পঞ্চমের সঙ্গে আমার আলাপ বিমলদার (বিমল রায়) একটা সিনেমার আলোচনায়। শচীনদা (শচীন দেববর্মন) এসেছিলেন মিউজিক নিয়ে আলোচনা করতে। সঙ্গে পঞ্চমও এসেছিল। এর পরে এ রকম বহু সিনেমার আলোচনায় পঞ্চম আসত। আমি আর পঞ্চম দুজনেই তখন স্কুলবয়ের মতো বড়দের কথা আর আলাপ-আলোচনা শুনতাম। কিছু ক্ষণ পর পঞ্চম উঠে হয়তো একটু বারান্দায় দাঁড়াত, একটু হাঁটতে যেত। আর অমনি শচীনদা বলে উঠতেন, ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, আমি জানি, ও সিগারেট ফুঁকতে গেছে।’ আমিও উঠে যেতাম ওর সঙ্গে। ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে ও আমায় কখনও কখনও বলত, ‘আমি হলে এই গানটা এ রকম করে করতাম।’ দেখতাম, ওর ভাবনার সঙ্গে আমার ভাবনা মিলে যেত। দু’জনের ট্যারাব্যাঁকা চিন্তাগুলো একে অন্যের কাছে খুব ঠিকঠাক মনে হতে লাগল। আর তখনকার কোনও একটা সময় থেকেই একটা গাঢ় বন্ধুত্ব শুরু হয়ে গেল।
আমার সিনেমায় প্রথম সুর দেবে পঞ্চম। একটা গান তৈরির কথা হল। সেই গানটার আদি-অন্ত, কোথায় থাকবে, কী স্ক্রিপ্ট অনুযায়ী হবে, পঞ্চমের সবটা জানা দরকার ছিল। এক দিন রাত বারোটা নাগাদ আমার বাড়ির নীচে এসে হর্ন বাজাচ্ছে পঞ্চম। বলল, ‘নেমে আয়, একটা সুর মাথায় এসেছে।’ বাধ্য ছেলের মতো আমিও নেমে গিয়ে চললাম তার সঙ্গে রাত-সফরে। গাড়ির ক্যাসেট প্লেয়ারে সে দু’লাইন সুর করে এনেছে। বলল, ‘এই সুরটায় কথা বসিয়ে দে, না হলে হারিয়ে যাবে।’ আমি বললাম, ‘এখন, এ ভাবে গাড়িতে বসে, হয় না কি?’ বলল, ‘হতেই হবে। এটাই তোর সিনেমার গান।’ অগত্যা। আমি কথা লিখলাম দু’লাইন। তার পর আরও দু’লাইন, তার পর আরও দু’লাইন। আর প্রথম দু’লাইন সুর করার পর পঞ্চম সুর করল আরও দু’লাইন, তার পর আরও দু’লাইন। সংগত দিল রাতের বম্বের এ-রাস্তা ও-রাস্তা, অলিগলি। রাত বারোটা থেকে চারটে অবধি যুগলবন্দি চলল। গানটা তৈরি হয়ে গেল। সেটাই ছিল মিউজিক ডিরেক্টর পঞ্চমের সঙ্গে চিত্রপরিচালক গুলজারের প্রথম সিনেমা ‘পরিচয়’, প্রথম গান ‘মুসাফির হুঁ ইয়ারোঁ’।
পঞ্চমকে পাগলাটে বললে খানিক বোঝা যাবে ওকে। আর সেটাই সব সময় ও বয়ে নিয়ে বেড়িয়েছে জীবনের প্রতিটি ক্ষণে, প্রতিটি কাজে, প্রতিটি গানে, প্রতিটি সৃষ্টিতে। এক দিন গাড়ির সামনের সিটে ড্রাইভারের পাশে বসে আমি ফিরছি। আনমনেই ছিলাম। একটা সিগনালে দাঁড়ানোর ঠিক আগে হঠাৎ শুনি, ‘গুল্লু, অ্যাই গুল্লু’ বলে পঞ্চম ডাকছে। সিগনালে আমার গাড়ির একটা গাড়ি পরে পঞ্চমের গাড়ি দাঁড়াল, ও নিজেই চালাচ্ছিল। পঞ্চম তো পঞ্চম, ওকে তো সেই সময়েই আমার সঙ্গে কথা বলতে হবে। কিন্তু উপায়টা কী? দেখি আমাদের মাঝখানে যে গাড়িটা দাঁড়িয়েছিল তার চালককে বলছে কাচ নামাতে। সে বেচারা এক দিকের কাচ নামিয়ে পঞ্চমের কথার উত্তর দেওয়ার আগেই পঞ্চম তাকে বলছে ড্রাইভারের ডান দিকের কাচটাও নামিয়ে দিতে। সে কেমন একটা ভ্যাবলা হয়ে মন্ত্রঃপূতের মতো পঞ্চমের আদেশ পালন করল। দু’দিকের কাচ নামিয়ে দিল। আর তখন পঞ্চম বেশ জোরে জোরে আমার সঙ্গে একটা গাড়ি পেরিয়ে কথা বলতে শুরু করল। মাঝখানের গাড়ির চালক, এক বার আমার দিকে তাকায়, এক বার পঞ্চমের দিকে। এমন অভিনব গল্প করার উপায় সে কখনও দেখেছে বা জানত বলে মনে হল না। সিগনাল ছেড়ে দিল। পঞ্চম আমায় বলল, ‘এ গুল্লু, চল, সামনে মিলতে হ্যায়।’ অর্থাৎ কিনা আমার গাড়িটাকে ওর গাড়ির প্যারালাল করে চালাতে হবে, যাতে ও আমার সঙ্গে গল্প করতে করতে যেতে পারে।
এই রকমটাই ছিল পঞ্চম। এ রকম না হলে কেউ লঙ্কার ঝালের ছটফটানি থেকে ‘দুনিয়া মে লোগোঁ কো’ গানের দু’লাইন পর পর ‘হা হা হা হা হা’ যে আওয়াজটা আবিষ্কার করল, সেটা করতে পারত না। ওই আওয়াজটাই হয়ে গেল ডিফাইনিং ফ্যাক্টর। পঞ্চমকে দেখে বুঝতাম সুর জীবনের প্রতিটি কণা থেকে কখনও খুঁজে নিতে হয়, কখনও খুঁড়ে বের করতে হয়, কখনও লুফে নিতে হয় আর কখনও বুকের কাছে বালিশ টেনে গোঙাতে হয়। তবেই সরস্বতী ও রকম মানুষের কাছে ধরা দেয়।