Advertisement
১৮ এপ্রিল ২০২৪

১০১ আপ পক্ষীরাজ এক্সপ্রেস

মানে রাজধানী এক্সপ্রেস। সারা স্টেশন কাঁপিয়ে যেন প্রায় উড়ে যেত সে। বিত্তবান লোকেদের কাছে ছিল স্টেটাস সিম্বল। ৫০ বছর আগে আজকের দিনেই হাওড়া থেকে যাত্রা শুরু হয়েছিল তার। ১৯৬৯ সালের আজকের দিনেই রাজধানী এক্সপ্রেস হাওড়া থেকে প্রথম যাত্রা শুরু করে। তখন এই ট্রেনে দু’ধরনের শ্রেণি— প্রথম শ্রেণি ও চেয়ার কার।

ঐতিহাসিক: যাত্রা শুরু রাজধানী এক্সপ্রেসের। ৩ মার্চ ১৯৬৯।

ঐতিহাসিক: যাত্রা শুরু রাজধানী এক্সপ্রেসের। ৩ মার্চ ১৯৬৯।

সোমনাথ রায়
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৩ মার্চ ২০১৯ ০০:০১
Share: Save:

সত্যজিৎ রায়ের ছবিতে ভারতীয় রেলের অনেক কিছু ধরা পড়েছে, যার অধিকাংশেরই এখন অস্তিত্ব নেই। ‘পথের পাঁচালী’তে দেখা কালো কুণ্ডলী পাকানো ধোঁয়া-বেরোনো ইঞ্জিন দিয়ে শুরু। অপু অবশ্য বড় হয়ে রেল ইয়ার্ডের ধারেই এক ভাড়াবাড়িতে ‘অপুর সংসার’ পেতেছিল। ‘নায়ক’ ছবিতে ‘ডাইনিং কার’-এ বসে অরিন্দম তার জীবনকাহিনি বলেছিল এক মহিলা পত্রিকার সম্পাদক অদিতিকে। সেই ডাইনিং কারও আজ বিলুপ্ত।

‘সোনার কেল্লা’ ছবিতে ফেলুদা ও তোপসে যে ট্রেনে ডাক্তার হেমাঙ্গ হাজরা ও মুকুলের খোঁজে রওনা হয়েছিল, সেই তুফান এক্সপ্রেসও নাম পাল্টে আজ ‘উদয়ন আভা তুফান এক্সপ্রেস’। বাংলা সাহিত্যে ও চলচ্চিত্রে ‘তুফান এক্সপ্রেস’ বা চালু কথায় ‘তুফান মেল’-এর আলাদা জায়গা। ‘শেষ উত্তর’ ছবিতে কানন দেবীর গলায় আর লিপে ‘তুফান মেল যায়’ গান মানুষের মুখে মুখে ফিরত। ‘সোনার কেল্লা’ ছবিতেই দেখানো হয়েছিল সাধারণ প্রথম শ্রেণির কামরা, যার একটা কুপ-এ ডাক্তার হেমাঙ্গ হাজরা ও মুকুল, অন্য একটায় মন্দার বোস ও বর্মণ। কুপ ও কেবিন-শোভিত এই সাধারণ প্রথম শ্রেণিও বিলুপ্ত। এই ছবিতেই দেখানো হয়েছিল হাতে-লেখা রিজ়ার্ভেশন চার্ট, ছবির জন্য স্বয়ং সত্যজিতের হাতের লেখায়। কম্পিউটার-প্রিন্টেড চার্টের দাপটে কোথায় হারিয়ে গিয়েছে সেও!

রেলের মুকুটে তখনও অবধি উজ্জ্বলতম পালকটিকে দেখা গেল সত্যজিতের শেষ ছবি ‘আগন্তুক’-এ। রাজধানী এক্সপ্রেস! দীর্ঘকাল প্রবাসী মনমোহন মিত্র দিল্লি হয়ে কলকাতা ফিরছেন এই ট্রেনে, প্যান্ট্রি থেকে তাঁর সিটে পরিবেশন করা হচ্ছে ডিনার!

কাগজের বিজ্ঞাপন

কৈশোরে বর্ধমান, আসানসোল স্টেশনে দাঁড়িয়ে বিদ্যুতের গতিতে ছুটে যেতে দেখেছি রাজধানী এক্সপ্রেসকে। গতির অহঙ্কারে স্টেশন কাঁপিয়ে, অপেক্ষমাণ যাত্রীদের যাবতীয় মনোযোগ নিজের অপস্রিয়মাণ অবয়বের দিকে আকৃষ্ট করে অন্তর্হিত হত সে। স্টেশনের মাইকে ঘোষণা হত নিরাপদ দূরত্বে সরে দাঁড়ানোর। তবু প্ল্যাটফর্মের কাছে এসে, অবাক বিস্ময়ে দেখতাম রাজকীয় ট্রেনকে। চোখে স্বপ্ন, কবে চড়ব!

স্বপ্ন সার্থক হতে লেগেছিল অনেকগুলো বছর। প্রধান কারণ, রাজধানীর আকাশছোঁয়া ভাড়া। ১৯৬৯ সালের আজকের দিনেই রাজধানী এক্সপ্রেস হাওড়া থেকে প্রথম যাত্রা শুরু করে। তখন এই ট্রেনে দু’ধরনের শ্রেণি— প্রথম শ্রেণি ও চেয়ার কার। পুরো ট্রেনটাই বাতানুকূল। তার আগেই অবশ্য হাওড়া নয়াদিল্লির মধ্যে পুরো বাতানুকূল ‘এয়ারকন্ডিশনড ডিলাক্স এক্সপ্রেস’-এর দৌড় শুরু হয়েছে। এই ট্রেনেই ‘নায়ক’ অরিন্দম যাচ্ছিল দিল্লি। নাম পাল্টে এই ট্রেন পরে হয়েছে পূর্বা এক্সপ্রেস। এখন আর তা পুরো বাতানুকূলও নয়।

রাজধানীতে বাতানুকূল প্রথম শ্রেণির ভাড়া প্রথমে ছিল ২৮০ টাকা, আর চেয়ার কারের ভাড়া ৯০ টাকা (হাওড়া-দিল্লি)। যাত্রাপথে ট্রেন দাঁড়াত ধানবাদ, গয়া, মুঘলসরাই, ইলাহাবাদ, কানপুর স্টেশনে। গয়া আর কানপুর ছিল সম্ভবত ‘ক্রু চেঞ্জিং পয়েন্ট’। কমার্শিয়াল স্টপেজ ছিল না। টিকিট দেওয়া হত ‘এন্ড টু এন্ড’ ভিত্তিতে, অর্থাৎ হাওড়া-ধানবাদ-মুঘলসরাই থেকে শুধুমাত্র নিউ দিল্লিই যাওয়া যাবে। মাঝপথে মুঘলসরাই বা ইলাহাবাদ অবধি টিকিট পাওয়া যেত না। সাধারণ মানুষের রোজকার গল্পগুজব-হাসিঠাট্টাতেও ঢুকে গিয়েছিল এই ট্রেন। কেউ কোনও বিষয়ে বড় বড় কথা বললে বলা হত, বাবা, এ দেখছি রাজধানী এক্সপ্রেস, ছোট স্টেশনে থামেই না!

প্রথম দিকে ট্রেনে দুটো লাউঞ্জ কার-ও ছিল। সেখানে জানালার ধারে সোফায় বসে প্যান্ট্রি কার থেকে আনানো চা-কফির সঙ্গে খবরের কাগজ, ম্যাগাজ়িন পড়া যেত। পরে দুটো লাউঞ্জ কার কোচ হিসেবে শান্তিনিকেতন এক্সপ্রেস-এর সঙ্গে লাগানো হয়। সেখানে টিকিট কেটে যাত্রীরা চড়তে পারতেন। রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয়বহুল হওয়ায় পরে কোচগুলো সরিয়ে নেওয়া হয়।

সময়ের সঙ্গে সঙ্গে রাজধানী এক্সপ্রেসের বিন্যাসেও এসেছে অনেক পরিবর্তন। চেয়ার কার উঠে গিয়েছে, রাতের যাত্রায় চেয়ার কার শারীরিক স্বাচ্ছন্দ্যের পরিপন্থী, এই যুক্তিতে। ১৯৮৩ সালে এল টু-টিয়ার, ১৯৯৩ সালে থ্রি-টিয়ার। উদ্দেশ্য স্পষ্ট। শুধু বিত্তবানদেরই নয়, উচ্চ মধ্যবিত্ত শ্রেণির যাত্রীদেরও আকৃষ্ট করা, এবং যাঁরা বিমান ভ্রমণে অস্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন তাঁদের বিমানের সমান আরামদায়ক পরিষেবা দেওয়া। এই কাজে সফলও হয়েছিল রেল। বিমানভাড়া ছিল তখনকার নিরিখে খুব বেশি, তাই পয়সাওলা আর উচ্চ মধ্যবিত্ত মানুষের কাছে ‘স্টেটাস সিম্বল’ হয়ে ওঠে রাজধানী এক্সপ্রেস। অন্য ট্রেনের চেয়ে ভাড়া অনেক বেশি হওয়া সত্ত্বেও টিকিটপ্রার্থীর ভিড় সামাল দিতে হিমসিম খেত রেল কর্তৃপক্ষ। ভিড়ের চাপ থেকে রক্ষা পেতে পরবর্তী কালে শিয়ালদহ থেকেও আর একটি রাজধানী চালানোর সিদ্ধান্ত নেয় রেল। আর হাওড়া রাজধানী সপ্তাহে এক দিন ধানবাদ-গয়ার বদলে পটনা হয়ে যেতে শুরু করে।

পুজো বা গরমের ছুটিতে, অন্যান্য উইকএন্ড লাগোয়া বড় ছুটিতে যাত্রী আকর্ষণের জন্য খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন বেরোত রেলের তরফে। থাকত চমৎকার সব লাইন ড্রয়িং, বাংলা গল্প-কবিতা থেকে উদ্ধৃতি। দেখেই মন উড়ু-উড়ু হত। নির্দিষ্ট একটি ট্রেনের জন্য বিজ্ঞাপন, এমনটা হত না। রাজধানী এক্সপ্রেস সেখানেও ব্যতিক্রম। প্রকাশিত বিজ্ঞাপনে রাজধানীর দুরন্ত গতিকে (তখন ঘণ্টায় ১২০ কিমি) তুলনা করা হয়েছিল পক্ষীরাজ ঘোড়ার সঙ্গে, যাতে চড়ে ১৭ ঘণ্টা ২০ মিনিটেই দিল্লি পৌঁছে যাওয়া যাবে। ট্রেন সপ্তাহে দু’বার, হাওড়া থেকে সোম আর শুক্রবার, নয়াদিল্লি থেকে বুধ আর শনি। ‘ভ্রমণ হবে আরামদায়ক, বিলাসবহুল এবং ধুলোবালিমুক্ত।’ বিজ্ঞাপনে থাকত এলাহি খাওয়াদাওয়ার কথাও: ‘প্যান্ট্রি কার থেকে আপনার আসনে চমৎকার আহার্য— সন্ধ্যার চা, রাতের খাবার ও প্রাতঃরাশ— পৌঁছে দেবার ব্যবস্থা আছে।’ প্রথম শ্রেণির যাত্রীদের জন্য ছিল আ-লা-কার্ত মেনু (ভেজ বা নন-ভেজ); চেয়ার কার, বা পরে টু আর থ্রি-টিয়ারের যাত্রীদের জন্য নির্দিষ্ট মেনু। পুরনো যাত্রীরা আজও রাজধানীর ফিশ ফ্রাইয়ের কথা মনে করে স্মৃতিমেদুরতায় আচ্ছন্ন হন। তার স্বাদ নাকি ছিল অপূর্ব!

রাজধানীর টিকিটও ছিল অন্য রকম। তখনকার বিমান টিকিটের মতো দু’পাশে মোটা কাগজের ফ্ল্যাপওয়ালা এক পাতার টিকিট। তাতে লেখা যাত্রীর নাম, ভাড়া, কোচ ও বার্থ নম্বর, যাত্রার তারিখ। ফ্ল্যাপ-প্রচ্ছদের উপর বড় করে ইংরেজিতে লেখা ‘রাজধানী এক্সপ্রেস’। কুতুব মিনার আর হাওড়া ব্রিজের ছবির মধ্যেকার তিরের অভিমুখ বুঝিয়ে দিত যাত্রারও মুখ। চেয়ার কারের টিকিটে কমলা তির, প্রথম শ্রেণিতে সম্ভবত হালকা নীল। হাওড়া থেকে ছাড়া ট্রেনের নম্বর ছিল ১০১ আপ রাজধানী এক্সপ্রেস। এখন যা হয়েছে ২৩০১ আপ!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Rajdhani Express Indian Railway
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE