Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

মান্নাদা বলতেন লতার কণ্ঠে ঈশ্বর বাস করেন

মান্না দে মানেই জলজ্যান্ত ইতিহাস। কত না গান! গল্প! সেই ইতিহাসের সঙ্গে জড়িয়ে কে নেই! ফিরে দেখলেন তাঁর কাছের মানুষ দেবপ্রসাদ চক্রবর্তীজুহুতে মান্নাদার স্বপ্নের বাড়ি ‘আনন্দম’। সামনে ফুলের বাগান। পুরো বাড়িটা মনের মতো করে সাজানো। বিশেষ করে মান্নাদার গানের ঘর। রোজ মান্নাদা রেওয়াজ করেন সেই ঘরে বসে।একদিন রেওয়াজ থামিয়ে ঘরের বাইরে এলেন কোনও দরকারে। ভোরের আলো তখনও ভাল ভাবে ফোটেনি। হঠাৎ খেয়াল করলেন বাড়ির গেটের সামনে চাদর মুড়ি দিয়ে কেউ একজন দাঁড়িয়ে আছে। ভঙ্গিটা একটু লুকিয়ে থাকার। মান্নাদার কেমন সন্দেহ হল। চোর নয় তো!

শেষ আপডেট: ০৪ জুন ২০১৫ ০০:০১
Share: Save:

জুহুতে মান্নাদার স্বপ্নের বাড়ি ‘আনন্দম’।

সামনে ফুলের বাগান। পুরো বাড়িটা মনের মতো করে সাজানো। বিশেষ করে মান্নাদার গানের ঘর। রোজ মান্নাদা রেওয়াজ করেন সেই ঘরে বসে।

একদিন রেওয়াজ থামিয়ে ঘরের বাইরে এলেন কোনও দরকারে। ভোরের আলো তখনও ভাল ভাবে ফোটেনি। হঠাৎ খেয়াল করলেন বাড়ির গেটের সামনে চাদর মুড়ি দিয়ে কেউ একজন দাঁড়িয়ে আছে। ভঙ্গিটা একটু লুকিয়ে থাকার। মান্নাদার কেমন সন্দেহ হল। চোর নয় তো!

মান্নাদা পা টিপে টিপে গেটের কাছে গেলেন। চেঁচিয়ে উঠলেন, ‘কৌন’? একদম হাতেনাতে ধরা পড়ে গিয়েছে। পালানোর কোনও উপায় নেই। মাথা থেকে চাদর সরাতেই মান্নাদা একেবারে চমকে উঠলেন। যাঁকে দেখলেন, তিনি তাঁর নিকট প্রতিবেশী হরিবংশ রাই বচ্চন (প্রখ্যাত কবি, অমিতাভ বচ্চনের বাবা)। ওঁকে ও ভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মান্নাদা কিছুটা বিস্মিত ও বিব্রত। মান্নাদাকে আরও বিব্রত করে বচ্চনসাব বললেন শুধু সেদিন নয়, রোজ ভোরেই তিনি সেখানে ও ভাবে দাঁড়িয়ে থাকেন। কেন? শুধু মান্না দে-র সুমধুর কণ্ঠের রেওয়াজ শুনবেন বলে। মান্নাদার হাজার অনুরোধেও বাড়ির ভেতর গিয়ে রেওয়াজ শুনতে রাজি হলেন না পাছে তাঁর সাধনায় বিঘ্ন ঘটে।

২০০৩ থেকে আমার মান্নাদার জন্য গান লেখা। তিপ্পান্নটি গান লিখেছি মান্নাদার জন্য। গান লেখার সুবাদে দশ বছর তাঁর সঙ্গে পরিচয়। গায়ক-সুরকার মান্না দে-র পাশাপাশি দেখেছি মানুষ মান্না দে-কেও। বিভিন্ন শিল্পীদের নিয়ে কত গল্পই না শুনেছি তাঁর মুখে।

একটা ঘটনা মনে পড়ছে। মান্নাদার কাছেই শোনা। বম্বেতে সেদিন ওঁর রেকর্ডিং। গানটা একটু ঝালিয়ে নিচ্ছেন। সর্বনাশ। গানের একটা জায়গায় সুরের এমন সূক্ষ্ম কাজ ও কঠিন চলন আছে, কিছুতেই সেই জায়গাটা সঠিক ভাবে গাইতে পারছেন না। মনে মনে নিজেকেই ধিক্কার দিচ্ছেন। তুমি কৃষ্ণচন্দ্র দে, দবির খান, আমন আলি খান, আব্দুর রহমান খান, গুলাম মোস্তাফা খান এমন সব ওস্তাদদের শিষ্য— রাগসঙ্গীত নিয়ে এত চর্চা করেছ। আর এই জায়গাটা ঠিক মতো গাইতে পারছ না? সেদিন লতাজিরও রেকর্ডিং ছিল। মান্নাদার গলদঘর্ম অবস্থা দেখে জিজ্ঞেস করলেন ‘কেয়া হুয়া মান্নাদা? লাগতা হ্যায় কুছ পড়েশান হো।’ মান্নাদা ভাবলেন, তিনি এত সময় ধরে চেষ্টা করেও পারছেন না। তাঁকে আর কী বোঝাবেন? তবু লতাজীকে গানের সেই কঠিন জায়গাটা দেখালেন। লতাজি শুনলেন। সামান্য ভাবলেন। তার পর হারমোনিয়ামটা টেনে নিয়ে অনায়াসে সেই জায়গাটা গেয়ে শোনালেন। একেবারে সঠিক ভাবে। শুনে মান্নাদা অবাক। শুধু বললেন, ‘লতা তুম তো কমাল হো।’ মান্নাদা সব সময় বলতেন লতার কণ্ঠে ঈশ্বর বাস করেন। আর মান্নাদা সম্পর্কে লতাজী? পুরো মঙ্গেশকর পরিবারই মান্নাদাকে হেড অব দ্য ফ্যামিলির সম্মান দিত। লতাজি বলতেন মান্নাদার গান শুনে কত কী শিখি! মান্নাদা হচ্ছেন আমাদের গুরু।

লতা মঙ্গেশকর

আমতা আমতা করা মান্নাদা একদম পছন্দ করতেন না। সঙ্গীত জগতে নানা ধরনের মানুষের সঙ্গে মিশলেও প্রত্যেক শিল্পীকে নিয়ে মান্নাদার বক্তব্য ছিল অত্যন্ত স্পষ্ট।

এ-কথা সে-কথার পর একদিন মান্নাদা বললেন, ‘‘গৌরীবাবু আর পুলকবাবুর লেখার মধ্যে আলাদা কী বিশেষত্ব ছিল আপনার মনে হয়? মানে আমি বলতে চাইছি কনটেন্ট, অ্যাপ্রোচ, স্টাইলের কথা।’’ সমস্ত সঙ্কোচ মনের ভেতর রেখে বললাম, ‘‘আপনার গানের কথাই বলি। আপনার গাওয়া গানের সব লিরিকেরই সং ভ্যালু খুব বেশি। একটা আলাদা সিগনেচার। গৌরীবাবু অসম্ভব সাজিয়ে লিখতেন। চাকতিতে চাকতিতে মিল। আপনার জন্য নানা বিষয়ে গান লিখেছেন। সে আপনার প্রথম বাংলা বেসিক গান ‘কত দূরে আর নিয়ে যাবে বলো’ থেকে ‘কফি হাউস’ বা পরের দিকে ‘ডাক্তারবাবু, আমি কি আর ভাল হবো না।’ সব গানই অপূর্ব লেখা। তবে আপনার বেসিক গান তো গৌরীবাবুর খুব বেশি লেখা নেই। মান্নাদা আমার মুখের কথা লুফে নিয়ে বললেন, ‘‘মাঝে তো গৌরী আমাকে গানই পাঠাত না। এত যখন ব্যস্ত, আমিও বহু বছর পুজোয় ওঁর গান গাইনি।’’

মান্নাদার মধ্যে এমন একটা অভিমান ছিল। তখন তো চিঠি-পত্তর ছাড়া যোগাযোগের আর কোনও ইনস্ট্যান্ট মাধ্যম ছিল না। তাই সেই ভুল ভাঙতে একটু সময় লেগেছিল।

বললাম, ‘‘পুলকবাবু কিন্তু আপনার জন্য মনপ্রাণ ভরে গান লিখেছেন।’’ মান্নাদা বললেন, ‘‘ওর প্রথম দু’টো গানই তো দারুণ। ওই যে, ‘জানি, তোমার প্রেমের যোগ্য আমি তো নই।’ আর ‘আমার না থাকে যদি সুর।’ আপনি সুরও করেছিলেন অপূর্ব।’’ আপনার জন্য পুলকবাবু একদম মুখের কথা কেমন সুন্দর গানে এনে ফেলেছেন। মুখড়ার সঙ্গে এই লাইনগুলো জুড়ে দিতেন। এই লাইনটাতে বিশেষ করে আপনার সুর আর গায়কীর অনিন্দ্যসুন্দর খেলা চলত। যেমন ‘আমি তো মানুষ,’ ‘বলো, ভাল আছ তো’, ‘আমি দুঃখ পেলেও খুশি হলাম জেনে’, ‘আমি তোমারই দিকটা নিলাম’। কত বিষয় নিয়ে আপনার জন্য গান লিখেছেন— কাওয়ালি (‘যখন কেউ আমাকে পাগল বলে’), আধুনিক রাগপ্রধান (‘অভিমানে চলে যেও না’), ঋতুপর্যায়, সারাজীবনের গান, মানবিক সম্পর্ক, কাহিনিমূলক গান। আর প্রেমের আনন্দ-বিরহের কত যে গান!

নিজের প্রেম নিয়েও মান্নাদা ছিলেন অকপট...

চলবে...

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE