Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

দেখব রমা কী করে হিরোইন হয়

তাঁর কাছে প্রত্যাখ্যাত হয়ে বলেছিলেন এক পরিচালক। শেষ দিকে সুচিত্রা সেন নাকি চেয়েছিলেন ‘নটী বিনোদিনী’ করতে। বললেন মাধবী মুখোপাধ্যায়। শুনলেন সংযুক্তা বসুতাঁর কাছে প্রত্যাখ্যাত হয়ে বলেছিলেন এক পরিচালক। শেষ দিকে সুচিত্রা সেন নাকি চেয়েছিলেন ‘নটী বিনোদিনী’ করতে। বললেন মাধবী মুখোপাধ্যায়।

শেষ আপডেট: ০৫ এপ্রিল ২০১৪ ০০:০৫
Share: Save:

রমা, ঋত্বিকদা আর আমি

“ছেড়ে দে মাধু। তোর সঙ্গে আমার পোষাবে না। আমি রমাকে (সুচিত্রা সেন) দিয়ে অভিনয় করিয়ে নেব,” ঋত্বিকদা যে কত বার আমাকে এই হুমকি দিয়েছেন তার ইয়ত্তা নেই।

ঋত্বিক ঘটকের সঙ্গে আমার যেমন ভাব ছিল তেমন ঝগড়াও হত খুব।

হয়তো কোনও ছবির কাজ নিয়ে মতের অমিল হল, ঋত্বিকদা রেগে গেলেন। আর তখনই দুম করে বলে বসতেন ওই কথাটা।

মনে মনে হাসতাম। ভাবতাম তোমার মতো খামখেয়ালি মেজাজের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কাজ করা অত সোজা! শেষমেশ সত্যিই ঋত্বিক ঘটকের ছবিতে সুচিত্রা সেন কোনও দিনই অভিনয় করেননি।

ঋত্বিক ঘটক মানুষটা কেমন ছিলেন তা নিশ্চয়ই জানতেন তাঁর রমাও। তা সত্ত্বেও ওঁদের মধ্যে কেন জানি না একটা আত্মিক যোগাযোগ ছিল।

আপনার হাতের তালুতে চুল কই

সুচিত্রা সেন কিংবদন্তি মহানায়িকা। সত্যজিৎ রায়, ঋত্বিক ঘটক, মৃণাল সেন, কিংবা তপন সিংহের তকমা না এঁটেও তিনি একাই একশো। ঋত্বিকদার মুখে তো রমা নামটা শুনেছিই বারবার। সেই সময়কার নামকরা প্রযোজক অসিত চৌধুরী আমাদের বাড়িতে আসতেন। আমার রান্না খেতেন। কোনও রান্না ভাল লাগলে বলতেনএটা সুচিত্রার থেকেও ভাল হয়েছে।

আসলে ওঁকে ঘিরে যে মুগ্ধতা তা যেন বাকরুদ্ধ করে রেখেছিল তাবড় বাঙালিকে।

সুচিত্রা তখন প্রায় উদীয়মান শিল্পী। এক বড় পরিচালক তাঁকে বোধ হয় প্রণয়ঘটিত প্রস্তাব-টস্তাব দিয়ে যথারীতি প্রত্যাখাত হন। তাতে পরিচালকমশাই প্রচণ্ড রেগে গিয়ে বলেন, “দেখব রমা কী করে হিরোইন হয়! যদি হয় তো আমার হাতের তালুতে চুল গজাবে।’’

তার বহু দিন বাদে সেই পরিচালকের সঙ্গে আবার দেখা সুচিত্রার। তখন তিনি স্টার সুচিত্রা সেন। পট করে পরিচালককে বলে বসলেন, ‘‘দেখি দেখি, আপনার হাতটা। হাতের তালুতে চুল গজানোর কথা ছিল তো! আমি তো হিরোইন হয়ে গিয়েছি।”

এই রকম আশ্চর্য সব রসিকতা উনি নাকি মাঝেমধ্যেই করতেন। একবার কী এক খেয়ালে বাড়িতে একটা শিম্পাঞ্জি পুষলেন (তখন প্রাণী পোষা নিয়ে কোনও বিধিনিষেধ ছিল না)। সে শিম্পাঞ্জি নাকি চা-সিগারেটও খেত।

হঠাৎ একদিন কী খেয়ালে পোষ্যটিকে দিয়ে দিলেন তাঁর প্রিয় এক মেক আপ আর্টিস্টকে।

টুকটাক এই সব খামখেয়ালির গল্প শোনা গেলেও আসলে সুচিত্রা ছিলেন অসম্ভব ডিসিপ্লিনড, বাস্তববাদী মানুষ। এ কথাটা তাঁকে যাঁরা দেখেছেন সকলেই বলেন। এমনকী উত্তমকুমারের সঙ্গে যখন কাজ করেছি, তখন কদাচিৎ সুচিত্রা সেনের কথা উঠলে দেখতাম উত্তমকুমারের কী গভীর শ্রদ্ধা!

‘অগ্নিপরীক্ষা’য় আমিও থাকতে পারতাম

ওঁর সঙ্গে আমার দেখা হয়নি কোনও দিন। অ্যলবামে এমন কোনও ছবি নেই যেখানে আমি আর সুচিত্রা সেন একসঙ্গে।

‘অগ্নিপরীক্ষা’ ছবিতে সুচিত্রা সেনের ছোটবেলার চরিত্রে আমার অভিনয় করার কথা হয়েছিল। কিন্তু যেহেতু আমার গড়ন ছিল রোগাটে, তাই শেষমেশ চান্স হয়নি। সেই চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন তখনকার বিখ্যাত শিশুশিল্পী শিখারানি।

মুনমুনের সঙ্গে আমার অনেক দিনের আলাপ। সুচিত্রা সেনের পারলৌকিক অনুষ্ঠানে যে দিন গেলাম, মুনমুন আবেগ ভ’রে বলল, ওর মা নাকি আমার প্রসঙ্গে বলতেন, “এই মেয়েটা ভারী ভাল অভিনয় করে কিন্তু!” সত্যিই তো আমি ওঁর মেয়ে ছাড়া আর কী’ই বা হতে পারি! ‘অগ্নিপরীক্ষা’, ‘সাড়ে চুয়াত্তর’, ‘উত্তর ফাল্গুুনী’, ‘সাত পাকে বাঁধা’, ‘হসপিটাল’ এ সব ছবি আমার কাছে বীজমন্ত্রের মতো। আমার তো মনে হয় আর সব চরিত্রর কথা যদি না-ও বলি, রিনা ব্রাউনই হল সেই চরিত্র, যা শুধু সুচিত্রা সেন ছাড়া আর কেউ করতে পারতেন বলে আমার অন্তত মনে হয় না।

নিজের শর্তে বাঁচা

সুচিত্রা সেন যখন পুরোদমে তারকা, তখন প্রত্যেক স্টুডিওতেই তাঁর জন্য আলাদা একটা ঘর থাকত।

তাঁর শ্যুটিং থাকলে সে ঘর খোলা হত। সেখানে বসে মহানায়িকা মেকআপ ও বিশ্রাম সারতেন।

তখনকার দিনে একটা নিজস্ব ঘর সুচিত্রা আদায় করে নিয়েছিলেন প্রত্যেক স্টুডিও চত্বরে, কেবল নিজের মানসিক প্রস্তুতির জন্য। সেই ঘর থেকে বেরিয়ে যখন ফ্লোরে ঢুকতেন তখন তিনি আর রমা নন। নন সুচিত্রা সেনও। তখন শুধু মাত্র সেই চরিত্রটাই তাঁকে ঘিরে থাকত, যে চরিত্রে তিনি অভিনয় করছেন। অভিনয় ছেড়ে যখন চলে গেলেন তিনি, তার বহু পরে বিভিন্ন স্টুডিয়োয় সুচিত্রা সেনের নামাঙ্কিত ঘরগুলোতে প্রবেশের অধিকার পেয়েছি। সুন্দর আসবাবে সাজানো। বড় আয়না। বসার জায়গা। জানলায় শৌখিন পর্দা। সবেতেই এক অভিজাত রুচির পরিচয়। সবই ছিল। কিন্তু নায়িকার নির্বাসনের পর ক্রমে তা মলিন হয়ে গিয়েছিল।

যত বারই সে সব ঘরে ঢুকেছি তত বারই মনে হয়েছে এই বাহ্যিক সাজসজ্জার আড়ালে একটা সত্য আছে। নিজের শর্তে জীবন বাঁচার বিদ্যাটা যে কী করে ওই রকম একটা পুরুষশাসিত সমাজে দাঁড়িয়ে আয়ত্ত করেছিলেন তিনি, ভাবলে আজও অবাক হয়ে যাই।

যদি হতেন নটী বিনোদিনী

সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে ওঁর ‘দেবী চৌধুরাণী’ করা হয়নি। কারণটা সবার জানা। সত্যজিৎ রায় শ্যুটিংয়ের সময়টা ওঁকে ‘এক্সক্লুসিভ’ ভাবে চেয়েছিলেন। সুচিত্রা মানেননি। তবে এই ‘এক্সক্লুসিভ’ চাওয়ার ব্যাপারটা শুধু যে সুচিত্রা সেনের ক্ষেত্রেই ঘটেছে, তা কিন্তু নয়। আমি যখন ‘চারুলতা’ করি, তখন আমাকেও সব কাজ ছেড়ে ওই একটা ছবির কাজই করতে হয়েছে।

‘দেবী চৌধুরাণী’ কেন হয়নি সেটা গুরুত্বপূর্ণ নয়, কিন্তু সবচেয়ে যেটা আপসোস হয় ভাবলে যে, সত্যজিৎ- সুচিত্রার ভাবনায় একটা কালজয়ী বাংলা ছবি হয়তো দর্শক মিস করল।

আরও একটা আক্ষেপ। শেষ দিকে নাকি ‘নটী বিনোদিনী’ করার খুব ইচ্ছে ছিল সুচিত্রা সেনের। চিত্রনাট্য পর্যন্ত তৈরি ছিল। শেষ পর্যন্ত কাজটা হল না। সেই সময় মুনমুন ‘রাজবধূ’ বলে একটা ছবি করে। জানি না সেই কারণেই কি সুচিত্রা সেন ‘নটী বিনোদিনী’ করলেন না?

মুনমুনের মধ্যে সুচিত্রা

আজ ওঁর কথা বলতে গিয়ে মুনমুনের মুখটাই ভেসে উঠছে বারবার।

বছরখানেক আগের কথা। সে দিন কোয়েল (মল্লিক)-য়ের বিয়ে। বিরাট জায়গা জুড়ে খাওয়াদাওয়ার আয়োজন। প্রচুর অতিথি অভ্যাগত। ভিড়ের মধ্যে মুনমুনের সঙ্গে দেখা।

আমাকে ও এক জায়গায় বসাল। খানিকক্ষণ গল্প করল। তার পর ওকে চলে যেতে হল। আরও খানিকটা থেকেই যেত হয়তো, কিন্তু মেয়েকে এয়ারপোর্টে ছাড়তে যেতে হবে বলে চলে গেল। কিন্তু কী স্নেহভরা সান্নিধ্য! কী দায়িত্ববোধ! আমার মনে হয় এ সবই মুনমুন মায়ের শিক্ষায় পেয়েছে। শুনেছি নিকটজনদের খুব আদরযত্ন করতেন সুচিত্রা। সেই গুণ মেয়েও পেয়েছে।

মানুষের সঙ্গে যোগাযোগটা সুচিত্রা সেন না রাখলেও শুনেছি দানধ্যানে উনি ছিলেন উদার। আড়ালে থেকেও সে কাজটা উনি করে গিয়েছেন।

সবাই যে সর্বসমক্ষে আসবেন এমন তো কোনও কথা নেই। কিন্তু ওঁর যে সিনেমাজগতের সঙ্গে কোনও যোগাযোগ ছিল না তা নয়। পছন্দসই মানুষদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন। যেমন কানন দেবীর প্রতি সুচিত্রা সেনের শ্রদ্ধা ছিল। ছিল আন্তরিক সম্পর্কও। এ কথা কাননদি নিজেই বলেছেন কত বার। বয়সে অনেকটা বড় হলেও ছায়া দেবীর সঙ্গেও যোগাযোগ ছিল সুচিত্রা সেনের।

নিজেকেই ভুলে যাওয়া

সুচিত্রা নাকি মহানায়িকা ইমেজকে বাঁচিয়ে রাখতেই লোকচক্ষুর আড়ালে চলে যান। অনেকেরই এমন ধারণা। কিন্তু বিশ্বাস করুন এটা আমার মনে হয় না।

বরং মনে হয়, এই যে এত ছবি, এত নামযশ, এত গ্ল্যামার, এত অহং-য়ের পূর্ণতা এ সব থেকে উনি বোধহয় মুক্তি চেয়েছিলেন। জীবন যে খুব নশ্বর সে কথা ভেবেই। আমিত্বকে পুরোপুরি মুছে ফেলার সাধনাতেই থেকে গেলেন বাকি জীবন।

কিছুই থাকার নয়। সবই ফুরায় একদিন। এই সত্যটাকে আগে থেকে উপলব্ধি করেই সতর্ক হয়েছিলেন। আত্মস্থ হয়েছিলেন।

চলে যাওয়ার পর কাল তাঁর প্রথম জন্মদিন। যেখানেই থাকুন, সেটা ওঁর কাছে নতুন একটা পৃথিবী।

আপনাকে প্রণাম করে এই শুভেচ্ছা জানাই রমাদি, ভাল থাকবেন। নিজের শর্তে বাঁচবেন।

যেমনটা বেঁচে এসেছেন এত দিন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE