Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪

এই আশ্বিনে তোমায় যেতে দিলাম...

কলাবউ স্নানের আগের রাতে তোমার ঠোঁটের, গরম শরীরের প্রথম স্পর্শটাও আবার প্যান্ডেলের কোণায় দুগ্গাকে পিছনে রেখে! লিখছেন স্রবন্তী বন্দ্যোপাধ্যায়কলাবউ স্নানের আগের রাতে তোমার ঠোঁটের, গরম শরীরের প্রথম স্পর্শটাও আবার প্যান্ডেলের কোণায় দুগ্গাকে পিছনে রেখে! লিখছেন স্রবন্তী বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ১৮ অক্টোবর ২০১৫ ০০:০০
Share: Save:

শুনছ...আমার পুজো হারিয়ে গেছে। কখন অন্যমনে।

তোমার সঙ্গে বোধনের রাতেই তো কিনেছিলাম সূর্য ডোবা রঙের শাড়িটা। আর শিউলি ফুলের বোটা ভেঙে কপালের সেই টিপ... বাবার সঙ্গে দিব্যি নতুন জামা পড়ে বেরিয়ে যেতাম প্যান্ডেলের পথে। ওহ! এখন তো প্যান্ডেল হপিং বলতে হয়। নয়ত সেকেলে বলে লোকে নাক সিটকোবে।
বাঙালি বোধহয় এক মাত্র কমিউনিটি, যারা উৎসবের নিয়ম না মানার মধ্যে একটা স্বর্গীয় আনন্দ পায়। নিশ্চয়ই ভাবছ, এত বিরক্ত মনে কী বলে চলেছি তোমায়? বয়স বাড়ছে ভাবছ বুঝি? তুমিই বল, আন্তর্জাতিক এক ফ্যাশন ম্যাগাজিন যেই বলল, ‘‘ব্ল্যাক ইজ দ্য কলার অব সেশন’’। ব্যস! আমার ইউনিভার্সিটির বন্ধুরা অষ্টমীর মিটে লিখে বসল, এ বার অষ্টমীর থিম রেট্রো, কিন্তু রং কালো! যাব না আমি...কী ভাবেই বা যাব? আমার শহরটা পুজোর চারটে দিন বিচিত্র মানুষের দখলে। ম্যাটাডর ভাড়া করে, শার্টের বোতাম খুলে তখন সবাই দাবাং-এর সলমন খান। হাতে বিয়ারের বোতল, দরকার হলে যে কারওর দিকে ছুড়ে দেবে। তুলে নেবে কোনও পছন্দের মেয়েকে। পুলিশকেও নাকি বলা আছে, পুজোর চারটে দিন শুধু ফুর্তি আর ফুর্তি! নতুন জুতো নয়, জামা নয়, পুজোয় এ বার নতুন শব্দ— ‘মাস্টারডেট’! শুধু ডেটিং!


অলঙ্করণ: সুমন চৌধুরী

আচ্ছা, মনে আছে, আমি যে দিন প্রথম শাড়ি পরি? হলদে নক্শা পেড়ে ধনেখালি। ঘাড়খোপার খোঁচা খোঁচা উড়ুক্কু চুল ঘেঁটে দিচ্ছে আমার গুঁড়ো টিপের কপাল। তুমি দিব্যি জিনস্ আর বাসন্তী পাঞ্জাবীতে সরস্বতী পুজোর সাজে। কখন ১০টা বেজে গেছে! বাড়ি ফেরার তাড়া নেই আমাদের। আর কিছু ক্ষণের মধ্যেই সন্ধিপুজোর পদ্ম ফুটবে মায়ের সোনার কাঁকনের হাতে। মেজকা ছবি তুলবে। আর ছোড়দা ধুনুচি নেচে ঠাকুরদালানেই ল্যাদ খেয়ে শুয়ে পড়বে। আর আমরা? কাজে ফাঁকি দিয়ে লাইনে দাঁড়িয়ে ঠাকুর দেখব। কখনও তোমার পিঠে আমার আঙুল, আবার আমার কোমর ছুঁয়ে হাত এ দিক সে দিক।
গেল বছর অয়ন্তিকার ১৫ বছরের মেয়েই তো বাবা-মার সঙ্গে ঠাকুর দেখতে গিয়ে পড়েছিল এক দল মদ্যপ বাইক মস্তানের পাল্লায়। রুপসাকে মধ্যরাতে বাইকে তুলে নিয়ে যাওয়ার প্ল্যান ছিল না কি! পাড়ার ছেলেরাই টার্গেট করেছিল। ‘‘রুপসা বড্ড খোলামেলা পোশাক পরে। আর ওর সব কিছুই তো বেশ এক্সপোজড...’’— নবমীর সকালে ফুরফুরে মন নিয়ে সুচন্দ্রা সোজা আমায় ফোনই করে বসল। এ যা গসিপ, নবমী নিশিও হার মানবে।

আরও কাণ্ড! দ্যাখ না দ্যাখ পাড়ায় হঠাৎ চাঁদা তুলে পুজোর ধুম উঠেছে। বাড়ি আটকে মণ্ডপ। সন্ধ্যা ছ’টার পর বাড়ি থেকে বেরনো যাবে না। আর বাড়ি ঢুকতে চাইলে বারোটার পর। ‘‘দিদি সারা বছরে মাত্র চারটে দিনই তো...বাঙালির পুজো।’’ কোনও বন্ধুর বাড়ি গিয়েও বাঁচতে পারব না?
ছোটবেলার ভবানীপুরের পাড়ায় আমার বান্ধবীরা নয় পঞ্জাবী, নয় গুজরাতি। তোমার তো মনে থাকবেই, অষ্টমীর বিফ কাবাবের প্ল্যানটা তো অমৃতের জন্য ভেস্তেই গিয়েছিল! শেষে কি না ফুচকা আর ভোগের পোলাও! অমৃতের জন্য তুমিও মেনে নিয়েছিলে! ওই ডাগর চোখ এক মাথা চুলের অমৃত বেশ মনে ধরেছিল— দেখ না ফেসবুকে পেয়ে যাবে! অমৃতের মা, এমনকী ঠাকুমাও অষ্টমীর দিন অঞ্জলি দিতেন বলে নিরামিষ খেতেন! কে বলেছে বল তো বাঙালির দুর্গাপুজো! আর তোমরাও যারা সিঁদুর মাখা লাল-সাদা গরদের বাঙালির দুর্গাপুজো নিয়ে ডকু ফিচার করে বিদেশে অ্যাওয়ার্ড কুড়াও তাঁদেরও বলিহারি, শুধুই বাঙালির পুজো? আমাদের ত্রিকোণ পার্কের লাগোয়া সুরেশের বাড়িতে তো দুর্গাপুজোতেই নতুন জামা আসত! অথচ এই মিডিয়াগুলো বাঙালি বাঙালি করে হেদিয়ে মরে গেল!
আর কি ছিরির দুর্গা! কোথায় টানা চোখে ডাকের সাজ? বড় দুর্গা না ছোট দুর্গা এই নিয়েও রাজনীতি! আচ্ছা, পুজো নিয়েও রাজনীতি!
সারা বছরের ডিপ্রেশনটা এই পুজোর জন্যই অপেক্ষা করে। মনে আছে কলাবউ স্নানের আগের রাত? তখন তো দল বেঁধে গঙ্গার ঘাটেও জড়ো হতাম আমরা। সেই রাতে তোমার ঠোঁটের, গরম শরীরের প্রথম স্পর্শটাও আবার প্যান্ডেলের কোণায় দুগ্গাকে পিছনে রেখে! বার বার ফিরেছি সেই উষ্ণতার গন্ধটা তোমার সঙ্গে ভাগ করে নেব বলে। কিন্তু কই, আর তো সেখানে যেতে পারি না। ওটা নাকি এখন ‘নেশা হাব’। মারিজুয়ানা, চরসের আখড়া। কে কখন কি করে বসে! খাও খাও খেয়ে খেয়ে বুঁদ হও। ওই যে বললাম, এস্ট্যাবলিশমেন্টের বাইরে যাবতীয় পাগলামি করার জন্যই দুর্গাপুজো। হতেও পারে, টিন্ডারের মতো অ্যাপ-এ পুজোতেই বরের বসের সঙ্গে সেক্স চ্যাট। রেট্রো থেকে বোহো লুক— কখনও কাঁধ খুলে, কখনও পিঠ খুলে সেলফির বন্যা। বা পুজোর আনন্দে ‘সেক্সটিং’ করে ফেলা। মিস যেন কিছু না হয়। প্রেমিকা নেই তো কী? সেক্স চ্যাট, সেক্স পার্টনার, বাবার বন্ধুর খালি ফ্ল্যাট...সবই কেয়ার অফ মা দুর্গা! পুজো স্পেশাল সেক্স!
এগুলোই পুজো। আমি এগুলোর কোনওটার মধ্যেই নিজেকে মেলে ধরতে পারি না। বাইরে গেলেই তো পারি। কি অদ্ভূত যেন কলকাতার পুজো ঘিরে আছে বুকের মধ্যে। মায়ের নতুন কাপড়ের গন্ধে, পাড়ার সন্ধ্যারতি লুকিয়ে দেখায়, শারদীয়ার ভাঁজে পদ্মফুলের পাপড়ি আর সোনা ঝরা গানে, তোমার ভালবাসার উষ্ণতায়। ছাড়তে পারিনি।
তুমিও নেই। চলে গেছ।
এই আশ্বিনে তোমায় দিলাম যেতে। কিন্তু ছাড়লাম কই? ছাড়তে হলে তো নিজেকে ছাড়তে হয়!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE