Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

কান বার্লিন ভেনিস মৃণাল

জা ক দ্যুত্রঁক ‘খারিজ’-এর জন্য জুরি পুরস্কার তুলে দিচ্ছেন মৃণাল সেনের হাতে। কান চলচ্চিত্র উৎসব, ১৯৮৩। সাদা কালোয় পাতাজোড়া ছবি, কাইয়ে দ্যু সিনেমা-র মোটাসোটা ঝলমলে বই— কান সিনেমা/ আ ভিশুয়াল হিস্ট্রি অব দ্য ওয়ার্ল্ডস গ্রেটেস্ট ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল (১৯৩৯-২০১০), তার পাতা ওলটালেই বেরিয়ে পড়বে ছবিটা, তলায় মৃণাল সেনের পরিচিতি: বেঙ্গলি ইন্ডিয়ান ডিরেক্টর।

১৯৮০। কান ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল-এ মৃণাল সেন, পাশে গীতা সেন। ছবি সৌজন্য: কুণাল সেন

১৯৮০। কান ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল-এ মৃণাল সেন, পাশে গীতা সেন। ছবি সৌজন্য: কুণাল সেন

শিলাদিত্য সেন
শেষ আপডেট: ১৪ এপ্রিল ২০১৬ ১১:৫৫
Share: Save:

জা ক দ্যুত্রঁক ‘খারিজ’-এর জন্য জুরি পুরস্কার তুলে দিচ্ছেন মৃণাল সেনের হাতে। কান চলচ্চিত্র উৎসব, ১৯৮৩। সাদা কালোয় পাতাজোড়া ছবি, কাইয়ে দ্যু সিনেমা-র মোটাসোটা ঝলমলে বই— কান সিনেমা/ আ ভিশুয়াল হিস্ট্রি অব দ্য ওয়ার্ল্ডস গ্রেটেস্ট ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল (১৯৩৯-২০১০), তার পাতা ওলটালেই বেরিয়ে পড়বে ছবিটা, তলায় মৃণাল সেনের পরিচিতি: বেঙ্গলি ইন্ডিয়ান ডিরেক্টর। এই বইয়ে আর কোনও ভারতীয় পরিচালকের ছবি নেই।

আগের বছরই, ’৮২-তে কান-এ জুরর/ জুরি মেম্বার ছিলেন মৃণাল, ‘খারিজ’ তৈরি হচ্ছে তখন, শুটিংয়ের কয়েকটা ছবি নিয়ে গিয়ে দেখিয়েছিলেন জিন মাসকোভিচ’কে। জিন কলকাতায় এসেছিলেন শুটিং দেখতে, যাওয়ার আগে বলে গিয়েছিলেন ‘মৃণাল, আমি একটা ভাল ছবির গন্ধ পাচ্ছি।’ সিনেমার এই বিশিষ্ট আলোচক সম্পর্কে সত্যজিৎ রায়ের কাছে প্রথম শোনেন মৃণাল, ষাটের দশকের শুরু তখন, তাঁর ‘বাইশে শ্রাবণ’ সদ্য দেখানো হয়েছে ভেনিস ফেস্টিভ্যালে, আমন্ত্রণ পাওয়া সত্ত্বেও ভেনিসে যেতে পারেননি অর্থাভাবে। বিদেশেরই কোনও ফেস্টিভ্যালে জিনের সঙ্গে দেখা হয়েছিল সত্যজিতের, জিন’কে তিনি পছন্দও করতেন খুব, কলকাতায় ফিরেই তাঁর সম্পর্কে পরিচিতি দিয়ে মৃণালকে ফোন করলেন— ‘ফেস্টিভ্যালে-ফেস্টিভ্যালে ঘুরে বেড়ায়, থাকে প্যারিসে। এ বার যখন বাইরে যাবেন, অবশ্যই দেখা করে নেবেন, আপনার ‘বাইশে শ্রাবণ’ ভেনিসে দেখেছে, খুব বলছিল তা নিয়ে, লিখেছেও।’ জিন একা নন, লিখেছিলেন জর্জ মাদুল-ও, ফরাসি একটি পত্রিকায়।

‘বাইশে শ্রাবণ’ই আন্তর্জাতিক সিনেমার দুনিয়ায় সম্মানিতদের সারিতে মৃণাল সেনকে দাঁড় করিয়ে দেয় প্রথম। দিল্লির কেন্দ্রীয় মন্ত্রক অবশ্য উপদেশ পাঠিয়েছিল: একটা ক্ষুধার্ত মানুষ শীর্ণকায় আঙুলে ভাত চটকে চটকে যাচ্ছে, এ দৃশ্য বাদ দিতে হবে। শোনেননি মৃণাল। বিদেশের নানান ফেস্টিভ্যালে মৃণালের সঙ্গে নিয়মিত যেতেন গীতা সেন, স্ত্রী হিসেবে তো বটেই, তাঁর ছবির বিশিষ্ট অভিনেত্রী হিসেবেও। ‘এমনই এক ফেস্টিভ্যালে দেখা হয়ে গিয়েছিল জিনের সঙ্গে। আমাদের পরিচয় দেওয়ার আগেই ও নিজে থেকে এগিয়ে এসে আলাপ করল। জমজমাট সম্পর্ক ছিল আমৃত্যু।’ বলতে থাকেন গীতা, ‘ক্যানসার হয়েছিল। শেষ দিকে হুইলচেয়ারে ঘুরে ঘুরে কাজ করত। হাসপাতালেও ওকে দেখতে গিয়েছি আমরা দুজন।’ মারা যাওয়ার খবরটা দিয়েছিলেন ক্যাকটাস ফিল্মের এলিয়ান স্টুটারহাইম, যাঁদের তত্ত্বাবধানে ‘খারিজ’ দেখানো হচ্ছিল কান-এ। মৃণাল আর এলিয়ান সিদ্ধান্ত নেন, জিনকেই উৎসর্গ করা হবে ছবিটা। ছবি শুরুর আগে পরদায় ভেসে উঠল: ‘জিন মাসকোভিচ স্মরণে।’ আড়ালে দাঁড়িয়ে কাঁদছিলেন মৃণাল সেন। তাঁর মনে পড়ে যাচ্ছিল, ‘বাইশে শ্রাবণ’ দেখে জিন বলেছিল, ‘সাবটাইটেল ছিল না, তবুও ছবিটা দেখে বুঝেছিলাম, সাবটাইটেল থাকলে কী ভাল হত!’

‘খারিজ’ দেখানো হয়েছিল ১৪ মে, মৃণাল সেনের জন্মদিনে। তাঁর জন্মদিন পালন, প্রেক্ষাগৃহের ছাদে দাঁড়িয়ে আকাশে আলোর রোশনাই, কেক কাটা... সে দিনটাতেই প্রতি বছর তাঁর ছবি দেখানো প্রায় যেন রেওয়াজ হয়ে দাঁড়িয়েছিল সে সময় কান-এ। ১৯৮০ থেকে ’৮৬ অবধি, ‘খণ্ডহর’ পেরিয়ে ‘জেনেসিস’ অবধি, ‘একদিন প্রতিদিন’ থেকে যার শুরু। সে ছবিতে সকলকে চমকে দিয়েছিল গীতা সেনের অভিনয়। গীতা বলেন, ‘আমি কেনাকাটা করতে যেতাম সেনেগালের মানুষজনের কাছে। ওরা নানা রঙের পসরা সাজিয়ে বসত রাস্তার ওপর। ওরা আমাকে চিনে ফেলেছিল। ছবিটা দেখেছিল, জিজ্ঞেস করত, মেয়ে আসেনি কেন? শ্রীলাকে (মজুমদার) ওদের খুব পছন্দ হয়েছিল। ওর জন্য কিছু দিতে চেয়েছিল।’

কান-এর এমন কত স্মৃতি মৃণালেরও। ব্রিটিশ সিনেমায় ঝড়-তোলা লিন্ডসে অ্যান্ডারসন ‘খারিজ’-এর শেষে মরে-যাওয়া পালানের বাবার স্তব্ধবাক্ চেহারা দেখে অভিভূত। বই উপহার আর দেশে ফিরে চিঠি দিয়েছিলেন তাঁকে। স্পেনের কার্লো সওরা, জাপানের শোহেই ইমামুরা, রাশিয়ার তারকোভস্কি, ফ্রান্সের ব্রেসঁ— সিনেমা নিয়ে কথা আর কথা তাঁদের সঙ্গে। সখ্য হল চ্যাপলিন-কন্যা জেরাল্ডিনের সঙ্গে, মৃণালের সঙ্গে তিনিও বিচারক ছিলেন। বিচারক ছিলেন গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেসও। শিল্পভাবনার বীজ কী ভাবে উড়ে আসে মাথার ভেতর, তা নিয়ে সহমত হয়েছিলেন দুজনেই।

সে বছর বার্লিন ফেস্টিভ্যালেরও বিচারক মৃণাল, সেখানে জোন ফনটেন বিচারকমণ্ডলীতে। হলিউডের সেই সুন্দরী অভিনেত্রীকে তখনও রহস্যময়ী মনে হল মৃণালের, বললেন, ‘আপনি একই রকম আছেন।’ শুনে জোন জানতে চাইলেন, ‘কী রকম?’ ‘যেমন দেখেছিলাম বহু বছর আগে লরেন্স অলিভিয়ের-এর বিপরীতে হিচককের রেবেকা-য়’, উত্তর শুনে হাসতে হাসতে জোন বললেন, ‘ইউ আর আ ডিলিশিয়াস লায়ার, মৃণাল।’ এর আগের বছরই ‘আকালের সন্ধানে’র জন্যে বার্লিনে রৌপ্যভল্লুক ঝুলিতে পুরেছেন।

’৮৩-তে ভেনিস ফেস্টিভ্যালের বিচারক। ’৮৯-তে সেখানেই ‘একদিন অচানক’ দেখানোর সময় এক সাংবাদিক প্রশ্ন করলেন, ‘এ ছবি কতটা আত্মজীবনীমূলক?’ ‘বাইশে শ্রাবণ’-এ পারেননি, ‘ভুবন সোম’-এর হাত ধরেই ’৬৯-এ প্রথম পৌঁছেছিলেন ভেনিসে। ভারতীয় সিনেমায় নতুন রীতির ছাপ অনেকেই তখন খুঁজে পাচ্ছেন ‘ভুবন সোম’-এ। সেখানেই ফোন এল আঁরি লাঁগ্লোয়া-র, প্যারিসে সিনেমাথেক-এর সর্বেসর্বা, সর্বকালের সেরা সিনেমা-সংরক্ষক। প্রায় আদেশের সুরে মৃণালকে পত্রপাঠ প্যারিসে আসতে বললেন ‘ভুবন সোম’ সঙ্গে নিয়ে। ভেনিস-কর্তৃপক্ষ মারফত ছবি পৌঁছল, প্রায় একই সঙ্গে মৃণালও, তাঁর সঙ্গে কথা বলে খুশি লাঁগ্লোয়া। ঠিক করলেন ‘বাইশে শ্রাবণ’ দেখাবেন, যাতায়াতের পথে ছবিটির শেষ রিল উধাও, সেটা ছাড়াই ছবিটা দেখাবেন ঠিক করলেন, শেষটুকু দর্শককে বলে দেওয়ার দায়িত্ব দিলেন লুই মাল-কে।

ফরাসিরা বোধহয় একটু বেশিই ভালবাসেন মৃণাল সেনকে! সে দেশের নতুন ধারার ঔপন্যাসিক নাতালি সারোৎ কলকাতায় এসে ‘ভুবন সোম’ দেখেই কথা বলতে চলে এলেন মৃণালের বাড়িতে। কান ফেস্টিভ্যালে আগত কুরোসাওয়া, ফেলিনি, আন্তোনিয়নি প্রমুখ পরিচালকের কিছু লেখা, স্কেচ, ডায়েরি ইত্যাদি নিয়ে একটা বই বেরল, লে ভিজিতর দ্য কান, তাতে ধরা রইল ‘আকাশকুসুম’ নিয়ে সেই দীর্ঘস্থায়ী পত্র-বিতর্ক, যাতে যোগ দিয়েছিলেন সত্যজিৎ মৃণাল ও আশীষ বর্মন। ‘কান ক্লাসিক্‌স’ বিভাগ চালু হল কান-এ, পৃথিবীর সেরা ধ্রুপদী ছবি পুনঃপ্রদর্শনের জন্যে, তাতে ২০১০-এ দেখানো হল ‘খন্ডহর’। আমন্ত্রণ ফেরালেন না মৃণাল, এত বছর পর এই বয়সেও পুত্র পুত্রবধূ কুণাল-নিশার সঙ্গে পৌঁছলেন সেখানে। ১৯৯৫-এ সিনেমার শতবর্ষ পূর্তিতে ফ্রান্সের লিয়ঁ শহরে সারা পৃথিবী থেকে বিভিন্ন পরিচালককে আহ্বান জানানো হল লুই লুমিয়ের-এর উত্তরসূরি হিসেবে। পরিচালক বের‌্ত্রাঁ তাভেরনিয়ে ছিলেন আহ্বায়ক, ফরাসি সংস্কৃতি মন্ত্রকের পক্ষে। এ দেশ থেকে আমন্ত্রিত সেই মৃণাল সেন।

সম্মানও পেয়েছেন ফরাসি দেশের: ‘কম্যান্ডর অব আর্টস অ্যান্ড লেটার্স।’ সোভিয়েত রাশিয়া থেকে ‘নেহরু সোভিয়েত ল্যান্ড অ্যাওয়ার্ড’, রাশিয়ান ফেডারেশন থেকে ‘অর্ডার অব ফ্রেন্ডশিপ’। এ রকম কত দেশের কত সম্মান! কান-বার্লিন-ভেনিসের বাইরেও আরও কত গুরুত্বপূর্ণ ফেস্টিভ্যালে অফুরান ঘোরাঘুরি, জুরি-গিরি। নিজেই যে কেবল দুনিয়া চষে বেড়িয়েছেন তা তো নয়, বাইরের পৃথিবী এসেও কড়া নেড়েছে তাঁর দরজায়। একদা পশ্চিম জার্মানির প্রতিবাদী পরিচালক রাইনার্ড হফ আশির দশকের মাঝামাঝি বার্লিন থেকে কলকাতা এলেন দশ দিনের জন্য, মৃণালকে নিয়ে দীর্ঘ তথ্যচিত্র তৈরি করলেন— ‘টেন ডেজ ইন ক্যালকাটা: আ পোর্ট্রেট অব মৃণাল সেন’।

বিরানব্বই অতিক্রান্ত মৃণাল সেনের এখন নিঃশব্দ বসবাস। স্মৃতি আর শব্দের ওপর ভর করে আত্মকথাও লিখেছেন কিছু কাল আগে— তৃতীয় ভুবন (আনন্দ)। তাঁর এই আত্মস্মৃতি আর ছবিগুলি ফিরে ফিরে পড়লেই কিন্তু জানা যায় সেই ইতিহাস— গত শতকে যা ভারতীয় সিনেমাকে গৌরবান্বিত করেছিল দুনিয়ার দরবারে, সত্যজিতের পাশে থেকে যে চেষ্টা নিরন্তর চালিয়ে গিয়েছেন মৃণাল সেন। অথচ বাঙালি অদ্ভুত নীরব তাঁর সম্পর্কে, তাঁকে নিয়ে যদি-বা কথা ওঠে, তাঁর ছবি নিয়ে কোনও কথাই হয় না, কোথাও দেখানোও হয় না। এ বঙ্গের বাইরে দেশের বিভিন্ন প্রদেশে তাঁর ছবি নিয়ে এখনও চর্চা চলে, শুধু এখানেই...

কূপমণ্ডূক হতে বারণ করে গিয়েছিলেন সত্যজিৎ, তাঁর শেষ ছবি ‘আগন্তুক’-এ। আমরা তাঁর বারণ শুনিনি!

নামাঙ্কন: সোমনাথ ঘোষ

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE