Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪
খেলাধুলা: ফার্স্ট স্লিপ...

নির্বিকার মুখে ইয়ান বলে দিল শুনেছি ব্র্যাডম্যান বেশ ভালই ব্যাটসম্যান

বাইশ গজের দশ বন্ধুর গল্প। আজ পর্ব ৯। লিখছেন কিশোর ভিমানীচ্যাপেল ভাইদের মধ্যে বয়েসে সবচেয়ে বড়। স্যার ভিক রিচার্ডসনের নাতি। ইয়ান সম্ভবত ওর সময়কার সবচেয়ে বিতর্কিত ক্রিকেটার। ইয়ানের উত্তরাধিকার ওর দেশে তো বটেই, অন্যান্য দেশেও এখনও অটুট। ওর বায়নাক্কা, নিজের দেশের ক্রিকেট বোর্ডের বিরুদ্ধে ওর মহাকাব্যিক বিদ্রোহ, টনি গ্রেগের মতো ব্যক্তিত্বের সঙ্গে ওর লড়াই আর ওর চাঁছাছোলা কথাবার্তামিশ্র প্রতিক্রিয়ার সঙ্গে লোকে আজও মনে রেখেছে।

শেষ আপডেট: ২৮ জুন ২০১৪ ০০:০৫
Share: Save:

চ্যাপেল ভাইদের মধ্যে বয়েসে সবচেয়ে বড়। স্যার ভিক রিচার্ডসনের নাতি। ইয়ান সম্ভবত ওর সময়কার সবচেয়ে বিতর্কিত ক্রিকেটার।

ইয়ানের উত্তরাধিকার ওর দেশে তো বটেই, অন্যান্য দেশেও এখনও অটুট। ওর বায়নাক্কা, নিজের দেশের ক্রিকেট বোর্ডের বিরুদ্ধে ওর মহাকাব্যিক বিদ্রোহ, টনি গ্রেগের মতো ব্যক্তিত্বের সঙ্গে ওর লড়াই আর ওর চাঁছাছোলা কথাবার্তামিশ্র প্রতিক্রিয়ার সঙ্গে লোকে আজও মনে রেখেছে।

এই সব কিছু মিলিয়েই মানুষটার ভাবমূর্তি। যাকে শ্রদ্ধার সঙ্গে বলা হয় চ্যাপেলি।

ইয়ানের একটা বড় প্লাস সাইড আছে, যেটা ওর শত্রুরাও মেনে নিতে বাধ্য হবে। ইয়ান দুরন্ত টিমম্যান। ওর দুই ঘনিষ্ঠ বন্ধু রডনি মার্শ আর ডেনিস লিলির সঙ্গে তৈরি ত্রয়ী ওদের দেশের বোর্ডের বিরুদ্ধে বারবার লড়ে এসেছে। ক্যাপ্টেন হিসেবে ও কোনও দিন আপস করেনি। নিজের পছন্দের টিম না পেলে সব ছেড়েছুড়ে বেরিয়ে যেতেও ও তৈরি ছিল।

ইয়ান অনেক কিছুর জন্যই বিখ্যাত। যার অন্যতম হল মাঠের মধ্যিখানে নিজের প্যান্ট-ট্যান্ট নামিয়ে অ্যাবডোমিন্যাল গার্ড ঠিক করা!

১৯৬৯। খুব অদ্ভুত ভাবে ওর সঙ্গে আমার দেখা। ওদের টিমটা উঠেছিল গ্রেট ইস্টার্ন হোটেলে। অতিথি ক্রিকেট টিমের তখন ওই হোটেলে ওঠাটাই রেওয়াজ ছিল।

ইয়ান তখন বিল লরির ভাইস ক্যাপ্টেন। বিল লরি ছিল আর এক আগুনে ব্যক্তিত্ব যে হাজার-হাজার দর্শকের চোখের সামনে একজন ফটোগ্রাফারকে ব্যাট দিয়ে পিটিয়ে কলকাতা সাংবাদিকদের বিরাগভাজন হয়েছিল।

যাই হোক, সে বার খুব লম্বা বিরতির পর অস্ট্রেলিয়া ভারতে খেলতে এসেছিল। অ্যাশলি ম্যালেট, ডগ ওয়াল্টার্স আর আগুনে সুইং বোলার ‘গার্থ’ ম্যাকেঞ্জিদের দেখে ইডেন তাই প্রচণ্ড উত্তেজনায় টগবগ করছিল।

ওই সফরটা মনে থাকার আর একটা কারণ, টিকিট কাটতে এসে কয়েক জন পদপিষ্ট হয়ে মারা যায়। স্থানীয় অ্যাসোসিয়েশন প্রতি বারের মতো সে বারও টিকিট বিক্রি ঠিকঠাক করতে পারেনি। ওই ম্যাচে আমি ছিলাম স্রেফ একজন দর্শক।

ক্রিকেট-লিখিয়ে হিসেবে আমার কেরিয়ার শুরু হয়েছিল তার তিন বছর পরে। দিনের বেলা দারুণ ক্রিকেট দেখতাম। এখনও মনে আছে, ম্যাকেঞ্জির ওপেনিং স্পেলের সৌজন্যে অশোক মাঁকড় আর ফারুখ ইঞ্জিনিয়ার যখন পত্রপাঠ প্যাভিলিয়নে বিদায় নেয় তখন স্কোরবোর্ডে ভারতের একটা রানও ওঠেনি!

ম্যাচটায় অফস্পিনার প্রসন্ন ছিল। ওই সময়ই বাঙালি একটি মেয়েকে বিয়ে করেছিল বলে দর্শক ওকে ‘জামাইবাবু’ বলে ডাকছিল। ম্যাচের উপর, ভারতীয় হারের উপর ওর কোনও প্রভাব অবশ্য ছিল না। তবে ম্যাচের তৃতীয় রাতটা আমার কাছে স্মরণীয় হয়ে আছে অন্য কারণে।

মনে রাখবেন, শীতের মাঝামাঝি সময় কলকাতায় ভরপুর পার্টির মরসুম। আর অজিরা তো পার্টি করতে প্রচণ্ড ভালবাসে। ম্যাচের পর ওরা ক্লাব আর ফাইভ স্টার হোটেলে চলে যেত, ভারতীয় বিয়ার উপভোগ করত।

শহরজুড়ে প্রচুর পার্টিতে ওরা যেত। কেউ কেউ নিমন্ত্রিত হয়ে, কেউ কেউ আবার ও সব লৌকিকতা না মেনেই।


রানি এলিজাবেথের সঙ্গে ইয়ান, গ্রেগ ও অন্যরা

রেস্ট ডে-র আগে ম্যাচের তৃতীয় সন্ধেয় অমনই একটা পার্টি ছিল। রাত দশটা নাগাদ পার্টিতে ঢুকল লরি, ম্যালেট, টেবার, রেডপাথ আর ম্যাকেঞ্জি। তখন আমরা ক্লিফ রিচার্ড আর প্যাট বুনের গানের সঙ্গে নাচছি। বলতেই হবে, আমাদের অতিথিরা দুর্দান্ত খুশি হয়েছিল। মাঝরাত পেরিয়ে আমরা সবাই খুব মজা করেছিলাম।

পার্টির পর ওদের অফার করলাম, দু’টো গাড়িতে করে ওদের হোটেলে নামিয়ে দেব। প্রস্তাব শুনে ওরা তো অভিভূত। বলল, চলো হোটেলের ঘরে চলো। ওখানে রাতের লাস্ট ড্রিংকটা হয়ে যাক।

আমরা ছিলাম চার জন। একটা বিয়ার নিয়ে গুছিয়ে বসতে না বসতেই একজন অজি ড্রেসিংগাউন পরে ঘরে ঢুকল। বোঝাই যাচ্ছিল, আমাদের ওখানে দেখে ও খুব চটে গিয়েছে। বেশ কয়েকটা গালাগাল দিয়ে আমাদের ঘর থেকে প্রায় বের করে দিচ্ছিল। এই লোকটা আর কেউ নয়, স্বয়ং ইয়ান চ্যাপেল।

ওকে অমন উদ্ধত দেখে তর্ক জুড়ে দিলাম। তর্কের মাঝেই বললাম, ম্যালেটরা আমাদের পার্টিতে গিয়েছিল। আমরা ওদের হোটেলে পৌঁছে দিতে এসেছি। এর পর চলে এলাম আমরা। কিন্তু মেজাজটা স্বভাবতই খুব খারাপ হয়ে গেল।

অনেক বছর পরে, ১৯৭৭-এ ভারতের অস্ট্রেলিয়া সফরে ইয়ান চ্যাপেলের সঙ্গে আবার দেখা হয়েছিল। ও তখন প্যাকার-অজিদের ক্যাপ্টেন।

লায়ন্স অ্যাসিওরেন্স পার্টিতে আমি ওকে কলকাতার সেই রাতের কথা মনে করিয়ে দিলাম। বলা বাহুল্য, সেই ঘটনার কোনও স্মৃতিই ওর মনে ছিল না। খুব মিষ্টি ভাবে আমার সঙ্গে কথা বলে গেল। “টেস্ট ম্যাচ চললে এত লোক আমাদের ঘরে ঢুকে পড়ে যে মাঝে মাঝেই রূঢ় ব্যবহার করে ফেলি,” হাসতে হাসতে বলল ইয়ান। “যাক গে, একটা বিয়ার খাও আর ব্যাপারটা ভুলে যাও।”

চ্যাপেলের সঙ্গে আমার পরবর্তী সাক্ষাৎ ১৯৮০/৮১-র ত্রিদেশীয় সিরিজে। কুখ্যাত আন্ডারআর্ম বোলিং বিতর্কের সময়। ইয়ান তখন অবসর নিয়ে একটা সংবাদপত্রে লিখছে। আমরা বসেছিলাম ওর ঠিক পিছনের বক্সেই। আর ভাবছিলাম, ম্যাককেচনিকে আন্ডারআর্ম বল করার যে নির্দেশ গ্রেগ ওদের সবচেয়ে ছোট ভাই ট্রেভরকে দিয়েছিল, তাতে ইয়ান কী ভাবছে?

প্রচণ্ড খেপে গিয়েছিল ইয়ান। নিজের কলামে ভাইয়ের উদ্দেশ্যে লিখেছিল, ‘একটা ম্যাচ জিততে ক্রিকেটের স্পিরিটের কতটা বিরোধিতা করবে?’ ও যে প্রচণ্ড রেগে গিয়েছে, সেটা লুকনোর কোনও চেষ্টাই ইয়ান করেনি। নিজের কলামে ভারতীয়দের নিয়ে লিখেছিল, ‘ওরা আমাদের লাকি দেশ বলে। হ্যাঁ, আমাদের টাকা আছে। আর আমরা ক্রিকেটে টাকা ছড়াতে কার্পণ্য করি না। কিন্তু ওরা কেন এখানে এত নিচু দরের টিম পাঠায়?’ ঘটনা হল, মেলবোর্নের বিখ্যাত টেস্টের পর ভারত সিরিজটা ড্র করেছিল।

খেলায়োড়-জীবনেও ইয়ান বারবার শাসকদের বিরুদ্ধে লড়ত, যা মুখে আসত বলে দিত। আর এক বিতর্কিত অধিনায়ক টনি গ্রেগের সঙ্গে মাঠে আর তার পরে কমেন্ট্রি বক্সে ওর স্মরণীয় কিছু যুদ্ধ ছিল।

ইয়ান বরাবর বলত, অস্ট্রেলিয়ার হয়ে খেলা যে কোনও ক্রিকেটারের পক্ষে সবচেয়ে বড় সম্মান। সিডনিতে আমাদের এক বন্ধু ছিল লম্বা, হাসিখুশি হার্টলে অ্যান্ডারসন। নিজের বিশাল বাড়িতে প্রচুর লেটনাইট পার্টি দিত হার্টলে, যেখানে সব সময় ইয়ান হাজির থাকত। মাঝে মাঝে নিল হার্ভি আর ডগ ওয়াল্টার্সও। ইয়ান কোনও দিন রাগ পুষে রাখত না। মাঠের যাবতীয় ঝামেলা মাঠেই গালিগালাজ দিয়ে-টিয়ে শেষ করে দিত।

পরে ওর সঙ্গে ধারাভাষ্যকারের মাইক শেয়ার করেছি। তখন বুঝেছি মানুষ হিসেবে ইয়ান কী দারুণ! অস্ট্রেলিয়ান হিসেবে ওর জাত্যভিমান অবশ্য মারাত্মক। কমেন্টেটর হিসেবেও ও চাঁছাছোলা। এই যে কমেন্টেটরদের উপর ভারতীয় বোর্ডের নানারকম বিধিনিষেধ আছে ডিআরএস (ডিসিশন রেফারেল সিস্টেম) শব্দটা উচ্চারণ করা যাবে না, বোর্ড কর্তা বা নির্বাচকদের সমালোচনা করা যাবে না, এর জন্য তো ইয়ান এই সে দিন ভারতীয় বোর্ডের একটা প্রস্তাব ফিরিয়ে দিল।

ওর সঙ্গে আমার ক্রিকেট নিয়ে কথা তো হয়ই, গল্ফ আর টেনিস নিয়েও হয়। এই দু’টো খেলাকে ক্রিকেটের মতোই ও ভালবাসে। মাঝেমধ্যে বেসবল খেলাও ওর পছন্দ।

আর ভারতকে তো ও প্রচণ্ড ভালবাসে। এখনও মনে আছে ইয়ান চ্যাপেল, ডেভিড হুকস (এখন প্রয়াত) আর কয়েকজন ক্রিকেটপ্রেমীর জন্য সিসিএফসি একটা পার্ট দিয়েছিল। অন্যান্য অজিদের মতো ইয়ান অত মদ্যপান করত না। মাঝেমধ্যে একটু বিয়ার, বা এক গ্লাস ওয়াইন।

ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশন অব বেঙ্গলের একঘেয়ে সব অনুষ্ঠান থেকে পালিয়ে এই ক্লাবে সন্ধে কাটানো ছিল ওর খুব প্রিয়।

তবে আমার কাছে ইয়ানের সবচেয়ে বড় সম্পদ ছিল সেই সময়টা, যেটা ও তাদের সঙ্গে কাটাত, যারা ওর কাছ থেকে শিখতে চায়।

ক্লাবের একটা সকাল মনে আছে। নেটে তরুণ এক বাঙালি ব্যাটসম্যানকে দেখে প্রচুর উৎসাহ দিল ইয়ান। সেখানে ক্রিকেটলিখিয়ে পিটার রোবাকও ছিল। সব দেখেশুনে পিটার বলেছিল, “সত্যিই আমি বুঝতেই পারি না, লোকে চ্যাপেলিকে ক্রিকেটের ব্যাড বয় কেন বলে!”

ইয়ান চ্যাপেল নিয়ে একটা খুব মজার গল্প বলি শুনুন।

একটা টিভি চ্যাট শোয়ে হাজির ছিল অস্ট্রেলীয় সাংবাদিক, কমেন্টেটর মাইক কাওয়ার্ড, টাইগার পটৌডি, ইয়ান চ্যাপেল। সঙ্গে আমিও।

শো-এ কোনও একটা সময় স্যর ডন ব্র্যাডম্যানের নামটা এল। মনে হয় তেন্ডুলকর আর গ্রেটনেস নিয়ে আলোচনায় মাইক ওঁর নাম তুলেছিল। ওর দাদু স্যর ভিক রিচার্ডসনের সময় থেকেই ডনের সঙ্গে পারিবারিক ঝামেলা ইয়ানদের। তা সব শুনে সোজাসাপটা নির্বিকার মুখে ইয়ান বলে দিল, হ্যাঁ, আমি শুনেছি স্যর ডোনাল্ড ব্র্যাডম্যান বেশ ভালই ব্যাটসম্যান!

সম্পূর্ণ দায়বদ্ধতার চেয়ে কম কিছু দেখলে তার বিষাক্ত সমালোচনা করতে ভয় পায় না ইয়ান। ওর সঙ্গে আমার সম্পর্কর শুরুটা ভীষণ খারাপ।

আর এখন? ইয়ান কলকাতায় এলেই মুখিয়ে থাকি কবে ও একটা ড্রিংক নিয়ে আমার সঙ্গে ক্রিকেট-আড্ডায় বসবে।

অনুবাদ: প্রিয়দর্শিনী রক্ষিত

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

kishore bhimani ian chappall
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE