লটারি ছাড়াই লাখপতি
মনে রাখবেন, এ ধরনের ঘটনা কিন্তু আদৌ বিরল নয়। ইকুইটিতে করা লগ্নি এই ভাবে লাফিয়ে বৃদ্ধি পেয়েছে, এমন বহু ঘটনা ছড়িয়ে আছে চার পাশে। বিভিন্ন অগ্রণী তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থা, গাড়ি সংস্থা, সরকারি ও বেসরকারি ব্যাঙ্কের পাবলিক ইস্যুতে প্রথম দিকে শেয়ার পেয়েছেন যাঁরা, তাঁদের অনেকেই নামমাত্র লগ্নিতে এখন লাখপতি। কেউ কেউ আবার বহু লক্ষপতিও (মিলিওনেয়ার)। দীর্ঘ মেয়াদে কিছু নামী ফান্ডও বিরাট লাভের সুযোগ করে দিয়েছে লগ্নিকারীদের।
আর করছাড়?
ও হ্যাঁ, লাভের পুরো হিসেব এখনও করা হয়নি। ব্যাঙ্কে জমা রাখলে, সুদ থেকে কর বাবদ কাটা যাবে ৩০, ২০ অথবা ১০ শতাংশ টাকা (আয় অনুযায়ী)। অর্থাত্, সুদের হার ৯% হলে আপনার প্রকৃত আয় দাঁড়াবে মাত্র ৬.৩%, ৭.২% অথবা ৮.১% মতো। শিক্ষা সেস বাদ দিলে আরও কম। অথচ সেখানে মাত্র এক বছর ধরে রেখে ইকুইটি শেয়ার এবং ইকুইটি-নির্ভর মিউচুয়াল ফান্ডের ইউনিট বিক্রি করে লাভ হলে, সেই মুনাফার উপর কোনও আয়কর দিতে হয় না। তা দিতে হয় না ডিভিডেন্ডের উপরেও। অর্থাত্, আয়ের পুরোটাই ঢোকে আপনার ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে। সুতরাং, যাঁরা ইকুইটিতে লগ্নি করেননি, তাঁরা কিন্তু বড় আয়ের সুযোগ হাতছাড়া করার ঝুঁকি নিয়েছেন।
ব্রাত্য বন্ডও!
ঝুঁকির দোহাই দিয়ে ইকুইটি থেকে মুখ ফিরিয়ে রাখেন বহু মানুষ। আবার অনেকে আছেন, যাঁরা বন্ডের পথও মাড়াননি। গত তিন বছরে সরকার মোটা অঙ্কের করমুক্ত বন্ড ইস্যুর অনুমতি দিয়েছিল ডজনখানেক রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাকে। বেশির ভাগেরই রেটিং বেশ উপরের দিকে। ২০১৩-’১৪ আর্থিক বছরে সুদ ছিল ৯% ছুঁইছুঁই। তা সত্ত্বেও অনেকেই এড়িয়ে গিয়েছেন এই লোভনীয় বন্ড ইস্যুকে। এ বারের বাজেটে করমুক্ত বন্ড ইস্যুর সংস্থান রাখা হয়নি। অথচ করের আওতায় পড়েন, এমন মানুষের জন্য এটি আকর্ষণীয় লগ্নির জায়গা। এখন লগ্নি করতে হলে শেয়ার বাজার থেকে তা কিনতে হবে বেশ চড়া দামে। ফলে সময় থাকতে বন্ড কেনার পথে না-হেঁটে বহু মানুষ মোটা করের ফাঁদেই থেকে গিয়েছেন। এটাও কি কম ঝুঁকির ব্যাপার?
সুতরাং...
দেখা যাচ্ছে, মাপজোক করে ঝুঁকি নিলে সর্বস্বান্ত হওয়ার প্রশ্নই থাকে না। বরং সাধ্য মতো ঝুঁকি অনেক সময়ে জীবনযাত্রার মান পাল্টে দিতে পারে। অর্থাত্ ছোট করে হলেও ব্যাঙ্ক-ডাকঘর ছেড়ে বেরোতে হবে। স্বাদ নিতে হবে বৈচিত্র্যের। ঠাট্টা করে বলা হয়, বাঙালির বেড়ানো মানে তো ‘দিপুদা’, অর্থাত্ দিঘা, পুরী, দার্জিলিং। এখন তো আর তা বলা যাবে না। আমরা বেশির ভাগই তো এখন প্রায় বেরিয়ে পড়ছি গোয়া, আন্দামান বা মুন্নারের দিকে। তা হলে শেয়ার বাজার বা মিউচুয়াল ফান্ডের দিকেই বা পা বাড়ানো যাবে না কেন?
এর জন্য অবশ্য প্রথমেই প্রয়োজন, নিজের মানসিক বাধাটা কাটিয়ে ওঠা। ভাল রিটার্ন ছাড়াও ইকুইটির জগতে আছে অনিশ্চয়তার তীব্র উত্তেজনা। হয়তো সেই কারণেই ক্রিকেটের মতো ইকুইটির আকর্ষণ অনস্বীকার্য। এমনও অনেকে আছেন, যাঁরা শেয়ার বাজারে নিয়মিত টাকা ঢালেন ওই উত্তেজনা তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভোগ করার জন্য।
দাঁড়িপাল্লা দেখে
ফলে এ বার প্রশ্ন হল, কতটা ঝুঁকি নেওয়া যুক্তিযুক্ত?
এটি নির্ভর করে নিজের আর্থিক সামর্থ্যের উপর। আমার মতে, যে টাকার ৫০% পর্যন্ত খোয়া গেলে, তার বড়সড় প্রভাব আপনার সংসারে পড়বে না, সেই পর্যন্ত টাকার ক্ষেত্রেই আপনি ঝুঁকি নেওয়ার কথা ভাবতে পারেন।
বয়সের সঙ্গেও ঝুঁকির সম্পর্ক আছে। বয়স যত বাড়ে, ঝুঁকি নেওয়ার ক্ষমতাও তত কমে যায়। এ বিষয়ে একটি প্রচলিত ফর্মুলা আছে। ধরা যাক, আমাদের দেশে নাগরিকদের গড় আয়ু ৭৫ বছর। এ বার ৭৫ থেকে নিজের বয়স বাদ দিন। যা পড়ে রইল তহবিলের তত শতাংশ পর্যন্ত আপনি ইকুইটিতে লগ্নি করার কথা ভাবতে পারেন। অর্থাত্ আপনার বয়স যদি ৩৫ হয় তবে ৪০%, যদি ৬০ হয় তবে ১৫% আবার ৭০ হলে মাত্র ৫%।
মনে রাখবেন, ঝুঁকি নেওয়া মানেই ফাটকা খেলা নয়। বরং নিয়ম মেনে ঝুঁকি নিলে তা নিজে থেকেই অনেকটা কমে যায়। এ ছাড়া, আপনি তো ঝুঁকি নেবেন তহবিলের একটি ছোট অংশের উপরে। বেশির ভাগটা না-হয় সুরক্ষিত জায়গায়ই রাখলেন। তা হলে দুশ্চিন্তার কোনও কারণ থাকবে না। অতীত অভিজ্ঞতা থেকে দেখা যায়, দীর্ঘ মেয়াদে বাছাই করা ইকুইটি শেয়ার অথবা সুবিন্যস্ত ইকুইটি ফান্ডে (ডাইভার্সিফায়েড ইকুইটি ফান্ড) টাকা রাখলে, তা প্রায় সব সময়েই বাজারে প্রচলিত সুদের হারের তুলনায় আরও বেশ কিছুটা বেশি আয় বা লাভ এনে দিতে পারে।
ঝুঁকিতে লাগাম
এ বার দেখে নেওয়া যাক ঝুঁকিকে কী করে বাগে রাখা যায়।
• আগে থেকেই শেয়ার বা ইকুইটি ফান্ড বাছাই করুন। সওদা করুন পড়া বাজারে। বিক্রি করুন চড়া বাজারে।
• উঁচু দাম পেলে ভাল শেয়ার বিক্রি করে পরে সেই শেয়ারই আবার সস্তার বাজারে ধরা যেতে পারে।
• সুবিন্যস্ত ইকুইটি ফান্ডে লগ্নি করুন। এই ধরনের প্রকল্পের তহবিল বিভিন্ন শিল্পের সম্ভাবনাময় শেয়ারে লগ্নি করা যায়। অর্থাত্ ঝুঁকি ছড়িয়ে দেওয়া হয় বিভিন্ন শিল্পে।
• চড়া বাজারে এক লপ্তে বড় টাকা লগ্নি না-করে প্রত্যেকটি পতনে বাছাই করা শেয়ার কেনা যেতে পারে।
• মিউচুয়াল ফান্ডে লগ্নি করা যেতে পারে এসআইপি পদ্ধতিতে। এতে প্রতি মাসে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ লগ্নি করা যায় বাছাই করা কোনও একটি ফান্ডে। বিভিন্ন উচ্চতার বাজারে লগ্নি করা যায় বলে ইউনিট কেনা হয় গড় দামে। বাজার গড়ের উপরে গেলেই লাভ দেখা যায়।
• বাজারের প্রতিটি পতনে একটি-দুটি করে সেনসেক্স বা নিফ্টির শেয়ার কেনা যেতে পারে নিয়মিত ভাবে। এই ভাবে দীর্ঘমেয়াদে অল্প চাপ নিয়ে গড়ে তোলা যেতে পারে বড় সম্পদ।
• ইকুইটি বেশি ঝুঁকিপূর্ণ মনে হলে ব্যালান্সড ফান্ডে লগ্নি করতে পারেন। লগ্নি করা যায় ডাইনামিক ফান্ডেও।
• বন্ডে ইস্যু করতে হলে অবশ্যই রেটিং দেখে নিন। ‘এএ’, ‘এএপ্লাস’ অথবা ‘এএএ’ হলে ভাল হয়।
• যে প্রকল্পে আকাশছোঁয়া আয় বা সুদের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়, তাকে সন্দেহের চোখে দেখতে হবে।
• কিছু বেসরকারি ব্যাঙ্ক সেভিংস অ্যাকাউন্টে ৬-৭ শতাংশ পর্যন্ত সুদ দিচ্ছে। বিশেষ ঝুঁকি না-নিয়ে ১ লক্ষ টাকা পর্যন্ত রাখা যায় এখানেও। ১ লক্ষ টাকা পর্যন্ত জমা ফেরত পাওয়া ডিআইসিজিসি (ডিপোজিট ইনশিওরেন্স অ্যান্ড ক্রেডিট গ্যারান্টি কর্পোরেশন)-র গ্যারান্টি প্রদত্ত।
• তিন বছরের বেশি মেয়াদে টাকা রাখা যায় ঋণপত্র নির্ভর ফান্ডেও। এখানে করে কিছু সুবিধা আছে।
• তিন বছরের বেশি মেয়াদে টাকা রাখা যায় ঋণপত্র নির্ভর ফান্ডেও। এখানে করে কিছু সুবিধা আছে।
• লগ্নির বহু দিন পরেও যে-সব প্রকল্পে লাভের মুখ দেখা যাচ্ছে না, তা তেজী বাজারে যা-দাম পাওয়া যায় তাতেই বিক্রি করে সেটা ভাল জায়গায় লগ্নি করা বুদ্ধিমানের কাজ হবে।
• তহবিলের সিংহভাগ সুরক্ষিত জায়গাতেই রাখুন। ছোট অংশের উপর ঝুঁকি নেওয়া যায় সামর্থ্য অনুযায়ী।