Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

শ্রীচরণেষু

শব্দটাই লোপ পেয়েছে। চিঠির যে মৃত্যু হয়েছে আধুনিক যুগে! লিখছেন সমরেশ মজুমদার‘মাগো, আমার খুব কস্ট হচ্ছে।’ তখন আমার সাড়ে চার বছর বয়স। বৃদ্ধ পিতামহ তাঁর বিধবা বড় মেয়েকে আমার দায়িত্ব দিয়ে চা-বাগানের বাড়ি থেকে জলপাইগুড়ি শহরে নিয়ে এসেছিলেন ভাল স্কুলে পড়িয়ে মানুষ করবেন বলে। মা-বাবার কাছ থেকে চলে আসার পরের দিন থেকেই বুকে কান্না বাজত। তিন দিন পরে একটা পোস্টকার্ড ঠাকুরদার টেবিলে পেলাম। যার একটা দিকে কেউ লিখেছিল, ঠিকানার পাশের জায়গাটা ফাঁকা।

শেষ আপডেট: ১৫ অগস্ট ২০১৪ ০০:০৫
Share: Save:

‘মাগো, আমার খুব কস্ট হচ্ছে।’

তখন আমার সাড়ে চার বছর বয়স। বৃদ্ধ পিতামহ তাঁর বিধবা বড় মেয়েকে আমার দায়িত্ব দিয়ে চা-বাগানের বাড়ি থেকে জলপাইগুড়ি শহরে নিয়ে এসেছিলেন ভাল স্কুলে পড়িয়ে মানুষ করবেন বলে।

মা-বাবার কাছ থেকে চলে আসার পরের দিন থেকেই বুকে কান্না বাজত। তিন দিন পরে একটা পোস্টকার্ড ঠাকুরদার টেবিলে পেলাম। যার একটা দিকে কেউ লিখেছিল, ঠিকানার পাশের জায়গাটা ফাঁকা।

সেই ফাঁকা জায়গায় ধরে ধরে আমি আমার জীবনের প্রথম চিঠিটি লিখেছিলাম। কষ্ট বানান যে ‘কস্ট’ হয়ে গেছে তাতে কিছু এসে যায়নি।

একবার ব্যবহৃত পোস্টকার্ড যে আবার পাঠানো যায় না, এই জ্ঞান বড়পিসিমা দিলে সেটা রেখে দিয়েছিলাম নিজের কাছে।

নতুন পোস্টকার্ডে ওই কথাগুলো লিখতে তিনি উৎসাহ দেননি। বলেছিলেন, “ওই কথাগুলো পড়লে তোর মা খুব কাঁদবে।” আমার প্রথম চিঠি পোস্ট করা হয়নি।

কিন্তু প্রথম চিঠি লিখেছিলাম সেই বছরেই। পুজোর আগে চা-বাগানে গিয়েছিলাম। খুব হই চই। বিসর্জন হল। পরের সকালে মা একটা কাগজ এগিয়ে দিয়ে বললেন, “তুই এইখানটায় লেখ।”

“কী লিখব?”

“প্রত্যেকবারই তো ভাসান দেখে এসে দাদু পিসিমাকে প্রণাম করিস। এবার ওঁরা এখানে নেই, তাই বিজয়ায় চিঠি লিখতে হবে। ওপরে আমি লিখেছি, নীচে তুই লেখ।”

মা ডিকটেশন দিলেন, আমি লিখলাম, “পরমপূজনীয় দাদু এবং পরমপূজনীয়া বড় পিসিমা, তোমরা আমার বিজয়ার প্রণাম গ্রহণ করিও। আমি ভাল আছি। ইতি, সেবক, সমরেশ।”

খামবন্দি হয়ে সেই চিঠি কাজের লোক যখন পোস্ট অফিসে নিয়ে গেল আমি সঙ্গী ছিলাম। পোস্ট অফিসের সামনে ঝোলানো একটা লাল লম্বা টিনের বাক্সের গর্তে খাম ফেলে দিতেই ওটা চোখের আড়ালে চলে গেল।

ওই বাক্স থেকে খামটা কী করে জলপাইগুড়ির বাড়িতে পৌঁছে যাবে তা জানা ছিল না। পৃথিবীতে এরকম মজার ব্যাপার অনেক হয় বলে মনে হয়েছিল।

ঠিকানা লিখে মা একগাদা পোস্টকার্ড দিয়েছিলেন। আমার বড় হওয়ার বছরগুলোতে সেই সব পোস্টকার্ডে প্রথম দিকে পরমপূজনীয়া মা লিখতাম, নাকের নীচে গোঁফের মৃদু আভাস ফুটতেই ওটা হয়ে গিয়েছিল শ্রীচরণেষু মা।

বৃত্ত বাড়ছিল। যত বড় হচ্ছি তত আত্মীয়দের সন্ধান পাচ্ছি। ফলে বিজয়াদশমীর পরে একই গত-এ লেখা চিঠিগুলো চলে যেত নদিয়ায়, কলকাতায়। এক টাকায় অনেকগুলো পোস্টকার্ড পাওয়া যেত।

লাইব্রেরির সমুদ্রে ঢুকে যখন হাবুডুবু খাচ্ছি তখন জানলাম চিঠিপত্রও সাহিত্যের একটা শাখা। পত্রসাহিত্য।

ক্লাস নাইনেই সেই পত্রসাহিত্যের সন্ধান পেয়ে গেছি। আর তখনই আবিষ্কার করলাম, বিশেষ দুইজন ছাড়া আমি আর বিজয়ার চিঠি লিখছি না।

আমার চিঠি লেখা প্রবল ভাবে শুরু হল বন্ধুদের অনুরোধে। তিস্তার চরে যখন কাশবনের জঙ্গল, কাশফুল হাওয়ায় দুলছে, তার মধ্যে বসে আড্ডা মারতাম বছর পনেরোর কয়েক জন।

একটা সিগারেট ধরিয়ে সবাই মিলে টান দিতাম আর কাশতাম। বেশ নিষিদ্ধ আনন্দ উপভোগ করা যেত।

হঠাৎ গোবিন্দ এসে বলল, “সমস্যায় পড়েছি। সমরেশ, তুই তো খুব পড়িস। জমিয়ে এই চিঠির একটা উত্তর লিখে দে তো!”

সে যে খাম এগিয়ে দিল তার শরীর থেকে মিষ্টি গন্ধ বের হচ্ছিল। খাম খুলে দেখলাম চিঠির শুরুতে লেখা, “আমার প্রাণভ্রমর, নীচে শেষ হয়েছে, তোমার প্রাণপাপিয়া।”

অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, “এ কীরে! কে লিখেছে, কাকে লিখেছে, কোনও নাম নেই যে?” গোবিন্দ গম্ভীর হয়ে বলল, “নামে কি এসে যায়? আমি তো জানি। তুই কায়দা করে লেখ।”

বুঝলাম, এর নাম প্রেমপত্র। চিঠিটা পড়ে রোমাঞ্চিত হলাম। আহা কী আবেগ, শিশিরের জলে চোখ ধুলেই তোমাকে দেখতে পাই। তারপর মনে হল একটু চেনা লাগছে লাইনগুলো। বুঝলাম যে লিখেছে সে শেষের কবিতা পড়েছে।

তখন আমায় পায় কে? ওই কাশবনে বসে বালির চরে বই রেখে তার উপর ক্লাসের খাতার পাতা ছিঁড়ে চিঠি লিখে ফেললাম।

সেটা পড়া হল, সবাই তারিফ করল। সযত্নে গোবিন্দ ভাঁজ করে বুকপকেটে রাখল। জিজ্ঞাসা করলাম, “পোস্ট করবি?” সে বলল, “না রে, ওর ছোট বোনের হাতে দিয়ে দেব।”

তিন দিন পরে আমার লেখা চিঠির উত্তর এল। পনেরো বছরের মেয়ে (তথ্যটা গোবিন্দ বলেছিল) চিঠি পড়ে সারা রাত আকাশের তারা গুনে গেছে। অতএব উত্তরটা লিখতে হল।

গোবিন্দর নির্দেশে কাকে লিখছি, কার হয়ে লিখছি তাদের নাম দেওয়া চলবে না। কিন্তু সমস্যা বাড়ল। আমার আর এক বন্ধু প্রেমপত্র নিয়ে এল। প্রেমিকার বয়স চোদ্দো। সেই বয়সে সে দুর্গেশনন্দিনী পড়ে ফেলেছে।

এই উত্তর লেখার খেলায় আমাকে সাহায্য করেছেন অনেকেই। যেমন যাযাবর। তাঁর দৃষ্টিপাত-এর অনেক লাইন আমি চিঠিগুলোতে সাজিয়ে দিয়েছি।

আমার খাতির বাড়ল। সবাই সিগারেটে একটা টান দিচ্ছে, দুটো টান আমার জন্য বরাদ্দ। কিন্তু আমার পরিশ্রম বেড়ে গেল।

বাবুপাড়া পাঠাগার থেকে যাবতীয় প্রেমবিষয়ক কবিতার বই বাড়িতে আনতে শুরু করলাম ‘ওমর খৈয়ামের অনুবাদ’ পড়ছি আর কোটেশনগুলো খাতায় ঝাড়ছি।

শেষ পর্যন্ত লাইব্রেরিয়ান সুনীলদা বললেন, “তোমার কী হল? হঠাৎ কবিতা পড়ছ। আরে বাংলা কবিতা রবীন্দ্রনাথ ছাড়া পড়ে কোন লাভ হবে?”

মূর্খের মতো বলেছিলাম, “শুনেছি ওঁর কবিতায় শুধু ফিলজফি থাকে!” রেগে গেলেন সুনীলদা। সঞ্চয়িতা বের করে পাতা খুলে আমার সামনে ধরে বললেন, “পড়ো তো!” নিমন্ত্রণ পড়ে আমি অবাক, এ তো আমাদের কথা। কোথায় ফিলজফি!

সেদিন বাড়িতে সঞ্চয়িতা এনেছিলাম। আর পরের দিন তিস্তার চরে বসে বন্ধুর জন্য প্রেমপত্রের শেষে লিখতে পেরেছিলাম, এ চিঠির নেই জবাব দেওয়ার দায়। আপাতত এটাকে ড্রয়ারে রেখে দাও।

যদি পারো শব্দবিহীন পায়ে এসে আমার চোখ পেছন থেকে টিপে ধরো। পারবে কি?

যার হয়ে লিখলাম সে বলল, “তুই তো লিখে দিলি। কিন্তু ও কী করে আসবে? আমাদের বাড়িতে তো আসবেই না। তাছাড়া স্কুলে যাওয়া-আসার সময় কাজের মেয়ে সঙ্গে থাকবে, চান্সই পাবে না।”

বললাম, “ওটা লিখতে হয়, রবীন্দ্রনাথও লিখেছেন।”

“রবীন্দ্রনাথ?” খিঁচিয়ে উঠল সে। আমি উত্তরটা দিইনি।

কিন্তু ওই চিঠি যে মেয়েটির বাবা মায়ের কাছে পৌঁছে যাবে, ক্ষিপ্ত হয়ে তাঁরা মেয়েকে জিজ্ঞাসা করে যখন জানবেন সে নাকি কিছুই জানে না, তখন কাজের মেয়ে বলল, রথীন নাকি তাকে একবার বলেছিল চিঠিটা দিদিমণিকে পৌঁছে দিতে। সে রাজি হয়নি।

রথীন পাড়ার ছেলে। সে অস্বীকার করায় ওঁরা চলে এলেন হেডমাস্টারমশাইয়ের কাছে। তিনি রথীনকে জেরা করলেন, সে যেন আকাশ থেকে পড়ল। মেয়েটির বাবা রথীনের হাতের লেখার সঙ্গে চিঠির লেখা মেলাতে চাইলেন, মেলানো হল। দেখা গেল আসমান জমিন ফারাক।

রথীন তখন ক্ষুব্ধ হয়ে বলল, “স্যর ওঁরা আমাকে অযথা অপমান করলেন।”

হেডমাস্টারমশায় বললেন, “আপনারা ভুল করেছেন। তবে এই চিঠি যে লিখেছে তার সাহিত্যজ্ঞান খুব ভাল। এই ভাষায় চিঠি লেখার ক্ষমতা আর যার থাকুক, রথীনের নেই।”

বলা বাহুল্য, রথীনের প্রেমপর্ব সেখানেই শেষ হয়ে গিয়েছিল। তবে তাকে অকারণে বিষণ্ণ হতে দেখিনি কিন্তু আমার মন খারাপ হয়ে গিয়েছিল। যে ক’জন মেয়েকে আমি চিঠি লিখলাম তাদের মধ্যে সব চেয়ে ভাল চিঠি লিখত এই মেয়েটি।

কলকাতায় পড়তে এসে চিঠি লিখতে বাধ্য হতাম। তখন টেলিফোনের চল ছিল না। ট্রাঙ্ক কলে কথা বলা ভাগ্যের ব্যাপার ছিল। প্রত্যেক মাসের চিঠির ভাষা এ রকম ছিল, “শ্রীচরণেষু বাবা, তুমি ও মা আমার ভক্তিপূর্ণ প্রণাম নিও। আমি ভাল আছি। এই মাসে কয়েকটা বই কিনতে হবে। তাছাড়া জুতোটাও ছিঁড়ে গেছে। তুমি যদি আরও পঞ্চাশ টাকা বেশি পাঠাও তাহলে উপকার হয়। ইতি—।”

প্রথম দিকে ফাঁপড়ে পড়তাম, শুরুতে প্রণাম জানিয়ে শেষে আবার প্রণাম লেখাটা ঠিক হবে কিনা। বাড়াবাড়ি হবে বলে লিখতাম না।

আমি প্রথম প্রেমপত্র পাই একুশ বছর বয়সে। যার কাছ থেকে পেয়েছিলাম তার সঙ্গে কফিহাউসের সূত্রে বন্ধুত্ব হয়েছিল মাত্র। ভালবাসাবাসি নিয়ে কোনও কথা বলার আগেই সে জানিয়েছিল তার বিয়ে ঠিক হয়েছে। আমি কী বলব শুনতে চেয়েছিল।

আমি বলেছিলাম, “এখনই?”

সে বলেছিল, “বুঝেছি। কিন্তু তুমি ভুল করছ।”

তারপর এল তার চিঠি। সুন্দর হাতের লেখায় কয়েক পাতা ধরে লিখেছে সে মোটেই ভাল মেয়ে নয়। তার জীবনে অনেক তরুণ, পুরুষ এসেছে। তাদের সংখ্যা আটের কম নয়। আমার মতো ভাল ছেলেকে ঠকাতে চায় না বলে সে জানিয়েছিল। আমি হতভম্ব। ওর যে আট জন প্রেমিক ছিল কখনওই বুঝতে পারিনি। এক বন্ধু বলেছিল, সব মিথ্যে কথা। পাত্র হিসেবে তোর কোনও দাম নেই বলে মিথ্যে লিখে কাটাতে চেয়েছে। হয়তো তাই হবে, জানি না।

আমার লেখালেখি জীবনটাই শুরু হত না একটা চিঠির জন্য। প্রথম গল্প ‘দেশ’ পত্রিকায় জমা দেওয়ার নয় মাস পরে গল্প সম্পাদক শ্রী বিমল কর জানিয়েছিলেন ছাপা হবে। তখন দেশ-এ গল্প বের হলে হইচই পড়ে যেত।

ক’দিন পরে ‘দেশ’ থেকে চিঠি এল। আমার গল্প অমনোনীত হয়েছে। তবে ভবিষ্যতে যেন সহযোগিতা করি। হতাশ হয়ে লেখা ছেড়ে দেব ভেবেছিলাম। এক বন্ধুর পরামর্শে বুথ থেকে ফোন করে বিমলদাকে খুব গালাগাল দিয়েছিলাম মিথ্যে স্তোক দেওয়ার জন্য। তারপর জানলাম পিওন ভুল করে প্রেসে দেওয়ার বদলে বাড়িতে গল্পটা পাঠিয়ে দিয়েছিল। সেই চিঠি আজও আমার কাছে রয়েছে।

এখন আর চিঠি লিখি না। মুঠোফোন আসার পর দরকারও পড়ে না। এমনকী কম্প্যুটারের মাধ্যমে যেসব চিঠি পাই তাতে লেখকের সই থাকে না। আচ্ছা রবীন্দ্রনাথ যদি এই সময় থাকতেন তাহলে কি তিনিও চিঠি লেখা বন্ধ করতেন?

সেদিন পুরোন বাক্স ঘাঁটছিলাম। বালক বয়সের অনেক স্মৃতি তাতে রয়ে গেছে। একটি কবিতার লাইন পড়লাম। কোন সে যক্ষ বারতা পাঠাত মেঘের ডানায় ডানায়। কার কবিতার লাইন? একটা সুতোয় বাঁধা মায়ের অনেকগুলো চিঠি। তখন আমি স্কুলের নিচু ক্লাসে। কেন রেখে দিয়েছিলাম?

হঠাৎ হাতে উঠে এল সেই পোস্টকার্ডটা। যার ঠিকানা লেখার দিকে আমার সাড়ে চার বছরের আঙুলগুলো লিখেছিল, ‘মাগো, আমার খুব কস্ট হচ্ছে।’

বুকের মধ্যে শৈশব টলমল করে উঠল। বৃষ্টির আকাশে চোখ রাখলাম। ভুল বানান, তবু ওই কষ্টের মধ্যে মায়ের গায়ের গন্ধ এখনও লেগে আছে।

একটা না-পোস্ট করা চিঠি তা এত দিন আগলে রেখেছিল!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

samaresh majumdar samaresh postcard letter
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE