Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪
প্রবন্ধ ৪

বাংলার ঘরে ঘরে ‘তেরো পার্বণ’

খেয়ালী দস্তিদারসিরিয়াল নেবে গো বাবু? ভাল গল্প, ভাল অভিনয় আছে, দেখলে ভাল লাগবে। নেবেন নাকি বাবু, ভাল সিরিয়াল?’ শুনে নির্ঘাত মনে হচ্ছে, এ কী উদ্ভট কথা! কিন্তু ঠিক এই কথাগুলোই বলেছিলেন সোনেক্স প্রোডাকশন হাউস-এর অন্যতম কর্ণধার জোছন দস্তিদার। হতাশায়। ১৯৮৫-র ডিসেম্বর সেটা।

‘উড়নচণ্ডী’ সিরিয়ালের একটি দৃশ্যে খেয়ালী দস্তিদার ও জোছন দস্তিদার। ১৯৮৬।

‘উড়নচণ্ডী’ সিরিয়ালের একটি দৃশ্যে খেয়ালী দস্তিদার ও জোছন দস্তিদার। ১৯৮৬।

শেষ আপডেট: ০৮ মার্চ ২০১৫ ০১:০২
Share: Save:

সিরিয়াল নেবে গো বাবু? ভাল গল্প, ভাল অভিনয় আছে, দেখলে ভাল লাগবে। নেবেন নাকি বাবু, ভাল সিরিয়াল?’ শুনে নির্ঘাত মনে হচ্ছে, এ কী উদ্ভট কথা! কিন্তু ঠিক এই কথাগুলোই বলেছিলেন সোনেক্স প্রোডাকশন হাউস-এর অন্যতম কর্ণধার জোছন দস্তিদার। হতাশায়। ১৯৮৫-র ডিসেম্বর সেটা।

‘তেরো পার্বণ’ সিরিয়ালটির পঞ্চম পর্বের শুটিং করা হয়ে গেছে, কিন্তু কোনও কোম্পানিই কিনতে উত্‌সাহী নয়। কারও মতে, গল্পটা ভ্যাদভেদে, থ্রিল নেই। তখন দূরদর্শনের থেকে সময় কিনতে হত আগ্রহী কোম্পানিগুলোকে। সিরিয়াল ছিল স্পনসর্ড। শেষে, বিস্কফার্ম-এর কর্ণধার কে ডি পাল-এর মধ্যস্থতায় ক্যালকাটা কেমিকাল্‌স কিনল ‘তেরো পার্বণ’।

আসলে এটা সেই সময়ের কথা, যখন সিরিয়াল কী বা কেন, খায় না মাথায় মাখে, কেউ জানতেন না। কোন গল্প চলবে আর কোনটা চলবে না, তারও কোনও ধারণা নেই কারও। একদম শুরুর সময় কিনা!

ঠিক তেমনই আমারও ধারণা ছিল না, টিভি ক্যামেরার সামনে অভিনয় কী করে করতে হয়। আমার বাবা জোছন দস্তিদারকে জিজ্ঞেস করেছিলাম। উত্তর এসেছিল, ‘আর যা-ই করো, অভিনয় কোরো না। জাস্ট রই্যাক্ট। ঠিক যে ভাবে বাড়িতে বা বন্ধুদের সঙ্গে কথা বলো, ঠিক সেই ভাবে, নরম্যালি বলবে।’ বাবা তো বলেই খালাস। সেই নরম্যাল অ্যাক্টিংটা কতটা নরম্যাল হবে, এ বার সেই দুশ্চিন্তা।

চতুর্থ পর্বের শেষ দৃশ্য। সারা রাতের ঘটনা শেষ হয় ভোরে। গোরা-র (অভিনয়ে সব্যসাচী চক্রবর্তী) সঙ্গে দেখা হয় ড্রাগ অ্যাডিক্ট টিনএজার টিনা-র (আমি)। কথা-কাটাকাটি, চড়-থাপ্পড়ের পর, বন্ধুত্ব। ভোরে গঙ্গার ধারে বসে জীবনকে চেনায় গোরা। গোরা নাহয় টিনাকে জীবন চেনাল। আর ও দিকে জীবন আমাদের চিনে নিল ‘গোরা’ আর ‘টিনা’ হিসেবে। বাবা-মা’র দেওয়া আসল নামটাই হারিয়ে গেল। এক দিন বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছি, রাস্তা পার হব। এক ভদ্রলোক এগিয়ে এসে বললেন, ‘টিনা না? ঠিক চিনেছি! শোনো, রাস্তাঘাটে এমন রাত্তিরে বেরিয়ো না। কী ভাগ্যিস গোরা তোমাকে বাঁচাল, না হলে কী যে হত! আর পারলে ও-সব ড্রাগ নেওয়া বন্ধ করো।’ আমি তো প্রথমে বুঝতেই পারিনি, কী বলে যাচ্ছেন উনি। তার পরই, ইয়াহু! বুঝলাম, উনি আমাকে টিভিতে দেখেছেন আর এমন ভাবে দেখেছেন, যাতে খেয়ালী দস্তিদার ভো-কাট্টা, উনি টিনাকেই চিনেছেন। ‘একটা অটোগ্রাফ দাও তো, বাড়িতে গিয়ে দেখাব! নইলে কেউ বিশ্বাসই করবে না।’ বুকটা ভীষণ ধুকপুক করছে, উত্তেজনায়, আনন্দে। আমি কি বিখ্যাত হয়ে গেলাম? অটোগ্রাফ তো স্টাররা দেয়! কোনও মতে সইটা করে এক ছুট্টে বাড়ির ভেতর। সব্বার সঙ্গে শেয়ার করলাম আনন্দটা। আমার মা চন্দ্রা দস্তিদার শুধু বলেছিলেন, ‘পা দুটো মাটিতে রেখো।’

আসলে সোনেক্স ছিল একটা পরিবার। বাবা: জোছন দস্তিদার। মা: চন্দ্রা দস্তিদার। কাকু: সুজিত ঘোষ, আর শ্যামল সেনগুপ্ত, আমাদের কাছের মানুষ এঁরা ছিলেন ডিরেক্টর। সব্যসাচী চক্রবর্তী, আমার দাদা টেকনিকাল ডিরেক্টর। ‘তেরো পার্বণ’ থেকেই উঠে এল ইন্দ্রাণী হালদার, ফ্রক-পরা, বিনুনি-বাঁধা এইটুকু একটা মেয়ে। দুপুরে তো বটেই, রাতে ঘুমোবার আগে অবধি চলত মিটিং মিটিং মিটিং। শ্যামল সেনগুপ্তই প্রথম ভাবেন, সিরিয়ালটাও করা যায়, সিরিয়ালের ভবিষ্যত্‌ উজ্জ্বল। ভাবনা দানা বাঁধল। শুরু হল বিদেশ থেকে ম্যাগাজিন আনা, কী ক্যামেরা আসবে, কী এডিট সেট-আপ বসবে। বাবার কাছে ইন্টারভিউ দিল দেবাংশু সেনগুপ্ত। ইচ্ছে, অ্যাসিস্ট করবে বাবাকে। এক কথাতেই চাকরি পাকা। এডিটর হিসেবে এলেন পুনে থেকে সদ্য পাশ করা রবিরঞ্জন মৈত্র। সাউন্ডে সঞ্জয় মুখোপাধ্যায় (আমাদের স্যান্টাদা), আর চিন্ময় নাথ। সবাই এখন নিজেদের জগতে সুপ্রতিষ্ঠিত।

সবাই মিলে ছিলাম একটা দল। কে অভিনেতা, কে এডিটর, মাথাতেই রাখতাম না। রবি শুটিংয়ে চলে যেত। দেবাংশু বসে যেত এডিটে। সব্যসাচী ক্যামেরা ঘাঁটতে ব্যস্ত। ছোটকা, নাড়ুদের সঙ্গে হাত লাগিয়ে আমিও সেট সাজাতাম। একটা মজার পিকনিক যেন। তবে হ্যঁা, ‘অ্যাকশন’ শব্দটা শুনলেই সব্বাই রেডি। সিন শেষের পরই জে.ডি-র আড্ডা শুরু হত। জোছন দস্তিদারকে সবাই জে.ডি নামেই ডাকতাম। তিন দিন ধরে একটা এপিসোড শুট হত। হাসি মজায় কাজে সময় পেরিয়ে যেত ফুড়ুত্‌ করে।

এক দিন সারা রাত শুটিং। ভীষণ আনন্দে কাজ তো শুরু হল, কিন্তু মুশকিল হল রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে। সবাই ঢুলছে। কেউ চা খেয়েই চলেছে, কেউ ধোঁয়ায় দম। এ রকম ঘুম-ভরা পরিবেশে হঠাত্‌ অন্ধকার আকাশের বুক চিরে ভেসে এল নারীকণ্ঠের আকুল আকুতি: ‘বাঁচাও! কে আছ? বাঁচাও রক্ষা করো, রক্ষা করো!’ ক্যামেরা-লাইট ফেলে সবাই ছুটে গেল। দেখা গেল, আমাদের হেয়ারড্রেসার শেখর সবাইকে চাঙ্গা করার জন্য আকুল স্বরে নারীকণ্ঠে ডেকে চলেছে। ক’সেকেন্ড সব্বাই চুপ, তার পর হো হো হাসি। ঘুমটুম পালিয়ে গেল।

দীপক চৌধুরীর তৈরি ‘তেরো পার্বণ’-এর সেই বিখ্যাত টাইট্‌ল মিউজিক আজও কানে বাজে। যে-দিন বানানো হয় মিউজিকটা, আমরা সব্বাই মিলে সারা রাত জেগে বসেছিলাম মেজেনিন ফ্লোরের ছোট্ট সেই এডিটিং রুমে।

মার্চ মাসের ১ তারিখ। ১৯৮৬। প্রতি বৃহস্পতিবার রাত আটটায় বাংলার দর্শকদের জন্য শুরু হল ‘তেরো পার্বণ’। আশির দশকে বাঙালির সান্ধ্য-জীবনের অপরিহার্য অঙ্গ। সোনেক্স-এর জয়যাত্রা শুধু এতেই থেমে থাকেনি। একে একে ‘উড়নচণ্ডী’, ‘সেই সময়’, ‘নাচনী’, আরও কত সিরিয়াল। মাঝে মাঝে ভাবি, এই তো সে দিনের কথা। কিন্তু, আসলে ইতিহাস!

kheyali.dastidar@gmail.com

আশির দশকের কোনও ঘটনার সঙ্গে নাড়ির যোগ আছে?

লিখুন এই ঠিকানায়: হ্যালো 80s, রবিবাসরীয়, আনন্দবাজার পত্রিকা,

৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট, কলকাতা ৭০০ ০০১।
বা, লেখা pdf করে পাঠান এই মেল-ঠিকানায়: robi@abp.in

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

rabibasariyo hello 80's kheyali dastidar
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE