Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

বয়ঃসন্ধির সন্ধিপুজো

চা-বাগানের সেই পুজোয় মিশে গেল কিশোরীবেলা। খানিকটা অন্য জগৎ...রহস্যময় সে আনন্দ...। স্মৃতিপথে হাঁটলেন তিলোত্তমা মজুমদারচা-বাগানের সেই পুজোয় মিশে গেল কিশোরীবেলা। খানিকটা অন্য জগৎ...রহস্যময় সে আনন্দ...। স্মৃতিপথে হাঁটলেন তিলোত্তমা মজুমদার

শেষ আপডেট: ১৮ অক্টোবর ২০১৫ ০০:০০
Share: Save:

বছর দুয়েক আগেও দুর্গাপূজায় গুনে গুনে নতুন জামা পরা আর বাজিপটকা ফাটানোর দিকেই আমাদের আগ্রহ ছিল। ইদানীং সব কিছুই কী রকম পাল্টে যাচ্ছে। টোকন, সুজয়, মাধব, হিলটুরা কথায় কথায় বলে— যা যা, তোরা মেয়েরা কর ও সব।

আমি, ফুলটুস, মউ, রুপালি, রুবলান ওদের এমন কথায় খুবই ক্ষুব্ধ হয়ে উঠছি। কথাগুলো কেমন ছোট করা মতো নয়? কেন রে বাবা! আমরা মেয়েরা যা করি, তোরা করতে পারিস না কেন? এই সে দিনও সরিতা তিন গোল দিল তোদের। সাত গোলে হারলি তোরা আমাদের ‘সরস্বতী বাহিনী’র কাছে। মউ ব্যাট করলে আউট করতে তোদের কালঘাম ছুটে যায়। আমরা তোদের চেয়ে ছোট কীসে?
ছোটবেলা থেকেই আমরা মেয়েরা পুজোর সকালে শাড়ি পরি। আর ওদের ‘টেনিদা সঙ্ঘ’-র জুনিয়র গ্রুপ ওরা হাফ পেন্টুল পরে নতুন শার্টে সেজে নকল বন্দুক ফাটায় পরমানন্দে। গত দু’বছর ধরে ও সব ছোঁয় না। বরং ক্লাবের দরজা বন্ধ করে টেবিল টেনিস খেলার নাম করে বিড়ি-টিড়ি ফুঁকছে। হুঁ হুঁ বাবা! সব টের পাই! বোকাগুলো! ভাবে মেয়েরা ও সব বোঝে না। আরে মেয়ে বলে কি আমরা নাদান নাকি? মউদের বাড়িতে কাজ করে ভাগমতি লোহার, আর আমাদের বাড়িতে কৈয়ো ওরাওঁ। আমাদের খুব বন্ধু ওরা। বাড়ির কাজ করে বলে মাঠে খেলতে আসতে পারে না। কিন্তু বাড়িতেই সুযোগ পেলে আমাদের নানান খেলা চলে।


অলঙ্করণ: সুব্রত চৌধুরী

কৈয়ো তো খৈনি খায়। আর ভাগমতি বিড়ি টানে। ওদের কেউ কিছু বলে না। ওরা তো কুলিলাইনে থাকে, আদিবাসী। খুব স্বাধীন ওরা। আমার আর মউয়ের খুব ইচ্ছা আমরা আদিবাসী মদেশিয়া হয়ে যাব। লেখাপড়া করতে হবে না। সবুজ চা-বাগানে পাতি টিপব আর লবণ-চা খাব। দিগন্ত বিস্তৃত ইউরোপীয়ান ক্লাব মাঠে মাদলের তালে তালে গান গেয়ে নাচ করব। খুব হাঁড়িয়া খাব। একদম মাতাল নাচব কোজাগরী চাঁদের রাতে!
রুপালি, রুবলান ওরাও আদিবাসী হয়ে যেতে চায় গায়ে উল্কি আঁকার জন্য আর রুপোর গয়না পরে নাচবে বলে। কৈয়ো বলে, উল্কি পরতে খুব যন্ত্রণা, আর হি হি হি, মানুষের বুকের দুধ লাগে নাকি! অ্যা মাঃ! ছিঃ! আমি কোনও দিন উল্কি পরতে চাই না। কিন্তু আদিবাসী হতে হলে ওটা চাই-ই চাই। মউয়ের আপত্তি নেই। ও নাকি পায়ে উল্কির লতাপাতা আঁকবে। আর হাট থেকে কেনা সস্তার সুতির শাড়ি পরবে হাঁটু পর্যন্ত। ‘সত্যম শিবম সুন্দরম’ ফিল্মের জিনত আমনের মতন। তাই শুনে ফুলটুস বলল, ‘ওই রকম খালি গা?’
মউ বলে, ‘হতেই পারি, তবে তোরা কেউ কাতুকুতু দিবি না বল।’
হি হি হি! মউকে জিনত সাজলে খুব মানাবে। যা লম্বা! কিন্তু যা কাতুকুতু ওর! খোলা ময়দানে বাতাসের পরশেও না হেসে কুটিপাটি হয়!
আদিবাসী হওয়ার প্রথম পাঠ হিসেবে আমরা কৈয়ো আর ভাগমতির কাছে ওদের গান শিখছি। নাচও। তার সঙ্গে একটু খৈনি, একটু বিড়িতেও টান।
সে দিন হয়েছে কী, কলকাতা থেকে হঠাৎ আমাদের জ্যাঠতুতো দাদা এসে উপস্থিত। আমার বাবার আপন পিসতুতো দাদা, আমাদের বাটার জেঠুর বড় ছেলে। মা বললেন, ‘যা তো তোর বাবাকে খবর দে।’
সন্ধে গড়িয়ে গিয়েছিল। পড়তে বসব-বসব করছিলাম। দেবুদা এসেছেন মানে আজ পড়ায় ছুটি। আমি আর কৈয়ো খুশি মনে বাবার আপিসে চললাম। বাবা অনেক রাত পর্যন্ত কাজ করেন। বড়বাবু কিনা! অনেক দায়িত্ব! আবার বাটার জেঠুর ছেলে এসেছে, সে-খবর পাঠানো জরুরি মনে করেছিল মা। বাটানগরের জুতোর কারখানায় জেঠু মস্ত ম্যানেজার। তাই বাটার জেঠু!
আমি আর কৈয়ো অন্ধকারে চলেছি। আজকাল বাঁশবাগান, তেঁতুলতলা, খেলার মাঠের একঠেঙে তালগাছের ঝাঁকড়া মুণ্ডু— কোনও কিছুই আমরা ভয় পাই না। কৈয়ো খৈনি টিপে নীচের ঠোঁটের ভাঁজে গুঁজে বলল, ‘খাবি?’
‘দে।’
‘রসটা খেয়ে ফেলিস না কিন্তু। মাথা ঘুরবে।’
বললেই কি আর হয়? রস কি কোনও নিষেধ মানে? যেখানে যাবার, সে যাবেই। বাবাকে যখন দেবুদার খবর দিচ্ছি, আমার মাথা ঘুরছে, গা গুলোচ্ছে। বাবা গভীর মনোযোগে কাজ করছিলেন, বললেন, ‘ঠিক আছে, ঘণ্টাখানেক বাদে যাচ্ছি।’
আমি সুড়ুৎ করে বেরিয়ে পড়লাম। নানা প্রয়োজনে চা কারখানার যত্র-তত্র জলের কল। তারই একটায় একেবারে থু থু থু। কী বিশ্রী জিনিস। কৈয়ো আমার মাথায় মুখে জলের ঝাপটা দিচ্ছে। ‘বললাম রস গিলবি না।’
‘কখন পেটে চলে গেছে! যত বাজে জিনিস। এর চেয়ে বিড়ি ভাল।’
‘ধ্যুৎ! বিড়িতে নেশা জমে নাকি?’ দাঁড়া একদিন হাঁড়িয়া খাওয়াব তোকে। তবে তুই যা ল্যাদাড়ুম দেখছি, শেষে বমিফমি করলে মাঈজি সব জানবে আর আমাকে কাজ থেকে বার করে দেবে।’
‘না রে বাবা! জানতেই পারবে না। মা মামাবাড়ি গেলে খাব কেমন?’
ভাগমতি বলেছে দারুর চেয়ে হাঁড়িয়া ভাল। আমি দারু খাব না। হিলটুর নাড়ুকাকা দিনরাত দারু খেয়ে পড়ে থাকে। গায়ে কী বোঁটকা গন্ধ। বিড়ির গন্ধটাও আমার বা মউয়ের কারও ভাল লাগেনি। রুবলান তো কেশেটেশে যা তা করল। রুপালি বলল, ‘না বাবা, বিড়ি খেলে আমার ঠোঁট কালো হয়ে যাবে।’
ভাগমতি বলল, ‘বিড়ি ভাল না লাগলে তোরা তেজপাতা গোল করে বিড়ির মতো টান। ভাল লাগবে।’
আমি, মউ, ফুলটুসি আজকাল সুযোগ পেলেই তেজপাতার বিড়ি টানি। মাঝে মাঝে শুকনো ভাঙপাতা গুঁজে দিই। একটা অন্য রকম গন্ধ। এটা ফুলটুসকে শিখিয়েছে আমাদের শিউজি জমাদারের ছেলে কেশব।
হেঃ! টেনিদা সঙ্ঘ কী ভাবে নিজেদের?
এ বার সরস্বতী পুজোয় সরস্বতী বাহিনী হাঁড়িয়া খাবেই। মা কসম! ভাগমতি বানিয়ে আনবে। আমরা এ বার কৈয়ো আর ভাগমতির হাতেখড়ি দেব। কারণ কৈয়োকে আমি কিছুতেই অ শেখাতে পারছি না। ডাঁটিটা কেবলই উল্টো দিকে দিয়ে দিচ্ছে! দেখি, মায়ের পায়ে বর্ণশুদ্ধি হয় কিনা। ও বলে, ওর নাকি লেখাপড়া হবে না। কেন হবে না? ভাগমতি অবশ্য সে রকম মনে করে না। আমরা যেমন আদিবাসী হতে চাই, ও হতে চায় বাঙালি। ‘শাওন কি ঝুলে পড়ে....’ দুর্দান্ত গায় ও। পরিষ্কার বাংলা বলে। আমাদের পাড়ায় মিঠুনদা ওকে বলেছে, ‘তোকে ভালবাসি।’ ওরা প্রেম করছে। বিয়েও করবে। ভাগমতি তাই শিক্ষিত বাঙালি হতে চায়। টেনিদা সঙ্ঘ কিছু জানে এ সবের? বোঝে? আমরা আমাদের বারোয়ারি পুজো মণ্ডপে শাড়ি পরে মালা-টালা গাঁথছি বলে ওদের খুব হাসি পাচ্ছে! কে বলল মালাগাঁথা শুধু মেয়েদের কাজ? ‘সত্যনারায়ণ বস্ত্রালয়’-এর ক্যালেন্ডার দেখে না নাকি? কেষ্টঠাকুরের পায়ের কাছে বসে গৌর-নিতাই ফুলের মালা গাঁথছে না?
আসলে আজকাল ওরা অন্য মতলবে আছে। যেন জানি না আমরা। প্রত্যেকের নজর আছে কোনও না কোনও মেয়ের দিকে। আমাদের কারও দিকে না। আমরা তো বন্ধু। বন্ধুরা তো বন্ধুই। প্রেম করতে গেলে আলাদা মেয়ে লাগে। বুঝি রে বাবা, সব বুঝি। অত লুকোনোর কী আছে! আমাদের সাহায্য ছাড়া চলবে তোদের?
অল্প অল্প করে আলাদা হয়ে যাচ্ছি আমরা। ওদের জগতে কী এক রহস্য! আমাদেরও সব রহস্যই কি বলতে পারছি ওদের? ছেলেদের সব কিছু বলতে নেই। নিষেধ আছে। ধুত্তোর নিষেধ! কেন বলা যাবে না? আজ ওরা অন্য কোথাও সন্ধিপুজো কাটাবে।
আমিই বললাম ওদের, ‘কেন রে?’
টোকন বলে, ‘তোর তাতে কী?’
‘কালও সন্ধ্যায় তোরা মণ্ডপে ছিলি না ফাঁকা ফাঁকা লাগে।’
‘আমাদের আর কোনও কাজ নেই!’
‘কাজ তো জানতে বাকি নেই। তাই বলে নিজেদের পুজোয় থাকবি না?’
অষ্টমী ছেড়ে নবমী পড়বে রাত্রি এগারোটা তিনে। দেখি, আমি, মউ আর ফুলটুসি আছি কেবল। বাকিরা? প্রেম করছে কোথায় কোথায়। মণ্ডপে বড়রা আছে তো ঠিকই। সমবয়সী বন্ধুরা না থাকলে ফাঁকা ফাঁকা লাগে না?
সাড়ে দশটায় রুবলান এল। মুখে লাজুক হাসি। আরও পনেরো মিনিট পর রুপালি। বলল, ‘দ্যাখ না, শুনছে না?’
রুপালির প্রেমিকের নাম রাজেন। রাজেন সাবকোটা। আমাদের স্কুলে পড়ে না কিন্তু। নেপালি ছেলে। হাওয়াইন গিটারিস্ট হিসেবে বেশ নাম। গতবার আমাদের দুর্গামণ্ডপে ‘এক চতুর নার বড়ে হোশিয়ারির’ গানের সঙ্গে নেচে একেবারে মোহিত করে দিয়েছিল। সে দিনই রুপালিকে প্রোপোজ করেছিল নাকি! ‘আমি তোমাকে ভালবাসি’ বলা ব্যাপারটাকে ভাল বাংলায় প্রোপোজ করা বলতে হয়। হিন্দি হাইস্কুলে রাজেন এখন বারো ক্লাসে পড়ে। আগে ও দার্জিলিঙে পড়ত বলে ইংরিজি কথায় একদম পাকা। সে নিয়ে রুপালির খুব গর্ব। ‘দ্যাখ না, শুনছে না’ বলতে বলতে ওর মুখ লাল।
‘আমার ঠোঁটটা নাকি ভীষণ লাল’ সন্ধিপুজোর সময় চুমু খাবে। খাবেই। তা হলে নাকি কোনও দিন ছাড়াছাড়ি হয় না!’
রুবলান বলল, ‘তুই দিবি?’
‘শুনছে না যে!’
ফুলটুস বলল, ‘কোথায় খাবি? যদি কেউ দেখে ফেলে?’
‘মণ্ডপের পেছনে। ওখানে অন্ধকার। ও থাকবে।’
প্রচণ্ড ঢাকঢোল কাঁসরঘণ্টা বাজছে। মায়ের সন্ধিপুজোর পরম লগ্ন। কী করে চুমু খায় দেখার অপ্রতিরোধ্য কৌতূহলে আমরা মণ্ডপের পিছন দিকে ফুলটুসিদের বাড়ির বাগানে অন্ধকারে মিশে রইলাম। ওই রুপালি। দাঁড়িয়ে আছে। ওই আসছে রাজেন। আরেঃ! একেবারে মিশে গেল যে। জড়িয়ে ধরেছে। চুমু কী ভাবে খাচ্ছে বুঝতেই পারলাম না! আর একটু ভাল করে দেখার জন্য এ ওর ঘাড়ের ওপর দিয়ে উঁকি মারছি। মউ বলল, ‘আমার গায়ে কাঁটা দিচ্ছে।’
‘আমারও।’
‘এই! কে আসছে দ্যাখ!’
রুপালির মা! চুপ! শব্দ করিস না!’
টর্চের আলো পড়ল। একঝলক। দুটি মুখ বিলগ্ন। তার পরই বিচ্ছিন্ন। কিছু বোঝার আগেই চম্পট দিল রাজেন। সাইকেলে উঠে চোঁ-চোঁ ছুট। রুপালির মা টর্চের বাড়ি মারলেন ওর মাথায়। ‘চল বাসায়। তোর একদিন কী আমার একদিন!’ রুপালি কাঁদছে। আমরা ওর মাথায় জল দিচ্ছি। ফুলে উঠেছে যে! সুজয়, হিলটু, টোকনরাও এসে জুটল। বলে, ‘বেশ হয়েছে। চুমু খেতে যা আরও।’
‘মা যা মারবে না!’ রুপালি ফোঁস ফোঁস করে বলল।
‘কেমন লাগে রে চুমু খেতে?’
আমরা সবাই হাঁ করে আছি। ছেলেরা মেয়েরা সবাই। রুপালি ফিক করে হাসল। চোখে জল কিন্তু। টর্চের আঘাতে ডবলু হয়ে ওঠা জায়গাটায় হাত বুলোতে বুলোতে বলল, ‘দারুণ! মনে হয় যেন উড়ছি! আরও ইচ্ছে করছিল, আরও, আরও...!’
অল্প অল্প শীতল বাতাস দিচ্ছিল। আমরা শিউরে উঠছিলাম। মণ্ডপে ভোগ নিবেদন হচ্ছে। বাজনা বাজছে। মায়েরা সব লালপাড় গরদ পরা।
সুজয় বলল, ‘বাড়ি ফিরে মার তো খাবিই আজ। আর চুমু খাবি?’
রুপালি বলল, ‘হুঁ উ উ!’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE