Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

শঙ্করের পাহাড়

গহন অন্ধকার। অনেকটা সুচারু কোনও অপরাধীর মাথায় গেড়ে বসা কালো অবচেতনের মতো সেই অন্ধকার। দু’ধারে হাত-পা ছড়িয়ে দিচ্ছে লোয়ার ভেল্ডট‌্স-এর মোলায়েম বাদামি গ্রাসল্যান্ড। সে দিন অমাবস্যার রাত। জ্যোৎস্নায় মাটি ধুয়ে যাওয়ার অনুমতি নেই। জনবসতি এই মারোপেং অঞ্চলে সত্যিই নেই। বিভূতিভূষণ উল্লিখিত উগান্ডা রেলওয়েজ-এর নির্মম জনশূন্য নুড‌্সবার্গ রেলওয়ে স্টেশন-এর সেট আমরা বানিয়েছিলাম এই মারোপেং অঞ্চলে।

কমলেশ্বর মুখোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ১৪ এপ্রিল ২০১৬ ১১:৩৩
Share: Save:

গহন অন্ধকার। অনেকটা সুচারু কোনও অপরাধীর মাথায় গেড়ে বসা কালো অবচেতনের মতো সেই অন্ধকার। দু’ধারে হাত-পা ছড়িয়ে দিচ্ছে লোয়ার ভেল্ডট‌্স-এর মোলায়েম বাদামি গ্রাসল্যান্ড। সে দিন অমাবস্যার রাত। জ্যোৎস্নায় মাটি ধুয়ে যাওয়ার অনুমতি নেই। জনবসতি এই মারোপেং অঞ্চলে সত্যিই নেই। বিভূতিভূষণ উল্লিখিত উগান্ডা রেলওয়েজ-এর নির্মম জনশূন্য নুড‌্সবার্গ রেলওয়ে স্টেশন-এর সেট আমরা বানিয়েছিলাম এই মারোপেং অঞ্চলে। এখানে লোকেশন বাছতে গিয়েই আমি প্রথম বার ‘চাঁদের পাহাড়’-এর লেখকের প্রেরণা কিংবা সাইকি-টা ধরতে পেরেছিলাম বলেই আমার বিশ্বাস।

জনাকীর্ণ সভ্যতা বা চেনা লোকালয় থেকে অনেক দূরে স্বেচ্ছানির্বাসিত হতেই শঙ্কর কেন জেদ ধরেছিল এবং অদম্য সাহসিকতার সঙ্গে নিসর্গের কোলে মাথা রাখতে পেরেছিল শেষমেশ, সেটা অনুধাবন করতে পেরেছিলাম। গেরস্থালির চেনা খাঁচা ভেঙে কেন মানুষ আকাশ মাথায় করে বিজন বিভুঁই জুড়ে আশ্রয় খোঁজে, সেটা এই নিস্তব্ধ একাকিত্বে নিজেকে সমর্পণ না করলে বোঝা দায়। শঙ্করের বাড়ি এই বিশ্বচরাচর। সে এক আন্তর্জাতিক মানুষ, যার ম্যাপবই জুড়ে নেশন স্টেট বাউন্ডারির কোনও অস্তিত্ব নেই।

আরণ্যক-এর সত্যচরণ বা পথের পাঁচালী-র অপুর মধ্যে যে বোহেমিয়ান বিভূতিভূষণকে আমরা দেখতে পাই, চাঁদের পাহাড়-এর শঙ্কর যেন তারই আর এক মুখ। শঙ্কর এই অচেনা ভূখণ্ডে ঠাঁই খুঁজে নিয়ে সংসার পাততে পারে। সেই কারণেই আন্তর্জাতিক বাঙালির অন্য এক অভিব্যক্তির নাম শঙ্কর। সে অবলীলায় ঘোড়া চড়ে, উইনচেস্টার রিপিটার কাঁধে সিংহের মুখোমুখি হয়। দিয়েগো আলভারেজ-এর মতো দুঃসাহসিক অভিযাত্রীর যোগ্য শিষ্য হয়ে ওঠে, রিখটার্সভেল্ড-এর দুর্গম পাকদণ্ডী ধরে চলে তার অনন্ত পথ পরিক্রমা। গহন আফ্রিকার নিষ্ঠুর প্রকৃতির প্রতিকূলতা সত্ত্বেও সে শেষমেশ বিজয়ী হয়, বেঁচে থাকে। ‘ওয়ান্ডারলাস্ট’ তাকে তাড়া করে নিয়ে যায় নিসর্গের যাবতীয় রহস্যভেদ করতে।

কিন্তু বিভূতিবাবুর আফ্রিকা ছিল ১৯০৯ সালের। তার পর পৃথিবীর বয়স বেড়েছে। বিজ্ঞান আর প্রযুক্তি অনেক সত্য উদ‌্ঘাটন করে পৃথিবীর বিস্ময় কেড়ে নিয়েছে আজ। বিষিয়ে দিয়েছে নিসর্গের শ্বাস-প্রশ্বাস। আজ শঙ্করকে আফ্রিকার গহনে বসে সভ্যতার এই নয়া ব্যাধির চিকিৎসা করতে হবে। কী রকম দুর্বিষহ অসুখের শিকার আজকের অত্যাধুনিক আফ্রিকা? বুঝলাম সেই রাতেই। একটা জলের মতো ঢেউ তোলা মসৃণ হাইওয়ে বুক চিরে দিয়েছে আদিম নিসর্গের। দুরন্ত গতিতে দিগ্বিদিকজ্ঞানশূন্য হয়ে হাইওয়ে ধরে ছুটে চলেছে হালফ্যাশনের শীতাতপনিয়ন্ত্রিত এসইউভি। আমি তাতেই চড়েছি। রাস্তার শরীরে আলো তেমন পড়ে না। বেশ কিছুটা পথ অন্তর ঠায় দাঁড়িয়ে আছে একটা করে অত্যাধুনিক বাতিস্তম্ভ, আর আফ্রিকান্‌স ও ইংরেজি ভাষায় লেখা দিক্‌নির্দেশ। মাঝে কয়েক যোজন অন্ধকার। হঠাৎই আমাদের পথ রোধ করে দাঁড়াল এই দুনিয়ার আরও বিচিত্র এক অন্ধকার। সপাটে পায়ের তলায় ব্রেক দাবালেন আমাদের দক্ষ মালওয়াই চালক ইশা। গাড়ির অস্ফুট আলোয় দেখি, সামনে এক কৃষ্ণাঙ্গ যুবক বাতিস্তম্ভের অল্প আলোর নীচে হাঁটু গেড়ে প্রার্থনা করার ভঙ্গিতে বসে আছে এই বধ্যভূমির মতো দীঘল রাস্তার ঠিক মাঝখানে। তার হাতে ধরা রয়েছে ছেঁড়া মাউন্টবোর্ডে হাতে-লেখা একটা পোস্টার— ‘হয় আমাকে মাড়িয়ে দিয়ে চলে যাও, অথবা আমাকে বাঁচতে সাহায্য করো, আমার কোথাও যাওয়ার নেই।’ জনৈক ‘স্ট্রিট বেগার’। এর আগে শেষ মুহূর্তে ব্রেক কষে অনেক গাড়ি এই যুবকের প্রাণ বাঁচিয়েছে, চূড়ান্ত আতঙ্কে চলে গেছে পাশ কাটিয়ে, আমরাও তার প্রাণ বাঁচিয়ে শিহরিত হতে হতে চলে যাব আমাদের লক্ষ্যে। রাস্তা আগলে আরও অনেক বছর বসে থাকবে বিশালদেহী অভুক্ত সেই কৃষ্ণাঙ্গ যুবক।

বৈষম্যই তো ভবিতব্য, বলে সোশাল ডারউইনিজম-এর শিক্ষকেরা চলে যান। পারবে কি আজকের শঙ্কর দুনিয়া জুড়ে এই ভেদাভেদের জন্তুটাকে মারতে? সে দিনের সেই সহজ প্রশ্ন এখনও আমার শহুরে ছিমছাম মধ্যমেধার দরজায় ঠকঠক আওয়াজ তোলে। না, শঙ্করকে নিয়ে আফ্রিকার এই গল্পটার ওপর আমার ছবি করা হয়নি।

বিভূতিবাবু ১৯৩৭-এ বাংলায় বসে আফ্রিকার নিসর্গের যে বর্ণনা লিখেছেন তা নিশ্চয়ই অব্যর্থ। জঙ্গলের সেই আদিমতা আজও নির্মম ভাবে সত্যি।

কিন্তু আজ সাইবার যুগে সেই আদিমতার মাত্রা কি লাগামছাড়া হল? পশুত্ব কি জঙ্গলের প্রান্ত ছাড়িয়ে গিলে ফেলল শহরকে? জোহানেসবার্গ-এর সন্নিকটে দমবন্ধ করা হতদরিদ্র মানুষের ঘেটো দেখে আর তারই পশ্চাদপটে আঁকা বহুতল বাড়ি, শপিং মল, ফ্লাইওভার, ক্যাসিনো অথবা হোটেল দেখে তো তাই মনে হয়। জোহানেসবার্গ নাকি ‘ক্রাইম ক্যাপিটাল অব দ্য ওয়ার্ল্ড’। প্রশ্ন হল, কেন? অপরাধ-জগৎ কে তৈরি করে? স্রেফ প্রবৃত্তি না পরিস্থিতি? শহরের রাস্তায় চলতে চলতে নেলসন ম্যান্ডেলা, ক্রিস হন্নি বা উইনি ম্যান্ডেলা-র মতো মনীষীদের কথা মনে পড়ত। তাঁরা সাদা-কালোর সামাজিক বিভেদ মিটিয়ে দিয়েছেন ঠিকই— কিন্তু ওপরতলা আর নীচতলার অর্থনৈতিক বৈষম্য কি মিটল?

বিভূতিবাবু, আপনার আফ্রিকায় আজ শৃঙ্খলাবদ্ধ শ্বাপদেরা বেশ মানবিক হয়ে উঠেছেন, কিন্তু ক্ষমতাসীন মানুষেরা পাশবিক না হয়ে ওঠে! সেখানে এক দল মানুষ নোংরা ঘেটো আঁকড়ে পড়ে আছেন। আর এক দল মানুষ আঠারো হাজার হেক্টর জমি নিয়ে বড়সড় সব ফার্মের মালিক। এক-একটা ফার্ম কিনে নিয়েছে নদী, পাহাড়, লোয়ার ভেল্ডট‌্স গ্রাসল্যান্ড আর বন্যপ্রাণী সমেত যাবতীয় প্রাকৃতিক সম্পদ। সেই অর্থের ভেদাভেদ কাউকে পথে বসিয়েছে, কাউকে ঘাতক বানিয়েছে আর জুলু, মাসাই, লেসিদি, সোয়াহিলি, সোমালি লোকসংস্কৃতিকে বিপন্ন করে তুলেছে। আজ দীর্ঘ কালাহারি মরুভূমি দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে তৃষ্ণার্ত শঙ্কর জল পাবে না, কিন্তু ‘কোক’ পানীয়ের স্টল পেলেও পেতে পারে।

এই আজ আন্তর্জাতিক অভিযাত্রী শঙ্করের সভ্যতার সংকট। স্রেফ নিসর্গপ্রেম আর মানবতাবাদ নয়— আজ শঙ্করকে সবুজ বাঁচাতে, মানুষ বাঁচাতে, বন্যপ্রাণীর প্রাণ বাঁচাতে লড়তে হবে। তাই নিয়ে হবে আধুনিক অ্যাডভেঞ্চার ছবি। কিন্তু আফ্রিকায় শঙ্করকে নিয়ে সে ছবি আমার বানানো হয়নি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Chander Pahar Kamaleshwar Mukherjee
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE