Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪
কা গে র ছা ব গে র ছা

ভালবাসার আর জিনিস পেলি না?

শুরুরও একটা শুরু থাকে। ‘দূরত্ব’ আমার প্রথম কাহিনিচিত্র হলেও তার বেশ কিছু কাল আগে আমি একটি ছোট ছবি, মানে স্বল্প দৈর্ঘ্যের কাহিনিচিত্র করেছিলাম, ‘সময়ের কাছে’। সেটাই আদতে আমার প্রথম ছবি। তখন ছোট ছবির তেমন চল ছিল না। কারণ, ছবিগুলির কোনও ব্যবসায়িক দিক ছিল না। কোথায় দেখানো হবে? কে টিকিট কাটবে? কেনই বা টিকিট কেটে ছোট ছবি দেখবে লোকে?

বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত
শেষ আপডেট: ১৫ মে ২০১৬ ০০:০৩
Share: Save:

শুরুরও একটা শুরু থাকে। ‘দূরত্ব’ আমার প্রথম কাহিনিচিত্র হলেও তার বেশ কিছু কাল আগে আমি একটি ছোট ছবি, মানে স্বল্প দৈর্ঘ্যের কাহিনিচিত্র করেছিলাম, ‘সময়ের কাছে’। সেটাই আদতে আমার প্রথম ছবি। তখন ছোট ছবির তেমন চল ছিল না। কারণ, ছবিগুলির কোনও ব্যবসায়িক দিক ছিল না। কোথায় দেখানো হবে? কে টিকিট কাটবে? কেনই বা টিকিট কেটে ছোট ছবি দেখবে লোকে?

২০২ রাসবিহারী অ্যাভিনিউ-এ তখন থাকতেন জ্যোতির্ময় দত্ত ও মীনাক্ষী দত্ত, মানে মীনাক্ষী বসু। বুদ্ধদেব ও প্রতিভা বসুর জ্যেষ্ঠ কন্যা। ২০২ রাসবিহারী অ্যাভিনিউ ছিল বুদ্ধদেব ও প্রতিভা বসুর বাড়ি এবং ‘কবিতা’ পত্রিকার ঠিকানাও। ২০২-এর দোতলায় কবিতা নিয়ে যাননি অথচ কবি, এমন মানুষ তখন জন্মাননি। ওই বাড়িরই তিন তলায় থাকতেন কবি অজিত দত্ত। আর জ্যোতির্ময় দত্ত ছিলেন সে সময়ের ‘দ্য স্টেটসম্যান’ পত্রিকার বিখ্যাত চলচ্চিত্র-বিভাগীয় সম্পাদক। সত্যজিৎ রায়ও মান্য করতেন। বয়সে অনেক বড় এ হেন জ্যোতির্ময়ের সঙ্গে আমার যে কী করে দারুণ বন্ধুত্ব হয়ে গিয়েছিল তা আর মনে করতে পারি না। জ্যোতিদা বলে ডাকা মোটেও পছন্দ ছিল না ওঁর। উনিই আমায় শিখিয়েছিলেন ‘সবাইকে নাম ধরে ডাকবেন আর ‘আপনি’ বলবেন, ব্যস হয়ে গেল।’ হয়ে যে যায়নি তা কিছু দিন পরেই বেশ বুঝতে পারলাম। হাওড়ার কোথাও এক অদেখা ভদ্রলোককে কিছু দিতে পাঠিয়েছেন বাবা। তখন আমি পারলে বাবাকেও নাম ধরে ডাকি। বাড়িটার সামনে গিয়ে আমি চেঁচিয়ে ভদ্রলোককে ডাকছি, রমেশ, বাড়ি আছেন? বাড়ির চাতালে এক বুড়ো আপনমনে তেল মাখছেন আর আমি বাবার সেভেন-ও-ক্লক ব্লেড দিয়ে রোজ লুকিয়ে লুকিয়ে দাড়ি-গোঁফ কামিয়ে চলেছি যাতে একটু মোটাসোটা হয় গোঁফের রেখাটা। হঠাৎ বুড়ো ভদ্রলোক খেঁকিয়ে উঠলেন, ‘তখন থেকে রমেশ রমেশ বলে ডাকছ যে, তুমি রমেশের সঙ্গে ইস্কুলে পড়তে? রমেশ তোমার বন্ধু? ডেঁপো পেছনপাকা ছেলে কোথাকার! রমেশ বাড়ি নেই। হাসপাতাল গেছে। ওর বউয়ের আজ পাঁচ নম্বর ডেলিভারি।’

আদতে জ্যোতির্ময় দত্ত ছিলেন কবি আর ‘কলকাতা’ পত্রিকার সম্পাদক। সুনীল-শক্তি-শরৎ-সমরেন্দ্রর সমসাময়িক। ওঁর বিখ্যাত সেই লাইন এখনও আমার মনের ভেতর মাঝে মাঝেই ঘুরপাক খেয়ে যায়। ‘কাছিম তো সারাক্ষণ জলে/ কাছিমের চোখে জল এলে/ কি করে বুঝবে বলো, অপর কাছিম?’

ফেডারেশন অব ফিল্ম সোসাইটিজ অব ইন্ডিয়া-র বেশ কয়েক জন মধ্যমণির মধ্যে ছিলেন সত্যজিৎ রায়, বিজয়া মুলে, চিদানন্দ দাশগুপ্তরা। এঁরা সবাই মিলে একটা স্ক্রিপ্ট কম্পিটিশন করবেন ঠিক করলেন। সেই অনুযায়ী বিজ্ঞপ্তিও বেরল। আমি তখন বিএ পড়ি, লীলার সঙ্গে ইয়ে করি আর গভীর ভাবে ভালবাসি সিনেমাকে। কফি হাউসের কবি-বন্ধু তুষার রায় সবে লিখেছেন, ‘মুভি ডিরেক্টর বললেন হেসে/ ফেলিনি আমার মামা।’ আমারও তখন সেই দশা। বাবাকে বলেছিলাম, পুণে ইন্সটিটিউট-এ ফিল্ম পড়তে চাই। বাবা বলেছিলেন, দরজা খোলা আছে, বেরিয়ে যাও। ভদ্রলোকের ছেলে ফিলিম পড়বে! বিজ্ঞপ্তিটা পড়েই একখানা স্ক্রিপ্ট লিখে ফেললাম আর পাঠিয়েও দিলাম। অদ্ভুত ব্যাপার, হবি তো হ, আমার স্ক্রিপ্টটাই ফার্স্ট হয়ে গেল। তিন হাজার টাকা পেলাম ফেডারেশন থেকে, তাই দিয়েই ছবির কাজ শুরু করতে হবে, পারলে শেষও।

ক্যামেরা, ক্যামেরাম্যান, অ্যাসিসট্যান্ট, এমনকী হিরো— সব ঠিক হয়ে গেল। কিন্তু নায়িকা কোথায় পাই? জ্যোতির সঙ্গে আলোচনা করতে এক দিন ওর বাড়ি গিয়েছি, মীনাক্ষী চা দিয়ে গেলেন। জ্যোতির্ময় বললেন, মীনাক্ষীকেই নিন না, ও দারুণ ফোটোজেনিক। মীনাক্ষীও রাজি হয়ে গেলেন। শুরু হয়ে গেল শুটিং। তিন দিনের শুটিং। এর বেশি দিন বাড়ানোর রেস্ত নেই। স্বামীর দাদা হঠাৎ রোড অ্যাক্সিডেন্টে মারা যায়। দাদার সংসারের সমস্ত দায়িত্ব এসে পড়ে স্বামী-স্ত্রীর ওপর। সামাল দিতে স্কুলের চাকরি নিয়ে দূরে চলে যায় স্ত্রী। কখনও ছেলেটি চলে যায় সেই ছোট্ট শহরে যেখানে স্ত্রীর চাকরি, কোনও কোনও সপ্তাহে মেয়েটি আসে কলকাতার বাড়িতে। এটাই অভ্যেস হয়ে যায় আস্তে আস্তে। তার পর যখন আবার একসঙ্গে থাকার সুযোগ আসে, তখন ওরা বুঝতে পারে, ভালবাসাটা বাঁচিয়ে রাখতে আলাদা থাকাটাই ঠিক।

এক ফিল্ম-পাগল অধ্যাপক গুরুদাস ভট্টাচার্য তখন বের করতেন ‘ফিল্ম’ নামে এক ফিল্ম পত্রিকা। কে লেখেননি সেখানে! বিখ্যাত সব ছবির চিত্রনাট্যও ছাপা হত। ‘ফিল্ম’ পত্রিকার কোনও এক সংখ্যায় ছাপা হল আমার সেই ছোট্ট ছবির চিত্রনাট্য। কারও কাছে হয়তো এখনও আছে সেই সংখ্যাটি, যদিও আমার কাছে আমার প্রথম ছবিটির কোনও কিছুই আজ আর নেই।

শুটিং শেষ, পয়সা হজম। একটা ক্যান-এর মধ্যে পজিটিভ প্রিন্ট নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি এক স্টুডিয়ো থেকে আর এক স্টুডিয়ো। পাকড়াও করতে হবে বুলুকে, যিনি আসলে এক জন অ্যাসিসট্যান্ট এডিটর। দয়াপরবশ হয়ে আজ এক ঘণ্টা এখানে তো কাল আধ ঘণ্টা ওখানে সময় দেন। যতটুকু ইচ্ছে ফিল্ম এডিট করে দেন, বাকিটা বগলে নিয়ে আমি আবার ঘুরে বেড়াই। এ ভাবেই এক দিন ইন্দ্রপুরী স্টুডিয়োর দোতলার এডিটিং রুমে বুলুর সন্ধানে উঁকিঝুঁকি মারছি, বয়স্ক এডিটর ভদ্রলোক দেখতে পেয়ে হাত নেড়ে ডাকলেন, ‘এক মাস ধরে দেখছি খালি এখানে-ওখানে ঘুরঘুর করেন, কী চাই? হাতে ওটা কী?’ বললাম সব। ‘কী করা হয়?’ বললাম তা-ও। শুনে বোধহয় একটু মায়াদয়া হল, বললেন, ‘এডিট করবেন? তাল বোঝেন?’ মাথা নাড়লাম। ‘দাদরা, কাহারবা, চৌতাল বোঝেন? এডিটিং আসলে তাল। যেখানে ঝাঁপতাল বসবে সেখানে তিনতাল লাগালে চলবে? এক-এক ছবির এক-এক তাল। তা না হলেই বেতালে বাজবে সিনেমা। বুঝেছেন? এটা কখনও ভুলবেন না।’ ভুলিনি। দেশ-বিদেশের শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র সমারোহে ঘুরেও এত সহজে এমন আপ্তবাক্য বলতে আর কাউকে শুনিনি।

বুলুর খোঁজে এ ভাবে চরকি খেতে খেতে এক দিন টালিগঞ্জ-কাঁপানো ডাকসাইটে এডিটর অরবিন্দ ভট্টাচার্যর সামনে গিয়ে পড়লাম। বুলু ওঁরই তৃতীয় অ্যাসিসট্যান্ট। বুলুর কথা জিজ্ঞেস করায় বিরক্ত হয়ে বললেন, ‘কী দরকার?’ আবার বললাম সব কথা। শুনে হাত থেকে ক্যান নিয়ে মুভিওয়ালা-য় চালিয়ে দিয়ে বললেন, ‘দেখি তো কী করেছেন।’ আমি কাঁচুমাচু হয়ে দাঁড়িয়ে আছি। ভদ্রলোক একাধিক বার ‘রাশ’ দেখলেন, তার পর অদ্ভুত উত্তেজিত হয়ে বলে উঠলেন, ‘এই ছবি আপনি করেছেন? এই এডিট বুলু-ফুলুর কম্মো নয়। আমি এডিট করে দেব আপনার ছবি। কিচ্ছু পয়সা লাগবে না।’ দেড় মাস ঘোরার পর চার দিনে সব কাজ শেষ। বাকি রইল শুধু সাউন্ড মিক্সিং। কিন্তু তার পয়সা জোগাবে কে? মা-কে বললাম, কালকের মধ্যে ইকনমিক্‌সের তিনটে বই কিনতে হবে। তিনশো টাকা লাগবে। নইলে কিন্তু ফেল করে যাব। মা ভয়ের চোটে তিনশো টাকা বের করে দিল আর আমার ছবির সাউন্ডের কাজও শেষ হয়ে গেল।

ছবি দেখিয়ে পঞ্চাশ টাকা করে পেতাম ফিল্ম-ক্লাবগুলোর থেকে। সেই টাকা পকেটে ঢোকার আগেই ছোঁ মেরে তুলে নিত খালাসিটোলা। মাঝরাতে বাড়ি ফিরে দেখতাম, মা কাঁদছেন। মাকে জড়িয়ে ধরে নাচতে নাচতে আমিও কাঁদতাম। মা বলতেন, তুই কার জন্য কাঁদিস?

সিনেমার জন্য। তুমি?

তোর জন্য। তোর যে কী হবে! ভালবাসার আর জিনিস পেলি না?

পেলাম না তো। সিনেমার থেকেও বেশি ভালবাসা? ওরেব্বাস!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Tollygunge Rabibasariya Buddhadeb Dasgupta
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE