের জার্নাল সিংহ? না, বাংলার অরুণ ঘোষ?

বিশ্বাস করুন, এই তিন জনকে বিশ্লেষণ করতে গিয়ে প্রায়ই থতমত খেয়ে যাই এখনও! সন্দেহ হয়, আমি যথার্থ এদের প্রতিভাকে আপনাদের সামনে তুলে ধরতে পারলাম তো!

আমার খেলোয়াড়জীবনে বহু ম্যাচে আমি মাঠে এক জটাধারী শিবকে দেখেছি! সে সামনে ইউরোপের টিম পড়ুক। কিংবা লাতিন আমেরিকান টিম পড়ুক। কিংবা এশিয়ার কোনও দেশ পড়ুক, সেই শিব তার জটা খুলে ছুটছে!

ফুটবলে কম্বিনেশন প্লে—যেটাকে এখন তিকিতাকা বলা হচ্ছে, আমাদের খেলার সময়ে হাঙ্গারি থেকে এশিয়ার কোথাও কোথাও এলেও আমরা এখানে দেখতে পাইনি। তা সত্ত্বেও আমাদের এক মহান পূর্বসূরি তিন-তিন বার এশিয়ান ট্যুর করেছিলেন। পরে আমরা সিঙ্গাপুর, হংকং, মালয়েশিয়া কিংবা তৎকালীন বার্মায় খেলতে গিয়ে সেখানে বিদেশি বুড়োদের মুখে সেই সাড়ে ছ’ফুট লম্বা ফুটবল জাদুকরকে তিরিশ-চল্লিশ বছর আগে দেখার উচ্ছ্বাস শুনেছি— সামাদের মতো উচ্চাঙ্গের ফুটবলার নাকি এশিয়ায় জন্মগ্রহণ করেনি! অত বছর বাদে আমাদের সময়ে অনেকটা সে রকমই উচ্ছ্বাস বিদেশিদের মধ্যে দেখেছি জার্নালকে নিয়ে।

বাষট্টির এশিয়াড চ্যাম্পিয়ন ভারতীয় দল থেকে আমার যত দূর মনে পড়ছে পাঁচ জন এশিয়ান অলস্টার দলে সুযোগ পেয়েছিলাম। বন্ধুবর গোসাঁই। জার্নাল। ইউসুফ খান। অরুণ। আর এই অধম। না কি থঙ্গরাজও বোধহয় ছিল সে বারের এশিয়ান অলস্টারে! গর্বিত হওয়ার মতো রেকর্ড। কী বলুন?

হাঁটুতে চোট লাগায় প্রায় গোটা একষট্টি সালটা আমার বরবাদ হয়ে গিয়েছিল। ওই বছর ইংল্যান্ডের ব্ল্যাকপুলের সঙ্গে একটা ম্যাচে জার্নালই ক্যাপ্টেন্সি করেছিল ভারতের। ম্যাচটায় ওর খেলার অসম্ভব সুখ্যাতি অনেক বছর পরেও প্রত্যক্ষদর্শীদের মুখে শুনেছি।

জার্নালকে আবার সেন্ট্রাল ডিফেন্সে সবচেয়ে বেশি সাপোর্ট যে দিত, তার নাম অরুণ ঘোষ। পাঁচ ফুট এগারো ইঞ্চির পেটা চেহারা। অরুণের মতো দু’পায়েই বিদ্যুৎ গতির ট্যাকলিং বোধহয় মান্নাদারও ছিল না। অরুণের বলের ওপর অসাধারণ দখল। অনবদ্য হেডিং। চূড়ান্ত আত্মবিশ্বাস আমাকে যে কত ম্যাচে মুগ্ধ করেছে গুনে শেষ করা যাবে না। এই হয়তো জার্নালকে পিছন থেকে কভার দিচ্ছে! তো পরক্ষণে দশ-বারো গজ দূরে লেফট হাফের জায়গায় গিয়ে অপোনেন্টকে ট্যাকল করছে অরুণ! তার পর সেই বল নিয়ে গিয়ে নিজের ফরোয়ার্ডকে দিয়ে আসত। স্টপার হয়েও অরুণের ড্রিবল ছিল যাকে বলে নিরাপদ সুন্দর! আমার কোচিং জীবনের অন্যতম শিষ্য সুব্রত ভট্টাচার্যের মতো অহেতুক ঝুঁকি নিয়ে বিপক্ষ ফরোয়ার্ডকে ড্রিবল করত না অরুণ।

কিন্তু এত সব সত্ত্বেও কেবল একটা পয়েন্টে জার্নাল গোটা এশিয়াকে হারিয়ে দিয়েছে। শুধু ভারতকেই নয়। সেটা হল ওর অবিশ্বাস্য পাওয়ার অ্যান্ড স্পিড। এবং একই সঙ্গে ওই দুটো জিনিসেরই দুর্দান্ত প্রয়োগ। অত গতিতে আর সিওর হয়ে যে ট্যাকলটা জার্নাল করত, সেটায় বিপক্ষের পা যেন খুলে যেত!

জার্কাতায় সেই এশিয়াডে তৎকালীন সাউথ ভিয়েতনামের বিরুদ্ধে সেমিফাইনালে বন্ধুবর গোসাঁই ওর ব্রিলিয়ান্ট বেস্ট-এ ছিল। সে দিন ভারতের তিনটে গোলের মধ্যে দু’টো ছিল চুনীর। গ্রুপে তাইল্যান্ড ম্যাচে আমরা ত্রিমূর্তিই গোল করেছিলাম—আমি দু’টো, গোসাঁই আর বলরাম একটা করে। তার পর কার্যত কোয়ার্টার ফাইনালে দাঁড়িয়ে যাওয়া গ্রুপের শেষ ম্যাচে জাপানকে ভারত হারিয়েছিল আমার আর বলরামের গোলে। কিন্তু সেমিফাইনালে চুনীর দু’টো গোলই ছিল সত্যিকারে ব্রিলিয়ান্ট। অন্য গোলটা ছিল জার্নালের।

কিন্তু তার পরে সেই ভয়ঙ্কর ঘটনা। জার্নাল একটা ‘কল’ করেছে বল ছেড়ে দেওয়ার জন্য। কিন্তু ত্রিলোক সিংহ কয়েক সেকেন্ড এ কটু দেরি করে ফেলেছিল বল ছাড়তে। ডাব ফাটার মতো মাঠেই একটা শব্দ হল—ফটাস্! জার্নাল ‘তেরি’ না ওই গোছের কী একটা বিকট শব্দ করে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। কপাল দেড় ইঞ্চি ফাঁক হয়ে গিয়ে গলগল করে রক্ত বেরোচ্ছে। টেনশনে চুনী পাগলের মতো চিৎকার করছে—‘‘প্রদীপ, প্রদীপ, ও দিকে দেখিস না, দেখিস না। জার্নাল মরে গিয়েছে!”

সেই সময়ও ফিফার নিয়ম— শরীর থেকে রক্ত ঝরা অবস্থায় খেলা যাবে না। কিন্তু অসমসাহসী জার্নাল ওই অবস্থাতেও মাথায় ফেট্টি বেঁধে বাকি ম্যাচ খেলে ভারতকে এশিয়াড ফাইনালে তুলেছিল সে দিন।

এর পর সেই চিরস্মরণীয় দিন! চার সেপ্টেম্বর, উনিশশো বাষট্টি। ইন্দোনেশিয়ার রাজধানীর ফুটবল মাঠ থেকে ভারতীয় দলের এশিয়ান গেমসের সোনার পদক কুড়োবার ঐতিহাসিক দিন!

ম্যাচের আগের রাতে তখন প্রায় দুটো বাজে! গেমস ভিলেজে বন্ধুবর, অরুণ, জার্নাল, আমি তখনও হেঁটে বেড়াচ্ছি। কর্মরত নিরাপত্তারক্ষীরা এসে বারণ করল। উপদেশ দিল এত রাতে ঘরের বাইরে থাকাটা প্লেয়ারদের ভাল দেখায় না। আমি মজা করে তাদের বললাম, “আমরা কেউ মহিলার খোঁজে বেরোয়নি। আমরা ও রকম চরিত্রের নই।”

হঠাৎ বলরাম এসে খবর দিল, রহিম সাহেব আমাদের পাঁচ জন সিনিয়র ফুটবলারকে ওঁর ঘরে ডেকে পাঠিয়েছেন। অত রাতে পরের দিনের ফাইনালে দক্ষিণ কোরিয়া ম্যাচের চূড়ান্ত গেমপ্ল্যানিং বসল। কোরিয়ার কাছে গ্রুপের প্রথম ম্যাচে দু’গোল খেয়ে হেরেছিলাম। রহিম সাহেব তাঁর স্বভাবসিদ্ধ নিচু গলায় বললেন, “কাল জার্নাল সেন্টার ফরোয়ার্ড। মাথার চোটের জন্য ওর পক্ষে হেড করা সম্ভব নয়। সে জন্য ডিফেন্সে নামিয়ে লাভ নেই। আবার জার্নালের মতো শক্তিকে মাঠের বাইরে রেখেও নামা যায় না।” অরুণের দিকে তাকিয়ে স্যার সে দিন বলেছিলেন, “কী ঘোষ, জার্নালকে ছাড়া সেন্ট্রাল ডিফেন্স সামলাতে পারবে তো?” অরুণ সটান জবাব দিল, “নিশ্চয়ই পারব।”

জার্নাল পঞ্জাব ইউনিভার্সিটি দলে সেন্টার ফরোয়ার্ড খেলত। আজ থেকে অর্ধ শতাব্দী আগে তখনকার দিনে যোগাযোগ ব্যবস্থা এতটাই করুণ ছিল যে, হায়দরাবাদে বসে থাকা কারও পক্ষে কার্যত অসম্ভব পঞ্জাবে কী হচ্ছে তার খোঁজ রাখা। কিন্তু রহিম সাহেব এ জন্যই রহিম সাহেব যে, অত প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও তিনি খোঁজখবর রাখতেন, ভারতীয় ফুটবলে কোথায় কী ঘটছে? কোন প্লেয়ার কেমন খেলছে? জার্নাল যে সেন্টার ফরোয়ার্ড খেলে গোলটোল করেছে এককালে, সেটা ঠিক জানতেন।

এবং ফাইনালে আমার গোলের কয়েক মিনিটের মধ্যেই জার্নালের গোল। শেষের দিকে থঙ্গরাজ একটা বাজে গোল না খেলে ফাইনালটা আমরা হয়তো আরও সহজে জিততাম। তবে মাঠে প্রচণ্ড উত্তেজনা ছিল। জার্নাল একবার অত গাট্টাগোট্টা এক কোরিয়ানকে আক্ষরিক অর্থে চ্যাংদোলা করে তুলে আছড়ে মাটিতে ফেলে দিল! রেফারি ও রকম ঘটনায় হতভম্ব হয়ে জার্নালকে হলুদ কার্ড দেখাতেও ভুলে গিয়েছিলেন!

এখনও মনে আছে, এক-এক করে আমাদের প্রত্যেকের সোনার পদকটা একবার করে ছুঁয়ে দেখতে দেখতে রহিম সাহেব কেঁদে ফেলেছিলেন ড্রেসিংরুমে। তত দিনে ওঁর শরীরে ক্যান্সার বাসা বেঁধে ফেলেছে। রোজ জ্বর হচ্ছে। জাকার্তায় তো নিজে আমাদের ট্রেনিং পর্যন্ত দিতে পারতেন না। আমরা ওঁর শিিউউল করে দেওয়া ট্রেনিং প্রোগ্রাম নিজেরা প্র্যাকটিসে ফলো করতাম। ফাইনালের দিন সকালে আমাদের অনুরোধ জানানোর মতো বলেছিলেন, “আমি আর ক’দিন বাঁচব জানি না। তুম লোগ মেরে কো এক তোফা আজ দো। এশিয়ান গেমস কা গোল্ড মেডেল!” আজও কথাগুলো কানে বাজে!

ওই দলের গোলকিপার থঙ্গরাজের বল ধরে নিজের অ্যাটাকারদের উদ্দেশ্যে পঞ্চাশ গজের নিখুঁত থ্রো। ইউসুফ খানের ভার্সেটালিটি। টিমের সবচেয়ে জুনিয়র ছেলে অরুময় নৈগমের অনবদ্য স্পিড। কার কথা ছেড়ে কার কথা বলব! থঙ্গরাজ, প্রদ্যোৎ বর্মন, সনৎ শেঠ, কিংবা আমার ছাত্রদের মধ্যে ভাস্কর গঙ্গোপাধ্যায় গ্রিপিং, ফিস্ট করা, অ্যান্টিসিপেশন, আউটিংয়ে হয়তো উনিশ-বিশ। কিন্তু থঙ্গরাজ একটা ব্যাপারে সবার চেয়ে এগিয়ে থাকবে। সেটা হল হাতে বল নিয়ে ছুড়ে এক টিপে পঞ্চাশ গজ দূরে অ্যাটাকারের কাছে বল পাঠাতে পারার অবিশ্বাস্য দক্ষতা।

গোলকিপারের কোনও সেভের পর বলটা নিয়ে তো পাল্টা আক্রমণটা শুরু করতে হয়! সে ক্ষেত্রে থঙ্গরাজের ওই বিরাট থ্রো ছিল আমাদের অ্যাটাক তৈরির জন্য অব্যর্থ।

ইউসুফ খান আবার ইন্ডিয়া টিমে লেফট ব্যাক খেললেও যে কোনও পজিশনে সমান দক্ষতায় খেলতে পারত। রহিম ওকে লেফট ব্যাক, লেফট হাফ, ইনসাইড ফরোয়ার্ড—সব পজিশনে খেলিয়েছেন। হায়দরাবাদ পুলিশের জার্সিতে ইউসুফ অনেক ম্যাচ সেন্টার ফরোয়ার্ডে খেলে গোল করে দলকে জিতিয়েছে এমন স্ট্যাটিসটিক্সও আছে।

প্রদর্শনী ম্যাচ শুরু হওয়ার আগে বলরাম, চুনীর সঙ্গে পিকেও করমর্দনের পালা সারছেন

আসল কথায় এ বার ঢোকা যাক। আসলে আমি-চুনী-বলরামের সময় থেকে আমার কোচিং জীবন পর্যন্ত দীর্ঘ সময়ের সেরা ভারতীয় দল গড়তে গেলে, এগারো জনের মধ্যে চোখ বুজে আট-ন’জনই ঢুকবে বাষট্টির এশিয়াড সোনা জয়ের টিম থেকে! আমার পঁচিশ বছরের কোচিং জীবনে— সেটা ইস্টবেঙ্গল হোক, কী মোহনবাগান, কিংবা ভারত হোক, বাষট্টির সেই দলের স্ট্যান্ডার্ডের ফুটবলার প্রায় কাউকেই পাইনি।

আমার সেরা ভারতীয় একাদশে রাইট ব্যাকে পর্যন্ত সুধীর কর্মকারের সঙ্গে প্রচণ্ড লড়াই হবে টি রহমানের। শেষ পর্যন্ত সুধীর ফটোফিনিশে বেরিয়ে যাবে—ওর ঈশ্বরপ্রদত্ত ইনস্টিঙ্ক্ট ফুটবলবোধের জন্য। যেন ওর ফুটবল-র্যাডারে আগাম ধরা পড়ে যেত পরের সেকেন্ডে বলটা কোথায় যাবে, কার পায়ে যাবে, তখন ওকে কী করতে হবে!

আর একটা সিদ্ধান্ত অনেক ভেবেচিন্তে নিচ্ছি। নির্বাচনও বলতে পারেন। ইউসুফ খানকে ওর অনবদ্য ভার্সেটা লিটির জন্য আমার সেরা ভারতীয় একাদশে সেন্ট্রাল মিডফিল্ড খেলিয়ে, লেফট ব্যাকে অলোক মুখোপাধ্যায় কিংবা শ্যামল বন্দ্যোপাধ্যায়কে হয়তো নামাব। অলোকের ট্যাকল বিশ্বমানের। অসমসাহসী চরিত্রের সাইডব্যাক। শ্যামলের আবার স্পিড অসাধারণ। আমার প্র্যাকটিসে শ্যামল বলে-বলে মানস-বিদেশের মতো উইঙ্গারকে স্পিডে বিট করত। তা ছাড়া অপোনেন্টের শরীরের ভেতর ঢুকে পড়ে তাকে আটকাবার একটা অদ্ভুত দক্ষতা আছে শ্যামলের। বাকি ন’জনই বাষট্টির দলের।

সব মিলিয়ে আমার সেরা ভারতীয় একাদশ এ রকম: থঙ্গরাজ (গোল)। সুধীর, জার্নাল, অরুণ, অলোক/শ্যামল (ডিপ ডিফেন্স)। কেম্পিয়া, ইউসুফ, বলরাম (মিডফিল্ড)। চুনী, পিকে, অরুময় (ফরোয়ার্ড)। দলটা ৪-৩-৩ খেলবে।

আবার আমি যাদের কোচিং দিয়েছি, তাদের ভেতর থেকে আমার পছন্দের সেরা বাংলা একাদশ এ রকম: (৪-৩-৩ ফর্মেশনে) গোলে ভাস্কর। চার ডিফেন্ডার—সুধীর, মনোরঞ্জন, প্রদীপ চৌধুরী, অলোক/শ্যামল। মাঝমাঠে— গৌতম, প্রসূন, প্রশান্ত। ফরোয়ার্ডে সুভাষ, শ্যাম, হাবিব (একটু নীচ থেকে অপারেট করবে)।

ভাস্করের জায়গায় গোলপোস্টের নীচে তরুণ বসুও আসতে পারত। কিন্তু ভাস্করের দুর্জয় সাহস ওকে অন্য কিপারদের থেকে আলাদা করে রেখেছে। মরার ঝুঁকি নিয়েও ভাস্কর গোল বাঁচাতে ঝাঁপাত!

ডিপ ডিফেন্স নিয়ে নিশ্চয়ই কোনও ব্যাখ্যার প্রয়োজন নেই। চার জনই নিজের নিজের ক্ষেত্রে প্রায় অপ্রতিদ্বন্দ্বী। সুব্রতকে টপকে পি চৌধুরী আসবে ওর অনবদ্য স্লাইডিং ট্যাকল আর সেই ট্যাকলের অবিশ্বাস্য বিরাট ‘রিচ’-এর জন্য।

মাঝমাঠেরও তিন জন স্ব-স্ব ক্ষেত্রে অতুলনীয়। দলটাকে ৪-২-৪ খেলিয়ে ফরোয়ার্ডে আকবরকে খেলানোর খুব লোভ হচ্ছে এক-এক সময়। কিন্তু প্রশান্তর মতো গেমমেকারকে বাদ দিই কী ভাবে? প্রশান্তর গেমমেকিং দেখতে দেখতে এক-এক সময় বলরামের কথা মনে পড়ে যেত আমার! এতটাই খেলা তৈরি করার ক্ষমতা ওর।

ফলে ৪-৩-৩ খেলিয়ে হাবিবকে উইথড্রন ফরোয়ার্ড হিসেবে ব্যবহার করব আমার সেরা বাংলা দলে। সেন্টার ফরোয়ার্ড শ্যাম থাপা। শরীরের যে কোনও জায়গা দিয়ে গোল করতে পারত যে। সুভাষ ওর ইন্টারন্যাশনাল লেভেলের গতি, শরীর আর বুলডোজিং ক্ষমতায় উইংয়ে ঝড় তুলবে। আবার একই সঙ্গে ভেতরে কাট করে ঢুকে নিজেও গোল করবে।

পরিষ্কার বলছি— জীবনের প্রায় প্রত্যন্তে পৌঁছে কোনও সমালোচনার ভয় না করে একটা সত্যি কথা বলছি। পিন্টু (সমরেশ চৌধুরী), সুরজিৎ, কৃশানুর মতো শিল্পী ফুটবলারদের সেরা একাদশে জায়গা দিতে পারলাম না। কারণ ওদের তিন জনেরই এক দুর্বলতা—সাহসের অভাব। গোটা কয়েক রাফ ট্যাকলের সামনে পড়লেই নিজের খেলা অর্ধেক হয়ে পড়ার প্রবণতা।

মানস-বিদেশকে নিতে পারলাম না বলেও খারাপ লাগছে। জেভিয়ার পায়াস মাত্র দু’মরসুম আমার কোচিংয়ে খেলেছে। বিজয়নও তাই। সে জন্য ওদের বিচারে আনিনি। ভাইচুংয়ের লিডারশিপ ক্ষমতা খুব ভাল। কিন্তু ফরোয়ার্ড হিসেবে শ্যাম-সুভাষদের পরের স্ট্যান্ডার্ড।

মজিদ বাসকর, চিমা-রাও নির্বাচন তালিকায় পড়ছে না। বিদেশি ফুটবলার বলে। তবে আমার বিদেশি ছাত্রদের মধ্যে মজিদ কিংবা চিমার ভারতীয় নাগরিকত্ব থাকলে সেরা বাংলা দল নির্বাচনে হয়তো অনেক ওলটপালট ঘটে যেত!

(চলবে)

পিকে বন্দ্যোপাধ্যায়ের দুষ্প্রাপ্য ছবি দেখতে হলে অ্যাপল অ্যাপ স্টোর (আইফোন/ আইপ্যাড) অথবা গুগল প্লে স্টোর (অ্যান্ড্রয়েড) থেকে ABP AR APP-টি ডাউনলোড করে এই ছবিটি স্ক্যান করুন

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

supriyo mukhopadhyay pk banerjee chuni goswami
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE