Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪

পেলেকে হতাশ করে ছেড়ে ছিলাম আমার স্ট্র্যাটেজি দিয়েই

মহাকাব্যিক পঁচিশ বছর! কখনও লাল-হলুদ, কখনও সবুজ-মেরুন। কখনও নীল জার্সির ভারত। পুরনো সেই সাম্রাজ্য বিস্তার আর তার ভাঙাগড়ার রুদ্ধশ্বাস কাহিনি নিয়ে দীর্ঘ এত বছর বাদে অকপট স্বয়ং প্রদীপকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়। আজ দশম কিস্তি। বেছে নিলেন তাঁর সেরা পাঁচ স্ট্র্যাটেজি, যা দিয়ে ঘায়েল করেছেন বাঘা বাঘা প্রতিদ্বন্দ্বীকেপেলের কসমস বনাম মোহনবাগান ম্যাচের রাতে গ্র্যান্ড হোটেলে ডিনার পার্টি। আমাকে দেখিয়ে ধীরেন দে-কে পেলে বলল, “এই ভদ্রলোকের টিম তো আমাকে আজ খেলতেই দিল না!” বলে নিজের পায়ের দিকে আঙুল দিয়ে বোঝাতে চাইল, ইডেনে সে দিন ওকে অপোনেন্ট মেরেধরে আটকেছে! আমি হেসে বললাম, “ঠিক আছে। দয়া করে এক বার তোমার পা-টা দেখাও। বুটের স্টাডের কোনও দাগ আছে কি না দেখব।”

বৃষ্টিভেজা ইডেন আর কড়া মার্কিং-এ ভাবেই সে দিন বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল ফুটবল-সম্রাটের

বৃষ্টিভেজা ইডেন আর কড়া মার্কিং-এ ভাবেই সে দিন বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল ফুটবল-সম্রাটের

অনুলিখন: সুপ্রিয় মুখোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ২২ নভেম্বর ২০১৪ ০০:০৫
Share: Save:

পেলের কসমস বনাম মোহনবাগান ম্যাচের রাতে গ্র্যান্ড হোটেলে ডিনার পার্টি।

আমাকে দেখিয়ে ধীরেন দে-কে পেলে বলল, “এই ভদ্রলোকের টিম তো আমাকে আজ খেলতেই দিল না!” বলে নিজের পায়ের দিকে আঙুল দিয়ে বোঝাতে চাইল, ইডেনে সে দিন ওকে অপোনেন্ট মেরেধরে আটকেছে!

আমি হেসে বললাম, “ঠিক আছে। দয়া করে এক বার তোমার পা-টা দেখাও। বুটের স্টাডের কোনও দাগ আছে কি না দেখব।”

ততক্ষণে আমাদের সেই আড্ডায় গোলকিপার শিবাজি এসে পড়েছে। পেলে এ বার হেসে গড়িয়ে পড়ে শিবাজিকে জড়িয়ে ধরে বলল, “না-না, এমনিই মজা করছিলাম। বরঞ্চ এই ছেলেটা আজ আমার একটা হেড আর ফ্রি কিক গর্ডন ব্যাঙ্কসের মতো সেভ করেছে!”

একেবারে ঠিক কথা। তবে পেলে যেটা সে দিন উল্লেখ করেনি, হয়তো কোথাকার কোন এক মোহনবাগানের কাছে আটকে গিয়ে ফুটবল-সম্রাটের পক্ষে উল্লেখ করাটা তার ইগোতেও বেধেছিল, সেটা হল ওই ম্যাচে আমার টিমের স্ট্র্যাটেজি। যা আমার দীর্ঘ কোচিং জীবনের অন্যতম সেরা স্ট্র্যাটেজি বলে আমি মনে করি।

পেলে-ম্যাচের জন্য পাঁচ দিন মাত্র সময় পেয়েছিলাম তৈরি হওয়ার। পাশাপাশি মাথায় রাখতে হচ্ছিল তার দিন কয়েক পরেই ইস্টবেঙ্গলের সঙ্গে শিল্ড ফাইনালকে।

কোরিয়া-জাপানে সহজে জিতে কসমস এখানে এসেছিল। দু’টো ম্যাচেই দু’টো দুর্দান্ত ফ্রি কিকে গোল করেছিল পেলে। ওই দু’টো ম্যাচের ক্লিপিংস জোগাড় করেছিলাম ইন্ডিয়ান নিউজ রিভিউ থেকে।

সেই সময় আমাদের এখানে প্রতিটা সিনেমা হল-এ আসল ছবির আগে পৃথিবীর নানান টাটকা বিষয় নিয়ে ইন্ডিয়ান নিউজ রিভিউ দেখানোটা একেবারে নিয়ম ছিল।

১১৫ x ৭৫ গজ ফুটবল মাঠকে পেলে-ম্যাচে আমি মোহনবাগানের কাছে ৭০ x ৫৫-এ কমিয়ে দিয়েছিলাম।

মানে উইং ব্যাক থেকে শুরু করে উইং হাফ, উইঙ্গারদের অনেকটা ভেতরে ঢুকিয়ে রেখেছিলাম। গোটা টিমে ফুটবলারদের মধ্যে ব্যবধান সর্বাধিক ১০ গজের বেশি রাখতে দিইনি।

লক্ষ্য ছিল, বিদেশিদের অনেক বেশি হাইট, স্পিডকে মাঠে কাল্পনিক ছোট ছোট জায়গা তৈরি করে তার ভেতর সামলানো।

জানতাম আমার ছেলেদের এক সেকেন্ডে সাত থেকে আট গজের বেশি জায়গা কভার করার ক্ষমতা নেই। সে জন্য কোনও দু’জন ফুটবলারের মধ্যে দশ গজের বেশি ব্যবধান রাখিনি গোটা ম্যাচে। যাতে পেলে এক জনকে টপকে গেলে কাছাকাছি থাকা আমার টিমের অন্য প্লেয়ার সঙ্গে সঙ্গে ওর গায়ে চলে আসতে পারে।

ছেলেদের বলে দিয়েছিলাম খবরদার মাঠটাকে বেশি বড় করতে যেয়ো না। নো উইং প্লে। সবাই ভেতরে খেলে কসমসকেও ভেতরে খেলতে প্রলুব্ধ করো। নইলে ওদের সঙ্গে এঁটে ওঠা সম্ভব নয়।

তবে ফুটবলের ভগবানকে আটকানোর সব টোটকা কি কেবল তার ভিডিও দেখেই বেরোয়? আজ স্বীকার করছি, বৃষ্টিভেজা ইডেনের মাঠ সেদিন একটা বিরাট ফ্যাক্টর হয়ে উঠেছিল আমার কাছে।

ফুটবলে স্ট্র্যাটেজি হল দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা। আর ট্যাকটিক্স হল স্বল্পমেয়াদি পরিকল্পনা। স্ট্র্যাটেজির পিছনে গুরুত্বপূর্ণ, কোচের হাতে কী ধরনের ফুটবলার আছে। সেখানে ট্যাকটিক্সের পিছনে থাকে সেই নির্দিষ্ট ম্যাচটা কিংবা সেই দিনটার সমস্ত কিছু— মাঠ, সারফেস, জল, হাওয়া, তাপমাত্রা, চোটআঘাত, কন্ডিশন... সব!

পেলে-ম্যাচে যেমন তার আগের ক’দিন কলকাতায় প্রচণ্ড বৃষ্টি হলেও খেলার দিন হয়নি। ফলে ইডেনের ঘাসের নীচে জল জমে ছিল।

এ রকম মাঠে বল পড়ে প্রথম বাউন্সে ঝড়াৎ করে স্কিড করবে। আবার দ্বিতীয় বাউন্সে বল-টা স্লো হবে। সে কারণে পেলে যে পেলে সে-ও সে দিন প্রথম বল-টা হোল্ড করার ঝুঁকি নেয়নি। সেকেন্ড বল নিয়ে নিজের ম্যাজিক দেখাতে চেয়েছে। সেটাই স্বাভাবিক। আর পেলে সেটা করবে বুঝে আমি হাবিব, গৌতম, সুব্রতদের মাঠে ঢোকার আগে পইপই করে বলে দিয়েছিলাম, পেলেকে সেকেন্ড বল-এ ট্যাকল করবি। আর শেষ সেকেন্ড পর্যন্ত কেবল বল-ই দেখবি। পেলের পা নয়।

কারণ, পেলের খেলায় এত বেশি ধোঁকা দেওয়া ব্যাপারস্যাপার আছে যে, ওর পায়ের মুভমেন্ট দেখে বোঝা সম্ভব নয়, কোন দিকে বডিফেইন্ট দেবে!

পেলেকে সে দিন ওর নিজের অর্ধেও ট্যাকল করার জন্য লোক রেখেছিলাম। প্ল্যানটা ছিল— পেলে নিজের জোনে বল ধরলে হাবিব সেখানে ট্যাকল করবে।

আর মোহনবাগান অর্ধে পেলেকে প্রথমে গৌতম, তার পর সুব্রত, সব শেষে প্রদীপ চৌধুরী ট্যাকল করবে। যেহেতু এদের মধ্যে চৌধুরীর স্লাইডিং ট্যাকল সবচেয়ে ভাল ছিল। জল-কাদার মাঠে ওর ‘ছ্যাররা’ একেবারে অব্যর্থ।

ফুটবলের মজা হল, তুমি যত বড় ওস্তাদ প্লেয়ারই হও না কেন, ম্যাচের প্রথম দশটার মধ্যে ছ’-সাতটা ট্যাকলে যদি বিপক্ষের কাছে হেরে বসো, তোমার ভেতরে একটা হতাশ ভাব আসবেই। যার থেকে তোমার খেলার ছন্দও নষ্ট হবে। পেলের সে দিন হুবহু সেটাই হয়েছিল।

আর পেলে যেই পেলের মতো খেলতে পারল না, ওর সব নামীদামি টিমমেটও নিজেদের তিরিশ শতাংশও খেলতে ব্যর্থ হল। কিনালিয়া, টনি ফিল্ড... প্রায় সবাই।

তাদের মধ্যে স্কটল্যান্ডের বিশ্বকাপার ফরোয়ার্ড টনি ফিল্ডকে প্রায় নড়তে দেয়নি সুধীর কর্মকার। ম্যাচের শেষ পনেরো মিনিটে বক্সে ওকে সুধীরের একটা পরিস্কার স্লাইডিং ট্যাকল সত্ত্বেও রেফারি লক্ষ্মীনারায়ণ ঘোষ পেনাল্টি না দিলে ম্যাচটা পেলের টিম সে দিন ড্র করেও ফিরতে পারত না।

তবে সে বছর পেলেকে আটকে দেওয়ার পর থেকেই আমার ছেলেদের মধ্যে একটা অদ্ভুত আত্মবিশ্বাস তৈরি হয়েছিল। যার জোরে শিল্ড, রোভার্স কাপ চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর মোহনবাগান সেই মরসুমে ডুরান্ড ফাইনালে ওঠায় ভারতীয় ফুটবলে প্রথম একক ক্লাব হিসেবে ত্রিমুকুট জেতার দোড়গোড়ায় পৌঁছে যায়।

কিন্তু দিল্লির মাঠে ফাইনালটা ছিল জেসিটি-র বিরুদ্ধে। ইন্দর সিংহের জেসিটি!

সর্বকালের অন্যতম ফাইনেস্ট ভারতীয় স্ট্রাইকার ইন্দর। দিল্লির মাঠে পিছনে গ্যালারি ভরা সাপোর্টার নিয়ে ইন্দরের পক্ষে একটা ডিফেন্ডার টপকানো কোনও ব্যাপারই ছিল না। দুর্দান্ত আউটসাইড-ইনসাইড ডজ ছিল। তেমনই প্রচণ্ড স্পিড আর শু্যটিং পাওয়ার।

ও রকম এক জন দুর্ধর্ষ স্ট্রাইকারকে সাতাত্তরের ডুরান্ড ফাইনালে তার ঘরের মাঠে বোতলবন্দি করেছিলাম গৌতম আর প্রদীপ চৌধুরীকে দিয়ে ডাবল কভারিং করে।

গৌতমকে বলা ছিল, ইন্দরকে ওপরে ট্যাকল করবি। মানে মোহনবাগানের মিডল-থার্ডে। তার পরেও যদি ইন্দর আমার দলের ডিফেন্সিভ থার্ডে ঢুকে পড়ে, তখন সেখানে ওকে ধরবে পি চৌধুরী। ওর সেই বিখ্যাত স্লাইডিং ট্যাকলে। যে ট্যাকলের ‘রিচ’ ভারতীয় ফুটবলে আমার দেখা দীর্ঘতম।

তবে প্রতিটা মোহনবাগান ফুটবলারকে সে দিন বলে দিয়েছিলাম, ইন্দরকে কোনও অবস্থায় বক্সের ভেতর ট্যাকল করতে যেয়ো না। ওকে সব ফাইনাল ট্যাকল মোহনবাগান বক্সের বাইরে করতে হবে।

কারণ, দিল্লির মাঠে ইন্দরকে বক্সের ভেতর ট্যাকল মানেই একশো বারের মধ্যে নিরাবব্বই বার জেসিটি পেনাল্টি পাবে। সে রকমই বন্দোবস্ত তখন দিল্লির ফুটবলমহলে তৈরি থাকত! আমার স্ট্র্যাটেজি সে দিন অক্ষরে-অক্ষরে পালন করেছিল টিম। আর গৌতম-পি চৌধুরীর বিরুদ্ধে ম্যাচের প্রথম দশটা ট্যাকলে ছ’-সাত বার ‘বিট’ হয়ে সে দিন ইন্দরের মনের অবস্থা অনেকটা পেলের মতোই হয়েছিল। মানে কিছুটা হতাশ হয়ে পড়েছিল। যার প্রভাব ওর খেলাতেও পড়েছিল সেই ম্যাচে। আর ইন্দর আটকে যেতেই জেসিটির খেলাও অর্ধেকে নেমে এসেছিল। মোহনবাগান তাঁবুতে ঢুকেছিল ঐতিহাসিক ত্রিমুকুট।

’৭৯-র মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গল

দিল্লির মাঠে ইন্দরকে আটকে ম্যাচ বার করা মানে অনেকটা বাঘের গুহায় ঢুকে বাঘের বাচ্চা চুরি করে আনা! আর সেটা যদি ত্রিমুকুট জয়ের ম্যাচ হয় তা হলে তার চাপ কী সাংঘাতিক নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন। কিন্তু আমার মনে হয়, তার চেয়েও বেশি চাপের ছিল পঁচাত্তরে টানা ছ’বার লিগ জিতে বিরল রেকর্ড গড়ার দোড়গোড়ায় দাঁড়িয়ে থাকা ইস্টবেঙ্গলের কাছে সে বার মহমেডান ম্যাচটা!

কারণ, সে বছরই ইস্টবেঙ্গল ছেড়ে হাবিব-আকবর মহমেডানে গিয়ে উঠেছিল। যারা দুই ভাই কিনা তার আগের পাঁচ বার (আমার কোচিংয়ে তিন বার) ইস্টবেঙ্গলের লিগ জয়ের অন্যতম শক্তি। তার ওপর হাবিব-আকবর আবার রাগ দেখিয়ে ইস্টবেঙ্গল ছেড়েছিল। লিগে দেখে নেবে— এ রকম এক রকম চ্যালেঞ্জ ছুড়ে!

কিন্তু হাবিব যতই হাবিব হোক, কিংবা অ্যাটাকের সময় আকবরের সঙ্গে হাবিবের যতই টেলিপ্যাথি যোগাযোগ আর বোঝাপড়া থাকুক না কেন, ওই ম্যাচে আমার ইস্টবেঙ্গল ডিফেন্সও ছিল দুর্ধর্ষ।

দুই স্টপার শ্যামল ঘোষ আর অশোকলাল বন্দ্যোপাধ্যায়। দু’জন সাইড ব্যাক সুধীর আর কাজল ঢালি। এদের মধ্যে শ্যামল আর অশোককে দিয়ে আমি হাবিবকে ডাবল কভারিংয়ে রেখে দিয়েছিলাম সেই ভয়ঙ্কর গুরুত্বপূর্ণ আর চাপের লিগ ম্যাচে।

শ্যামলের বাঁ-পায়ের প্রচণ্ড জোরালো ট্যাকলে হাবিবের তীক্ষ্নতা প্রায় অর্ধেক হয়ে গিয়েছিল। আর শ্যামলের কড়া ট্যাকলে হাবিব যেই একটু নড়বড়ে হয়ে উঠছিল, বারবার পিছন থেকে সেকেন্ড বল-টা ফুল ক্লিয়ার করে দিচ্ছিল অশোকলাল।

‘হেডমাস্টার’ অশোকলালের খেলাটা ছিল প্রখর বুদ্ধিদীপ্ত। ফলে হাবিব ডাবল কভারিংয়ে এক দিকে শ্যামলের শক্তিশালী ট্যাকল, অন্য দিকে অশোকলালের বুদ্ধির সামনে পড়ে নিজের খেলার চল্লিশ শতাংশও সে দিন খেলতে পারেনি।

আর হাবিব অকেজো হয়ে পড়া মানেই আকবরও গেল! আকবরের শু্যটিং পাওয়ার যতই আন্তর্জাতিক স্ট্যান্ডার্ডের হোক না কেন, ও বরাবরের ‘ডিপেনডেন্ট’ ফরোয়ার্ড। মানে ওকে কাউকে বল খাওয়াতে হবে। তবেই ও গোল করতে পারত। নিজে বল তৈরি করে গোল করত না সে ভাবে।

হাবিব যেহেতু দশ বার বল পেলে ন’বারই পরের পাসটা আকবরকে দিত, সে কারণে আমার দুই মিডিও গৌতম-পিন্টুকে (সমরেশ চৌধুরী) ওই ম্যাচে বলা ছিল, হাবিব বল পেলেই আকবরকে তাড়া করতে। হাবিবকে শ্যামল-অশোকলাল বুঝে নেবে। তোরা ওই সময় সেকেন্ড বলটার জন্য আকবরকে কভার কর।

আর ঠিক সেটাই বাস্তবে ঘটেছিল সে দিন ম্যাচে। হাবিব গোটা ম্যাচে যে তিন-চার বার মাত্র শ্যামল কিংবা অশোকলালকে ‘বিট’ করতে পেরেছিল, প্রতিবারই পরক্ষণে আবিষ্কার করেছে, আকবরের ঘাড়ের কাছে হয় গৌতম, নয়তো পিন্টু। সেকেন্ড বলটা প্রিয় সহোদরকে আর দেবে কী ভাবে?

ম্যাচটা ৩-১ জিতে ইস্টবেঙ্গল টানা ছ’বার লিগ জয়ের রেকর্ড কার্যত পাকা করে ফেলেছিল সে দিন।

এ রকম আর একটা মনে রাখার মতো স্ট্র্যাটেজি ঊনআশিতে ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগান ম্যাচে সে মরসুমে বিধ্বংসী ফর্মে থাকা সুরজিৎ সেনগুপ্তকে আটকানো!

সুরজিৎ সেবার ইস্টবেঙ্গলে। সঙ্গে চিন্ময়, শ্যামল, গুরদেব, মনোরঞ্জন, প্রশান্ত, দেবরাজ, মিহির, হরজিন্দর, মনজিৎ, ডেভিড উইলিয়ামস— সারা ভারতের সব নামীদামি ফুটবলার। কিন্তু দিলীপ পালিতের ‘রোবাস্ট’ তবে মোটেই পা টার্গেট করা ট্যাকল নয়— সেই টোটকায় সুরজিৎকে সে বার আটকে দিতে পেরেছিলাম।

এখানে একটা কথা বলে রাখি— কোচ হিসেবে আমি বরাবর পা লক্ষ করে ট্যাকলের ঘোরতর বিরোধী। আমার চোখে ওটা ফুটবল স্কিল নয়, বরং গুন্ডামি!

আমার মোহনবাগানে সেবার পালিত ছাড়াও ডিফেন্ডার খেলত সুব্রত, প্রদীপ চৌধুরী, শ্যামল বন্দ্যোপাধ্যায়রা। রাইট ব্যাক শ্যামলের স্পিড ছিল অনেক ফরোয়ার্ডের চেয়েও বেশি! বিপক্ষের অ্যাটাকারকে তাড়া করে ধরে কার্যত তার শরীরের ভেতর ঢুকে তাকে আটকানোর অনবদ্য ক্ষমতা ছিল। অন্য দিকে লেফট ব্যাকে পালিতের ছিল অ্যাটাকারের পা খুলে দেওয়ার মতো শক্তিশালী ট্যাকল।

সুরজিৎ যত বড় রাইট উইঙ্গার, ততটাই ভাবুক প্রকৃতির ছেলে। ওকে আপন মনে খেলতে দিলেই সর্বনাশ। অপোনেন্টের সব কিছু লন্ডভন্ড করে দেবে। সে জন্য সুরজিতের জন্য আমার স্ট্র্যাটেজি ছিল, কিছুতেই ওকে নিজের ছন্দে খেলতে দেওয়া চলবে না।

নইলে আমার মতে, পি কে বন্দ্যোপাধ্যায়ের পরেই ভারতের সর্বকালের সেরা রাইট আউট হওয়ার স্কিল ছিল সুরজিতের মধ্যে। ওর পায়ে এমন কয়েকটা অসাধারণ ড্রিবল ছিল যা আমিও করতে পারতাম না। প্রচণ্ড গ্রেসফুল ফরোয়ার্ড। পুরো খেলাটাই নয়নাভিরাম।

কিন্তু এন্ড প্রোডাক্টটা মানস বা বিদেশের মতো হতে পারেনি কোনও দিন। যে-হেতু পরপর কয়েকটা কড়া ট্যাকলের সামনে পড়লে নিজেকে গুটিয়ে ফেলত। গৌতম কিংবা হাবিবের মতো দুর্জয় সাহস দেখিয়ে বিপক্ষের রোবাস্ট ট্যাকলকে অকুতোভয় চ্যালেঞ্জ জানায়নি বেশির ভাগ সময়ই।

যে জন্য ঊনআশির দুর্দান্ত ফর্মে থাকা সুরজিৎকেও দিলীপ পালিতের কড়া ট্যাকল প্রয়োগ করে আটকে দেওয়া সম্ভব হয়েছিল।

আর একটা ব্যাপার—সুরজিতের ডান আর বাঁ পায়ের স্কিলের তফাত অনেকটা বেশি। যে কারণে, ট্যাকল এড়াতে বল ডান পা-বাঁ পা করতে করতে শেষমেশ কিন্তু সেই ডান পায়েই চূড়ান্ত বল কন্ট্রোলটা রাখতে চেষ্টা করত। ফলে সেই ইস্ট-মোহন ম্যাচে লেফট ব্যাক পালিতের পক্ষে রাইট আউট সুরজিতকে আটকাতে আরও সুবিধে হয়েছিল। পালিতের লেফট্ ফুট ট্যাকল ছিল ভয়ঙ্কর!

ভারতের কোচ হিসেবে আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টে একটা ম্যাচের কথাও মনে পড়ছে। বিরাশিতে প্রথম নেহরু কাপে যুগোস্লাভিয়াকে হারানোর স্ট্র্যাটেজি।

সে ম্যাচের একটা সময় কিছুক্ষণ অদ্ভুত একটা স্ট্র্যাটেজি নিয়েছিলাম। যা এ দেশে আর কেউ কোথাও করেছে বলে শুনিনি।

একই উইংয়ে জোড়া উইঙ্গার খেলিয়েছিলাম! রাইট আউটে একইসঙ্গে মানস-বিদেশকে ব্যবহার করেছিলাম।

আসলে যুগোস্লাভ লেফট ব্যাককে টুর্নামেন্টে লক্ষ করেছিলাম, এত বেশি অ্যাটাকিং যে, প্রায়শই ওভারল্যাপে তো যায়ই। অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসের কারণে নীচে নামার প্রয়োজনও বেশি দেখায় না। সে দিন ওকে আমি ম্যাচের প্রথম দিকে সেটাই অ্যালাউ করে যখন ও সেই মোড-এ চলে গিয়েছে, মানে শুধুই ওভারল্যাপ আর ওভারল্যাপ, বেশি নীচে নামাটামা মাথায় প্রায় নেই, তখনই আমি ওর দিকে মানস-বিদেশ দু’জনকেই খেলিয়েছিলাম।

বিদেশের প্রচণ্ড স্পিডের সঙ্গে সঙ্গে তেমনই অসাধারণ পেরিফেরিয়াল ভিশন। আর মানসের মতো চটপটে উইঙ্গার আমি কোচিং জীবনে খুব কম পেয়েছি। অ্যাটাকিং থার্ডে এমন-এমন জায়গায় চলে যাওয়ার অদ্ভুত ক্ষমতা ছিল, যে পজিশনগুলোকে ফুটবলের ভাষায় বলে ব্লাইন্ড স্পট বা ব্ল্যাকহোল! যে জায়গায় অপোনেন্ট অ্যাটাকার ঢুকে পড়লে ডিফেন্ডার এমনকী গোলকিপারও খেই পায় না কী করবে!

এখন টিভিতে দেখি আটলেটিকো দে কলকাতার ফিকরু কিংবা আইএসএলের চল্লিশ বছরের বুড়ো ফরোয়ার্ড আনেলকা মাঝেমধ্যে ঠিক এ রকম ব্লাইন্ড স্পটে পৌঁছে গিয়ে গোল করছে বা গোল করাচ্ছে।

সে দিন যুগোস্লাভ ম্যাচে মনোরঞ্জনের পেনাল্টি গোলের পিছনে মানসের ও রকম পজিশনে পৌঁছে যাওয়াটাই আসল। যার থেকেই ভারত পেনাল্টি পায়। পরে মানসের পেনাল্টি কিকের পিছনে আবার বিদেশের ব্লাইন্ড স্পটে ঢুকে পড়ে ওকে বক্সে ফাউল করতে বাধ্য করাটাই আসল কৃতিত্বের!

ছাপান্নর মেলবোর্ন অলিম্পিকের পর সিডনিতে ভারত একটা প্রদর্শনী ফুটবলে অস্ট্রেলিয়াকে সাত গোলে হারিয়েছিল! বদ্রুদা (বন্দ্যোপাধ্যায়) তিনটে আর আমি চার গোল করেছিলাম।

সেই ম্যাচে রহিম সাহেব রাইট আউট আমার এক রকম গায়েই রাইট ইনসাইড বদ্রুদাকে খেলিয়েছিলেন। কার্যত ডাবল রাইট আউট স্ট্র্যাটেজি! যার ধাক্কায় অস্ট্রেলিয়া উড়ে গিয়েছিল।

ছাব্বিশ বছর বাদে সেই স্ট্র্যাটেজি আমি বাক্স থেকে ঝেড়েঝুড়ে বার করেছিলাম!

(চলবে)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

pk banerjee pele supriyo mukhopadhyay
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE